রাজধানীর বিমানবন্দর থানা ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন নিজাম উদ্দিন মুন্না। বয়স মাত্র ২৪। ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি প্রহসনের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেভাগে রাজধানী থেকে অনেক প্রতিশ্রুতিশীল ছাত্রদল নেতাকে গুম করে র্যাব, ডিবি ও স্থানীয় থানা পুলিশ। সেই অভিযানে গুম করা হয় নিজাম উদ্দিন মুন্নাকেও।
“শেখ হাসিনার গুম-খুনের রাজনীতি” শীর্ষক ধারাবাহিক পর্বে আজকে নিজাম উদ্দিন মুন্নার গুমের তথ্য দেয়া হলো।
মুন্না ছিলেন বাবা-মার ছোট সন্তান। এজন্য আদরটা স্বাভাবিকভাবেই ছিলো একটু বেশি। পড়াশোনায় যেমন ছিলেন মনোযোগী, ঠিক তেমনি রাজনীতি সচেতনও ছিলেন এই তরুণ। শেখ হাসিনার জুলুমের শাসনামলে তিনি ছিলেন উচ্চকণ্ঠ একজন ছাত্রদল নেতা। ফলে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এর সহযোগী সংগঠন ছাত্রদলের বিমানবন্দর থানার গুরুত্বপূর্ণ পদেও একসময় আসীন হন তিনি। তাকে বিমানবন্দর থানা ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করা হয়।
কিন্তু, আওয়ামী লীগের জুলুমের শাসনামলে বিমানবন্দরের মতো গুরুত্বপূর্ণ এমন জায়গায় উচ্চকণ্ঠ একজন প্রতিশ্রুতিশীল ছাত্রনেতাকে কেন মেনে নেবে আওয়ামী লীগ! সেখানেই অবস্থিত র্যাব এর সদর দপ্তর এবং র্যাব-১ এর কার্যালয়। ফলে প্রহসনের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গুমের হিটলিস্টে তাকেও যুক্ত করে “প্রশাসনের লোকেরা”।
২০১৩ সালের ৬ ডিসেম্বর নিজাম উদ্দিন মুন্না ও তার এক সহকর্মী বন্ধুকে “প্রশাসনের লোক” পরিচয়ে তুলে নিয়ে যায়। এরপর থেকে আজ অবধি তাদের সন্ধান মেলেনি।
“আমার চোখের সামনে থেকে পাখির মতো করে আমার ছেলেটিকে নিয়ে গেল তারা। ছাত্রদল করাই ছিলো আমার ছেলের অপরাধ। মুন্নার সাথে তরিকুল ইসলাম ঝন্টুকেও তুলে নিয়ে যায় তারা,” সেই সময় গণমাধ্যমে গুমের অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী মুন্নার পিতা মো. শামসুদ্দিন এমনটাই বলেছিলেন।
“মুন্নাকে নেয়ার সময় জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘আপনারা কারা?’ জবাবে পুলিশ জানায়, ‘আপনার ছেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে’,” এভাবেই বাবার সামনে থেকে ছাত্রদল নেতা মুন্নাকে নিয়ে যায় ‘প্রশাসনের লোকেরা’।
প্রিয় সন্তানের খোঁজে হন্য হয়ে অনেক জায়গায় ঘুরেছেন হতভাগ্য এই পিতা।
“ছেলেকে না পেয়ে যখন মামলা করতে গিয়েছিলাম, তখন পুলিশ বলল, ‘সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয় না’,” এভাবেই সেই সময়ের ঘটনা বলেছিলেন মুন্নার বাবা।
মুন্নার স্বজনরা বলেন, তার বিরুদ্ধে কোনো থানাতেই মামলা বা জিডি ছিলো না। নির্বাচনের আগে ছাত্রদল করার অপরাধেই তাকে গুম করা হয়েছিল।
ছাত্রদলের প্রতিশ্রুতিশীল এই নেতাকে গুম হবার পর বিএনপির চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেছিলেন মুন্নার বাবা মো. সামসুদ্দিন মা ময়ূরী বেগম, বোন ও ভাই।
তাদেরকে সান্ত্বনা দিয়ে বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘জালিমের বিচার হবে একদিন’।
ছেলের শোকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন মুন্নার বাবা-মা। ছেলেকে ফিরিয়ে দিতে না পারলেও অন্তত কবরটা দেখিয়ে দেওয়ার আকুতি পরিবারের।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, গুম হওয়াদের বেশিরভাগই বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মী ও সমর্থক। আবার কেউ কেউ ক্ষমতাসীন দলেরও রয়েছেন, যাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নামে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
গুম হওয়া প্রিয়জনকে ফিরে পেতে স্বজনরা বছরের পর বছর বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছেন। কিন্তু, আজও মেলেনি তাদের সন্ধান। কিন্তু বুকভরা আশা নিয়ে বেঁচে আছেন তারা। এই বুঝি ফিরে এলো গুম হওয়া প্রিয়জন।
ছেলে কোথায় আছে জানেন না বৃদ্ধ মা। তবে মায়ের বিশ্বাস ছেলে ঠিকই ঘরে ফিরবে একদিন।
মুন্নার মায়ের মতো অনেক মা সন্তানের অপেক্ষায় দরজার দিকে তাকিয়ে থাকেন। স্বপ্ন দেখেন আবারও সন্তানকে নিয়ে একসাথে খাবেন, গল্প করবেন।
শুধু মায়েরাই নন, ছেলের অপেক্ষায় পিতা, স্বামীর অপেক্ষায় স্ত্রী, বাবার অপেক্ষায় সন্তান প্রতীক্ষার প্রহর গুনছেন।
হংকং ভিত্তিক এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯-২০১৯ সালের জুলাই পর্যন্ত ৫৩২ জনকে গুম করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৫৮ জনের সন্ধান আজও মেলেনি। গুম হওয়ার পর অনেককে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেফতার দেখালেও কারও কারও লাশ উদ্ধার হয়েছে।
গুম একটি ‘ভয়ঙ্কর মানবতাবিরোধী অপরাধ’। ২০১০ সালের ২১ ডিসেম্বর জাতিসংঘ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে গুমের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে।
বাংলাদেশে বর্তমান গুমের ধারাবাহিকতা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, যা শুরু হয়েছিল ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন