আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার হাতে গুম হওয়া রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের স্বজনদের সমন্বয়ে গড়া "মায়ের ডাক" বুধবার (১৭ আগস্ট) রাজধানীর মিন্টো রোডে অবস্থিত হোটেল শেরাটনের সামনে মানববন্ধন করবে।
সংগঠনটির সমন্বয়কারী সাজিদা ইসলাম মঙ্গলবার (১৬ আগস্ট) এক বার্তায় জানান, বুধবার বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে এই মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হবে।
রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনরা সম্মিলিতভাবে জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারকে তাদের উদ্বেগের বিষয়টি জানাতেই এই মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়েছে বলে জানা গেছে। ঢাকায় সফররত জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে বৈঠকের সময় সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে গুম হওয়া ব্যক্তিরা বিভিন্ন পথে বিদেশ চলে গেছেন। এতে গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনদের মধ্যে উদ্বেগ আরো বেড়ে গেছে। কারণ, স্বজনরা দীর্ঘদিন থেকে অপেক্ষায় রয়েছেন তাদের আপনজনকে রাষ্ট্রীয় গোপন কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হবে। তারা ঘরে ফিরবেন। গুমের শিকার ব্যক্তিদের বিভিন্ন জায়গা থেকে রাষ্ট্রীয় ডিবি, র্যাব অথবা সেনা গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা আটক করেছিলেন। আত্মীয়স্বজনদের সামনে থেকেই তাদের আটক করেছিল আইন গোয়েন্দা সংস্থা অথবা পুলিশের সদস্যরা।
এদিকে গত সোমবার (১৫ই আগস্ট) ঢাকায় সফররত জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেটের কাছে বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে বৈঠকে উদ্বেগের কথা তুলে ধরেন মানবাধিকারকর্মী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।
গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনদের নিয়ে কাজ করে ‘মায়ের ডাক’। এই সংগঠনের সমন্বয়কারী সানজিদা ইসলাম সংগঠনের পক্ষ থেকে সেই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি, গুম, বাকস্বাধীনতা, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, মানবাধিকার কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা, নারী নির্যাতন নিয়ে আলোচনা হয়।
পরে ‘মায়ের ডাক’ সংগঠনের সমন্বয়কারী সানজিদা ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, "আমাদের চাওয়া- গুম নিয়ে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি যেন গঠন করা হয়। আমাদের গুম হওয়া পরিবারগুলোকে যেন তারা জানায়, স্বজনরা কোথায় আছেন। তাদের বর্তমান অবস্থা কি? এটাই আমাদের চাওয়া ছিল। তিনি (মিশেল ব্যাচেলেট) বলেন, জাতিসংঘ নিজেদের মতো করে গুম-খুনের বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে চাচ্ছে। আমাদেরকে বলা হয়েছে এ বিষয়গুলো যেন প্রকাশ না করি। এতে তাদের কাজ করতে হয়তো সমস্যা হতে পারে।
উল্লেখ্য, কুখ্যাত ওয়ান-ইলেভেনের পর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে 'গুম' সংস্কৃতি জেঁকে বসে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় মরিয়া শেখ হাসিনার শাসনামলে গুমের সংস্কৃতি উদ্বেগজনক হারে বেড়ে যায়। গুম হওয়া নেতা-কর্মীদের অধিকাংশই বিএনপিসহ ১৯-দলীয় জোটের শরীক দল গুলোর নেতা-কর্মী।
এছাড়া ভিন্নমত দমনে ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে মেতে উঠে আইন শৃঙ্খলা-রক্ষাকারী বাহিনী গুলো। দেশে কথিত ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার বা বন্দুকযুদ্ধের গল্পের আড়ালে কী ঘটে এটা এখন সবাই জানেন। এই গুম-খুনে এগিয়ে থাকা আইন শৃঙ্খলা-রক্ষাকারী বাহিনী গুলোর কর্মকর্তাদের নানাভাবে পুরস্কৃত করেন শেখ হাসিনার সরকার।
ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা পরবর্তীতে যে তথ্য দিয়েছেন, তা বিশ্লেষণ করা জানা গেছে যে এসব গুমের সাথে সরাসরি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জড়িত। কোনো কোনো গুমের ঘটনায় বাহিনীর নির্ধারিত পোশাক পরে আসলেও, কিছু ঘটনায় সাধারণ পোশাকেই গুম করা হয়েছে। প্রকাশ্যে এসব গুমের জড়িতদের অত্যাধুনিক অস্ত্র ও পরিচয়পত্র বহন করতে দেখা গেছে। তবে, গুমের পর বরাবরের মতোই বেমালুম অস্বীকার করেছেন অভিযুক্ত বাহিনীর দায়িত্বরত কর্মকর্তারা।
শেখ হাসিনার পুরো শাসন আমল জুড়েই বাংলাদেশে গুম বা বলপূর্বক অন্তর্ধান জনমনে ব্যাপক আতঙ্ক, উদ্বেগ আর নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করেছে। এসব ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবার, স্বজন বা প্রত্যক্ষদর্শীরা দাবি করেছেন যে, বিশেষ বাহিনী র্যাব, ডিবি পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের পরিচয়ে সাদা পোশাকে ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের তুলে নেওয়া হচ্ছে; কিন্তু প্রায়শ সংশ্লিষ্ট বাহিনী তাদের গ্রেফতার বা আটকের বিষয়টি অস্বীকার করে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে থানা এসব ঘটনায় কোনো অভিযোগ নেয় না। স্বজনরা জিডি করতে গেলেও কোনো বিশেষ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাম, যারা ঘটনার সঙ্গে যুক্ত তাদের নাম উল্লেখ করে জিডি করা যায় না। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে গুম হওয়া এসব মানুষের বিষয়ে বিশ্বাসযোগ্য কোনো তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়নি। ফলে এতে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, বিরোধী দলের নেতা-কর্মী ও বিরোধী মতকে দমন করতে খোদ রাষ্ট্রই এসব বাহিনীকে ব্যবহার করে দিনের পর দিন গুমের মতো মানবতাবিরোধী অপকর্মে লিপ্ত।
আওয়ামী লীগপন্থী মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ২০০৭ সাল থেকে ২০২০ সালের ২৫ আগস্ট পর্যন্ত সারাদেশে ৬০৪ জন গুমের শিকার হয়েছেন। গুম হওয়াদের মধ্যে পরবর্তী সময়ে পাওয়া গেছে ৭৮ জনের লাশ। এছাড়া, ৮৯ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে এবং ৫৭ জন ফেরত এসেছেন। কিন্তু, বাদবাকিদের সন্ধান মেলেনি আজও।
গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের গড়া সংগঠন 'মায়ের ডাক’ এর তথ্য মতে, ২০০৯ থেকে ২০১৯ সালের এ পর্যন্ত ৫৩৮ জনকে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনী আটকের পর থেকে নিখোঁজ রয়েছেন। এদের মধ্যে অনেক দিন পর ৩০০ জন ফিরে এসেছেন। ৬৮ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এখনও ১৭০ জন নিখোঁজ রয়েছেন।
২০০৬ সালের ২০ ডিসেম্বর গুম হওয়া থেকে সব ব্যক্তির নিরাপত্তার জন্য আন্তর্জাতিক সনদ জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয়। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর প্রটেকশন অব অল পারসন্স অ্যাগেইনস্ট এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়্যারেন্স এই আন্তর্জাতিক সনদ কার্যকর হয়। তাতে ৩০ আগস্টকে আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস ঘোষণা করা হয়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পরিচয়ে বিভিন্ন ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা বন্ধ হচ্ছে না। যার ফলে গুমের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার অধিকার আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত হয় এবং কাউকে গুম করে দেওয়া মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃতি পায়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন