গভীর অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে থাকা বাংলাদেশের প্রকৃত রিজার্ভ নিয়ে ধোঁয়াশা যেন বাড়ছেই। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে সরকার যা বলছে তা মানতে নারাজ অর্থনীতিবিদরা। আবার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) দফায় দফায় বাংলাদেশকে সতর্ক করছে রিজার্ভের সঠিক তথ্য প্রকাশের। আইএএমফ’র কাছে সরকার সম্প্রতি বাংলাদেশের সংকটকালীন অর্থনীতি টিকিয়ে রাখতে বিশেষ ঋণ চেয়েছে। তবে এই সংস্থাটি বাংলাদেশকে ঋণ পেতে কিছু পূর্ব শর্ত জুড়ে দিয়েছে এবার। এসবের মধ্যে প্রধান দু’টি শর্ত হচ্ছে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি ও রিজার্ভের প্রকৃত তথ্য প্রকাশ।
আইএমএফ’র একটি শর্ত মেনেই সরকার জ্বালানির মূল্য এক লাফে ডাবল করেছে। এখন রিজার্ভের হিসাব দেয়ার পালা। এর মধ্যেই খবর বেরিয়েছে দেশের প্রকৃত রিজার্ভ নাকি ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের নিচে নেমে গেছে। আর এটি যদি সত্যি হয় তবে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে দেউলিয়া হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার, ১৯৭২-এর ৭/অ ধারায় বৈদেশিক মুদ্রার ধারণ ও ব্যবস্থাপনার এখতিয়ার বাংলাদেশ ব্যাংকের।
বিভিন্ন দেশের বৈদেশিক মুদ্রার দায় অর্থাৎ আমদানি দায় পরিশোধের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে রিজার্ভ। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, সাধারণত কোনো দেশের তিন মাসের বৈদেশিক মুদ্রার দায় মেটানোর মতো মজুত থাকতে হয়। আর বাংলাদেশে ৩ মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে হলে রিজার্ভ কম পক্ষে ৪০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে থাকতে হবে। কিন্তু সরকারি হিসেবেই রিজার্ভ এখন এই ঘরে নেই। সরকার দাবি করছে রিজার্ভ ৩৯ বিলিয়ন ডলার। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন সরকারের দেয়া এই হিসাব প্রকৃত হিসাব না। কারণ ব্যাখ্যা করা তারা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের অর্থ বিদেশে বিভিন্ন বন্ড, মুদ্রা ও স্বর্ণে বিনিয়োগ করে রেখেছে। বিদেশে এই বিনিয়োগের তালিকার ক্ষেত্রে প্রতিবেশি ভারতের কথা বলছেন তারা। আবার রিজার্ভের অর্থে দেশেও তহবিল গঠন করেছে। রিজার্ভ থেকে ৭০০ কোটি ডলার (৭ বিলিয়ন) দিয়ে গঠন করা হয়েছে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল। আবার রিজার্ভের অর্থ দিয়ে গঠন করা হয়েছে লং টার্ম ফান্ড (এলটিএফ), গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ড (জিটিএফ)।
এছাড়া বাংলাদেশ বিমানকে উড়োজাহাজ কিনতে ও সোনালী ব্যাংককে অর্থ দেওয়া হয়েছে। আবার পায়রা বন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেলের খনন কর্মসূচিতেও রিজার্ভ থেকে অর্থ দেওয়া হয়েছে। এসব মিলিয়ে ব্যবহার হয়েছে আট বিলিয়ন ডলার। ফলে প্রকৃত ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ ৩ হাজার ১০০ কোটি (৩১ বিলিয়ন) ডলারের নিচে নেমে আসে এমনিতেই। রিজার্ভের অর্থ থেকে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া শ্রীলংকাকেও ঋণ দেয়া হয়েছে। শ্রীলংকাকে ২০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ দেশটিকে ডলার হিসেবে রিজার্ভ থেকে ঋণ দিলেও, শ্রীলংকা এই ঋণ পরিশোধ করবে তাদের দেশের মুদ্রায়। ফলে রিজার্ভের অঙ্কে ডলার আর থাকছে না।
অন্যদিকে সম্প্রতি ডলারের লাগাম টানতে দফায় দফায় রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাজারে ‘স্থিতিশীলতা’ আনতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১ মাস ৮ দিনে (১ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট) বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ থেকে দেড় বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সোমবারও রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি তেল আমদানি ও বিপণন সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) তেল আমদানি এবং বাংলাদেশ রসায়ন শিল্প করপোরেশনের (বিসিআইসি) সার আমদানির এলসি (ঋণপত্র) খুলতে ব্যাংকগুলোর কাছে ১৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়েছে। এ হিসাবে রিজার্ভ ভেঙ্গে গড়ে প্রতিদিন ৪ কোটি ডলার বাজারে বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে রিজার্ভের প্রকৃত হিসেব নিয়ে প্রশ্ন আরো জোরালো হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেদের হিসাবের জন্য রিজার্ভের হিসাবকে দুই ভাবে করে থাকে। মোট রিজার্ভ ও প্রকৃত রিজার্ভ। আর প্রশ্ন ওঠায় এখন আইএমএফের কাছেও রিজার্ভের দুই ধরনের হিসাব পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক শুধু মোট রিজার্ভের হিসাব প্রকাশ করছে, যা ৩ হাজার ৯৪৯ কোটি ডলার। এর মাধ্যমে রিজার্ভকে বাড়িয়ে দেখানো হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
রিজার্ভ নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, রিজার্ভ থেকে ইডিএফ, জিটিএফসহ বিভিন্ন তহবিল গঠন করা হয়েছে। এসব তহবিল থেকে ঋণ দেওয়া হচ্ছে, আবার সময়মত ফেরতও আসছে। ফলে রিজার্ভ কম, এটা বলার সুযোগ নেই। আইএমএফ রিজার্ভের হিসাবায়ন নিয়ে যে আপত্তি তুলছে, এটা ঠিক নয়। রিজার্ভের টাকা থেকে শ্রীলংকাকে দেয়া ঋণ ও বাংলাদেশ বিমানকে দেয়া ঋণের টাকাতো ফেরত আসেনি? আরো গোপন কিছু আছে কিনা, এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি তা এড়িয়ে যান।
গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর সাংবাদিকদের বলেন, রিজার্ভ থেকে পায়রা বন্দর, শ্রীলঙ্কাসহ অন্য বিনিয়োগ ঠিক হয়নি। আর প্রকৃত ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ কত, তাই প্রকাশ করা উচিত, যা বর্তমানের চেয়ে আট/দশ বিলিয়ন কম। এতে রিজার্ভের দিকে অন্যদের দৃষ্টি পড়বে না, হিসাব নিয়েও প্রশ্ন উঠবে না। আর্থিক খাতে হিসাব নিয়ে প্রশ্ন উঠলে বিশ্বাসের সংকট তৈরি হয়।
এদিকে বাংলাদেশে স্বর্ণের মজুদও কমে যাচ্ছে অস্বাভাবিক হারে। অর্থনৈতিক চাপ সামলাতে সরকার মজুদ থেকে স্বর্ণ বিক্রি করে ডলার সরবরাহ করছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা সিইআইসি এর হিসেবে সব শেষ গত জুনে বাংলাদেশে স্বর্ণের মজুদ ছিল ৮১৯ দশমিক ৭৭৩ মিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ। যা গত মে মাসে ছিল ৮৩৩ দশমিক ১৩৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণ।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন