‘আমার ছাওয়ালকে কেন কী কারণে হত্যা করা হইল। আমি বাদী হয়া কেচ করব। তার অপরাধটা কী, জানতে চাই। আমার মেধাবী ছাওয়ালকে শেষ কইরি দিল, এর বিচার চাই।’
বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক ছেলে সেলিম হোসেনের মৃত্যু নিয়ে এসব কথা বলছেন বাবা শুকুর আলী। ছোটবেলা থেকেই মেধাবী সেলিমের রহস্যজনক মৃত্যু মানতে পারছেন না স্বজন, সহকর্মীরাও। সবাই এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক সেলিম হোসেন (৩৮) বিশ্ববিদ্যালয়টির লালন শাহ হলের প্রাধ্যক্ষের দায়িত্বেও ছিলেন। ক্যাম্পাস থেকে বাসায় ফিরে গত মঙ্গলবার বেলা তিনটার দিকে তিনি মারা যান। বুধবার সকাল ১০টায় গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালীর বাঁশগ্রামে তাঁকে দাফন করা হয়।
মারা যাওয়ার আগে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তাঁকে মানসিক নিপীড়ন করেছিলেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষকেরা একাডেমিক কার্যক্রম থেকে বিরত রয়েছেন। পালন করছেন নানা কর্মসূচি। অধ্যাপক সেলিমের বিভাগের শিক্ষার্থীরা তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোকাহত। তাঁরাও বৃহস্পতিবার বিকেলে শোক র্যালি ও প্রতিবাদ সভা করেছেন।
বিজ্ঞাপন
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক মো. সেলিম হোসেনছবি: সংগৃহীত
কুমারখালী উপজেলার বাঁশগ্রাম বাজারের সঙ্গেই সেলিমদের বাড়ি। তিনকক্ষের একতলা ছাদের বাড়িটি সেলিম হোসেন বাবাকে তৈরি করে দিয়েছিলেন। আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে বাড়ির ভেতরে যেতেই ঘর থেকে বের হন শুকুর আলী। সাংবাদিক পরিচয় জানার পরই তিনি হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন। বলেন, ‘বাবা, আমার ছাওয়ালকে পরিকল্পিতভাবে মাইরি ফেলাছে। ঘাপলা আছে। তদন্ত কনরলি বার হবি।’
মেধাবী সেলিমের সংগ্রামী জীবন
সেলিমরা দুই ভাই ও চার বোন। ভাইবোনদের মধ্যে তিনি তৃতীয়। ২০০০ সালে স্থানীয় বাঁশগ্রাম ইউনাইডেট বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে কুমারখালী উপজেলায় সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলেন তিনি। ২০০২ সালে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে স্টার নম্বর নিয়ে পাস করেন। এরপর কুয়েটে ভর্তি হন। পড়াশোনা শেষে সেখানেই শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এরপর বৃত্তি নিয়ে জাপানে এক বছর এবং পরে অস্ট্রেলিয়াতে চার বছর পড়াশোনা করেছেন। ২০১১ সালে চুয়াডাঙ্গায় বিয়ে করেন। তাঁর স্ত্রীর নাম সাবিনা খাতুন। ছয় বছরের একমাত্র মেয়ের নাম জান্নাতুল ফেরদৌস।
অধ্যাপক সেলিম হোসাইনের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় প্রকৃত অপরাধীদের বিচারের দাবিতে শিক্ষকেরা আজ বৃহস্পতিবার সমাবেশ করেন। খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্বার বাংলা ভাস্কর্যের পাদদেশেছবি: সাদ্দাম হোসেন
অত্যন্ত মেধাবী সেলিম হোসেনের জীবনসংগ্রাম সহজ ছিল না। বাবা শুকুর আলী বলেন, ‘আমি খ্যায়া না খ্যায়া কষ্ট কইরি ছাওয়ালরে লেখাপড়া শিখাইচি। নিজে তেমন পড়ালেখা জানি নে। কিন্তু ছাওয়ালকে কষ্ট করে পড়াশোনা করিচি। গিরামের হাটে তরমুজ বিক্রি করিচি। কখনো আম আবার কখনো সবজি বিক্রি করতাম। সেলিমও আমার সাথে থাইকি কাজ কইরতো।’
কুয়েটের প্রাক্তন শিক্ষার্থী মাহমুদ জনি বন্ধু সেলিমের স্মৃতিচারণা করে ফেসবুকে লিখেছেন, ‘অর্থনৈতিক দুরবস্থা যে কী জিনিস তা সেলিম খুব ভালোভাবেই জানত। কারণ, ওর বেড়ে ওঠা এক বেলা খেয়ে তো আরেক বেলা না খেয়ে। যখন প্রাইমারি স্কুলে একসঙ্গে পড়তাম, তখন ওকে মাঝে মাঝে দেখতাম গ্রামের বাজারে কাঁঠালপাতার বিড়ি বানিয়ে বিক্রি করতে। একবার হাটবারে বাজারে গেছি ইলিশ মাছ কিনতে, মাছ কিনে বাজারের ব্যাগে ভরে হেঁটে আসছি, তখন দেখি আমার বন্ধু তরমুজ ফালি ফালি করে বিক্রি করছে। আমি লুকিয়ে চলে আসছি, ওর সঙ্গে দেখা করার সাহস হয় নাই।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন