গাজা কি তবে সত্যিই ‘খোলা বন্দিশালা’, যেমনটা মনে করেন নাইরোবির পুরস্কারজয়ী লেখক প্যাট্রিক গাথারা? নয় তো কি, নিজভূম থেকে ফিলিস্তিনিদের তাড়িয়ে দিয়ে ইসরায়েল সীমান্তপাঁচিল দিলেও গাজার আকাশ তো খোলা। মন চাইলেই, কিংবা ইসরায়েলি নেতার ভাষায় বললে, ‘প্রয়োজন অনুভব’ করলেই সীমান্তে গুলির পাশাপাশি আকাশপথে বর্বরতা চালাতে দ্বিধাবোধ কি কিঞ্চিৎ দেরিটুকুও করে না ‘জাতবিদ্বেষী রাষ্ট্র’টি। এই যেমন দেখা যাচ্ছে টানা সাত দিন ধরে।
বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বাহিনী ‘গাজার জঙ্গিবাহিনী’ হামাসকে দমনের নামে গত সোমবার থেকে গতকাল পর্যন্ত অন্যায় রকম হামলা চালিয়েছে। এসব বিমান হামলায় প্রায় ২০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন; এদের মধ্যে নিরীহ শিশু রয়েছে ৫৫ জন এবং ৩৩ জন নারী। আল জাজিরার- এবার ইসরায়েলি হামলায় এ গণমাধ্যমে গাজা-কার্যালয়ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে- প্রতিবেদন অনুযায়ী, গতকালই নিহত হয়েছেন ৪২ জন। সাত দিনের মধ্যে বৃহস্পতিবার সর্বোচ্চ ৪৯ জন নিহত হন; ২০১৪ সালের গাজা যুদ্ধ এবং ২০১৮ সালের সহিসংতার পর এদিনই এত মানুষের প্রাণ ঝরেছে আরবের ‘মৃত্যু উপত্যকা’য়।
২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ডেমোক্র্যাট বারাকা ওবামা। এবং ওসময় যিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন, সেই জো বাইডেন এখন পশ্চিমা দেশটির শাসনকর্তা। খুব স্বাভাবিকভাবেই বাইডেনের সঙ্গে ফিলিস্তিনি-ইসরায়েল
সংঘাতের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন উঠছে দিকে দিকে। এমনকি চলমান আগুনেও এরই মধ্যে ঘি ঢেলে আঁচ উসকে দিয়েছেন মাস তিনেক আগে মসনদে বসা এই নেতা; তিনি ফোন করে ফিলিস্তিনের নেতা মাহমুদ আব্বাসকে (যিনি অবশ্য হামাসকে প্রতিনিধিত্ব করেন না) রকেট হামলা থামানোর আহ্বান জানিয়েছেন এবং নেতানিয়াহুকে আশ্বাস দিয়েছেন- সব রকম সহযোগিতা সমেত ইসরায়েলের পাশে আছে যুক্তরাষ্ট্র। এর পরই নেতানিয়াহুকে বলতে শোনা গেছে, ‘যতক্ষণ প্রয়োজন বিমান হামলা অব্যাহত থাকবে।’
তবে দেশে দেশে ইহুদিদের এই ‘গাজাবধ’-এর নিন্দা হচ্ছে, মিছিলে মিছিলে শামিল হচ্ছেন হাজারো মানুষ; এরা ফিলিস্তিনকে সমর্থন ব্যক্ত করছেন, আর ভর্ৎসনা করছেন ইসরায়েলকে। গণবিক্ষোভে সুর উঠেছে, ‘গাজায় গণহত্যা’ বন্ধ হোক।
এমনকি ডেমোক্র্যাট হওয়া সত্ত্বেও নিউইয়র্কের অন্যতম আইনপ্রণেতা আলেকজান্ডার ওকাসিও-করটেজ (সংক্ষেপে যিনি এওসি নামে পরিচিত) ইসরায়েলকে ‘জাতবিদ্বেষী রাষ্ট্র’ বলে অভিহিত করে গাজার ওপর চলমান বর্বরতার নিন্দা জানিয়েছেন।
নামের সঙ্গে মিল রাখতে ব্যর্থ সংঘ জাতিসংঘ কেতাবি হলেও গতকাল বৈঠক ডেকেছিল, যুদ্ধবিরতির বিষয়ে সম্ভাব্য সমঝোতার আশায়। কিন্তু বিবিসির কূটনৈতিক প্রতিবেদক পল অ্যাডামস মনে করেন, এমন সমঝোতার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। কারণ নেতানিয়াহু বলেছেন- বিমান হামলা ‘আরও জোরদার’ করা হবে এবং ‘সময় লাগবে’।
তবে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সংগঠন ওআইসির নির্বাহী কমিটির জরুরি বৈঠকে ফিলিস্তিনে চলমান নৃশংসতার জন্য এককভাবে ইসরায়েলকে দায়ী করা হয়েছে। ভার্চুয়াল এ বৈঠকে সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান আল সৌদ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের অধিকার ‘সুস্পষ্টভাবে লঙ্ঘন করার’ অভিযোগ তুলেছেন।
না, গাজা বা হামাস ধোয়া তুলসী পাতা নয় মোটেও। প্রেক্ষাপট যা-ই হোক না কেন, এবার কিন্তু হামাস প্রথম রকেট হামলা করেছে। তেলআবিবের দাবি অনুযায়ী, সাত দিনে অন্তত তিন হাজার রকেট হামলা করেছে হামাস, আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে এবার এ হার বেশি। প্রতিপক্ষের এসব হামলায় ইসরায়েলের দুই শিশুসহ ১০ জন নিহত হয়েছেন। সংখ্যাটা ‘মাত্র’ বলে দায় এড়িয়ে যায় না, প্রতিটি প্রাণই অমূল্য।
এ প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত জাতিসংঘের বৈঠকের কোনো বিবৃতি পাওয়া যায়নি। তবে আল জাজিরা জানায়, ফিলিস্তিনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাতিসংঘে নালিশ করেছেন, ‘ইসরায়েল আমাদের হত্যা করছে।’ রিয়াদ আল মালিকি বলেন, ‘জনগণ যে ভৌতিক বর্বরতার শিকার হচ্ছে, তা ভাষায় বর্ণনা করা অসম্ভব।’ তিনি যোগ করেন, ‘ভাবুন তো- হামলা থেকে বেঁচে জেগে উঠতে পারবেন কিনা, এমন সন্দেহ ও ভয় নিয়ে কীভাবে আপনি ঘুমাতে পারেন?’
আল মালিকি বলেন, ‘ইসরায়েল আমাদের লোককে হত্যা করছে। তারা যুদ্ধাপরাধ করছে। তারা মানবতাবিরোধী অপরাধ করছে।
জর্ডান বলছে- গাজায় যে রক্ত ঝরছে, যে হত্যাযজ্ঞ চলছে, এর জন্য পুরো দায় ইসরায়েলেরই। জর্ডানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাতিসংঘের বৈঠকে বলেন, ‘এসব অবশ্যই বন্ধ হতে হবে। যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে। ইসরায়েলের অবৈধ আচরণ অবশ্যই থামাতে হবে।’
এদিকে মার্কিন সিনেটর স্যান্ডার্স -যিনি ২০২০ সালে মার্কিন নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থিতার জন্য দলীয় প্রাথমিকে লড়েছিলেন- গাজায় ধ্বংসযজ্ঞকে ‘বিবেকবর্জিত’ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি মনে করেন, ইসরায়েলকে সামরিক সহায়তা দেওয়ার আগে মার্কিনদের ‘ভালোভাবে বুঝে নেওয়া দরকার’ যে এ সহায়তা কোথায়-কীভাবে ব্যবহার হবে। স্যান্ডার্স বলেন, ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনে সাহায্য করা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অবৈধ।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন