সম্প্রতি বাংলাদেশের ডলারের বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা, টাকার বড় ধরনের দরপতন করেও এই অস্থিরতা থামানো সম্ভব হচ্ছে না। এমনকি সর্বশেষ ব্যবস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেও ডলারের ঊর্ধ্বগতি থামাতে পারছে না। এখন তারা আরো একধাপ এগিয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে শুরু করেছে এবং এই উদ্দেশ্যে আমদানি নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় নিরুৎসাহ করা এবং এমনকি কতিপয় বৈদেশিক মুদ্রা ডিলার ব্যাংকের ওপর নজরদারিও শুরু করেছে।
দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন পদক্ষেপে দেশের মুদ্রাবাজারে ডলারের মূল্য কতটা স্থিতিশীল হবে তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তবে এ ধরনের অতিদ্রুত এবং সরাসরি হস্তক্ষেপ বাজারে আতঙ্ক বাড়াতে পারে।
দেশের মুদ্রাবাজারে ডলারের যে দরবৃদ্ধি ঘটেছে তা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। রিজার্ভের পরিমাণ যে হ্রাস পেয়েছে তাও অস্বাভাবিক নয়। বছরের কোনো একটি সময়ে এমনটি হতেই পারে এবং পৃথিবীর সব দেশেই হয়ে থাকে, যদি এর পেছনে সঠিক বাণিজ্যিক লেনদেনের হিসাব থাকে। একটি দেশে সারা বছর একই হারে ডলারে মূল্য পরিশোধ হবে এবং একই বিনিময় হার বিরাজ করবে তেমনটা হতে পারে না। কখনো বেশি হবে, আবার কখনো কম হবে—এটাই স্বাভাবিক এবং এটাই কার্যকর মুদ্রাবাজারের নিয়ম। তবে শর্ত হচ্ছে এই উত্থান-পতনের পেছনে যুক্তিসংগত লেনদেন নিষ্পত্তির কারণ থাকতে হবে। বর্তমান মুদ্রাবাজারে ডলারের যে ঊর্ধ্বগতি তা মূলত খোলাবাজারে বা কার্ব মার্কেটে, যার ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
খোলাবাজার মূলত আন্তর্জাতিক ডলার মার্কেটের একটি অংশ, যেখানে যে কেউ ডলার নিয়ে আসতে পারে, বিক্রি করতে পারে এবং সেখান থেকে ডলারও ক্রয় করতে পারে। এই খোলাবাজারেই ডলারের মাত্রাতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে এবং এক পর্যায়ে ডলারের মূল্য ১০০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে, যা এককথায় নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। কার্ব মার্কেট যেহেতু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণের বাইরে, তাই এই বাজারে ডলারের যে মূল্যই বিরাজ করুক তা নিয়ে আক্ষরিক অর্থে মাথা ঘামানোর কোনো কারণ নেই।
তবে কার্ব মার্কেটের অবস্থা সার্বিক মুদ্রাবাজারের আগামী গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে ইঙ্গিত দিয়ে থাকে। কার্ব মার্কেটের অস্থিরতাকে ঝড়ের পূর্বমুহূর্তে কিছু প্রাণীর ছোটাছুটির সঙ্গে তুলনা করা হয়। ডলারের কার্ব মার্কেটের যারা খেলোয়াড় তাদের দেশের বাইরে ও ভেতরে অনেক তথ্যসূত্র থাকে। সেখান থেকে তারা যে আগাম পূর্বাভাস পায় তার ওপর ভিত্তি করেই বাজারে ডলারের চাহিদা ও সরবরাহ করে থাকে। তাই ডলারের কার্ব মার্কেটের ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকলেও এই খোলাবাজারে ডলারের অস্থিরতাকে অশুভ লক্ষণ হিসেবে ধরে নিয়ে সময় থাকতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে মুদ্রাবাজারে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আগেই।
ডলারের এ রকম অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি যে হঠাৎ করেই হয়েছে তেমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। এ রকম অবস্থা যে হতে পারে তা আগে থেকেই আঁচ করা গেছে। আমি সম্প্রতি কয়েকটি লেখায় স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছিলাম যে বাংলাদেশ ব্যাংক যদি কিছু কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে দেশের রিজার্ভের ওপর চাপ পড়তে বাধ্য। ঠিক তেমনটাই হতে চলেছে। আমাদের মতো অতি সাধারণের কথা বাংলাদেশ ব্যাংক বিবেচনায় নেবে না, তা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু এ ব্যাপারে দেশের প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদরা যেসব মূল্যবান উপদেশ ও সতর্কবার্তা দিয়ে থাকেন, সেগুলোও বাংলাদেশ ব্যাংক খুব একটা বিবেচনায় নেয় বলে মনে হয় না। বিবেচনায় নিলে তারা কোনো অবস্থায়ই দেশে সুদের হার কমিয়ে সর্বনিম্ন পর্যায় অর্থাৎ ৫ শতাংশের কাছাকাছি নিয়ে আসতে দিত না। এভাবে জোরপূর্বক সুদের হার কমানোর পরিণতি দেশের মুদ্রাবাজারের জন্য মোটেই ভালো হয় না এবং এই ব্যবস্থা বুমেরাং হতে পারে। এর কারণে দেশে ডলারের দরপতন ঘটতে পারে, যা প্রকারান্তরে মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা তৈরি করতে পারে এবং কলমানি রেটও বেড়ে যেতে পারে।
২০০৪-০৫ সালে একইভাবে জোরপূর্বক সুদের হার কমিয়ে একক সংখ্যায় নিয়ে আসার কারণে তখনো ডলারের বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয় এবং ডলারের মূল্য অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। ডলারের এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের অনেক পদক্ষেপের পরও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। ডলারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি তখন সার্বিক মুদ্রা বাজারে এক ভয়ংকর অস্থিরতার জন্ম দিয়েছিল এবং দেশের কলমানি রেট বেড়ে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল।
যদিও ২০০৪ আর ২০২২ এক কথা নয়। কারণ তখনকার তুলনায় এখন দেশের অর্থনীতির ভিত্তি অনেক মজবুত এবং দেশের রিজার্ভের পরিমাণও কয়েক গুণ বেশি। কিন্তু সমস্যার ধরন এবং অর্থনীতি ও মুদ্রানীতির সূত্রগুলো একই। জোরপূর্বক সুদের হার কমালে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব দেশের মুদ্রাবাজার এবং অর্থনীতিতে পড়তে বাধ্য এবং তাই হচ্ছে। অনেকেই বলবেন যে দেশের অভ্যন্তরীণ সুদের হারের সঙ্গে ডলারের মূল্যের কোনো সম্পর্ক নেই। এই ধারণা একেবারেই ঠিক নয়। সম্পর্ক অবশ্যই আছে। যখন দেশের ভেতরে সুদের হার বেশি থাকে তখন মানুষ বেশি লাভের আশায় বিলাসদ্রব্যের ভোগ কমিয়ে বেশি সঞ্চয় করে। ফলে অপ্রয়োজনীয় আমদানি হ্রাস পায় এবং ডলারের চাহিদা কম থাকে। একইভাবে দেশে অর্থ জমা রাখলে বেশি লাভ হবে বিধায় প্রবাসীরা অধিক হারে ডলার দেশে প্রেরণ করেন, যা দেশের রিজার্ভ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।
ঠিক এর উল্টোটা ঘটে যখন দেশের অভ্যন্তরীণ মুদ্রাবাজারে সুদের হার জোরপূর্বক কমিয়ে রাখা হয়। অনেকেই ভাবতে পারেন যে সুদের হার কমিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। হতে পারে। কিন্তু দেশের মুদ্রাবাজারের অভিভাবক হিসেবে এর দায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপরই বর্তায়। তাই অর্থ মন্ত্রণালয় যখন এ রকম সিদ্ধান্ত নেয় তখন এর ক্ষতিকর প্রভাবের বিষয়টি খুব জোরালোভাবে তাদের দৃষ্টিতে এনে এ রকম সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে মন্ত্রণালয়কে বিরত রাখার কাজটিও বাংলাদেশ ব্যাংককেই করতে হয়।
কী কারণে দেশে ডলারের বিপরীতে টাকার অস্বাভাবিক দরপতন ঘটেছে এবং কেন দেশের রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন থেকে ৪২ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে তা বাংলাদেশ ব্যাংকের চেয়ে আর কেউ ভালো জানে না। এসব কারণ ভালো করে খতিয়ে দেখে কোন কোন খাতে বিগত তিন মাসে ডলার বেশি পরিমাণে পরিশোধিত হয়েছে তা নির্ণয় করে সে অনুযায়ী স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নেওয়াই হবে এই মুহূর্তে প্রধান কাজ। আর যেসব কারণে দেশে ডলারের রেমিট্যান্স আসা কমে গেছে, সেগুলো দ্রুত অপসারণ করতে হবে। একইভাবে প্রবাসীরা যাতে ডলার প্রেরণ করতে উৎসাহিত হন সেই উদ্যোগ নিতে হবে। দেশে ডলার বন্ডের ওপর সুদের হার কমিয়ে ৬.৫ শতাংশ থেকে ৪.৫ শতাংশ (বিভিন্ন মূল্যের ওপর বিভিন্ন হার প্রযোজ্য) করা হয়েছে, যা দেশে ডলার প্রেরণ করাকে দারুণভাবে নিরুৎসাহ করবে। এটা কোন যুক্তিতে করা হয়েছে তা বোধগম্য নয়। যখন উন্নত বিশ্বে সুদের হার কম ছিল তখন আমাদের দেশে ডলার বন্ডের ওপর সুদের হার ছিল ৫ শতাংশ বা তার বেশি। অথচ তখন যদি সুদের হার ৩ শতাংশের কাছাকাছি রাখা হতো তাতেও প্রবাসীরা দেশে ডলার বন্ড ক্রয় করে লাভবান হতো।
এখন যখন এসব উন্নত দেশে সুদের হার বেড়ে গেছে আর ঠিক তখনই দেশে ডলার বন্ডের ওপর সুদের হার কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে এখন দেশে ডলার পাঠিয়ে বন্ড ক্রয় করে তেমন কোনো লাভ হবে না বিধায় প্রবাসীরা দেশে ডলার প্রেরণ করতে উৎসাহ পাবেন না।
দেশে এখন ডলার বন্ড বা ওয়েজ আরনারস ডেভেলপমেণ্ট বন্ড ক্রয় ও নবায়ন করার ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর বাধ্যতামূলক করে রাখা হয়েছে। অথচ বেশির ভাগ প্রবাসী বাংলাদেশির জাতীয় পরিচয়পত্র নেই এবং সরকার প্রবাসীদের এখনো সেভাবে পরিচয়পত্র দেওয়া শুরুই করেনি। ফলে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও প্রবাসীরা জাতীয় পরিচয়পত্রের অভাবে দেশে ডলার বিনিয়োগ করতে পারবেন না। শুধু তা-ই নয়, এর আগের বিনিয়োগ একই কারণে নবায়ন করতে পারবেন না। ফলে তাঁরা সেই ডলার প্রবাসে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হবেন, যা চলমান ডলার সংকটকে আরো বাড়িয়ে দেবে। অথচ জাতীয় পরিচয়পত্রের পাশাপাশি প্রবাসীদের জন্য পাসপোর্ট নম্বর আইডি হিসেবে গ্রহণের সুযোগ দিয়ে এই সমস্যার সহজ সমাধান করা যায়। আগে নিটা (নন-রেসিডেন্ট টাকা) হিসাব ব্যবহার করে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ডলার পাঠিয়ে দেশের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে পারতেন। এতে একদিকে যেমন দেশে প্রচুর ডলার জমা হতো, অন্যদিকে তেমনি দেশের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেত। সেই সুযোগও বাংলাদেশ ব্যাংকের এক নিরীক্ষা টিম না বোঝেই অডিট আপত্তি দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের ডলার পাঠিয়ে দেশের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করার সুযোগ কমে গেছে।
এ রকম অনেক পদক্ষেপ আছে, যার তালিকা দিতে গেলে অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবে। এসব বাংলাদেশ ব্যাংকের জানা আছে। তাই ভালোভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়। সেই সঙ্গে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ডলার বন্ড বিক্রি করে ভালো অঙ্কের একটি বাফার রিজার্ভ তৈরি করে রাখতে হবে, যাতে খুব সহজে এ রকম আপৎকালীন ডলারের অস্থিরতা সামাল দেওয়া যায়। ডলারের সাম্প্রতিক সময়ের অস্থিরতা রোধে কার্যকর ও টেকসই ব্যবস্থা নিতে না পারলে বর্তমান অস্থির বিশ্বরাজনীতির কারণে পরিস্থিতি যেকোনো সময় মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। তাই আগে থেকে সাবধানতা অবলম্বনের কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : সার্টিফায়েড অ্যান্টি মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা
[email protected]
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন