মো. জাকির হোসেন
যুগে যুগে দেশে দেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিন্দিত হয়েছে। রাষ্ট্র শাসনে ধর্মের অপব্যবহার ভয়ংকর পরিণতি ডেকে এনেছে। এসব জেনেও ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার উগ্র হিন্দুত্ববাদকে রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি হিসাবে গ্রহণ করেছে। ফলে হিন্দু ধর্মের সারকথা ‘অহিংসা পরম ধর্ম’ এখন ভারতের ত্রি-সীমনা ছেড়ে পালিয়েছে। ধর্ম নিরপেক্ষতা কাগুজে নীতিতে পরিণত হয়ে সংবিধানে বৃত্তাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। উগ্র হিন্দুত্ববাদ ক্রমেই গ্রাস করছে সমগ্র ভারতবর্ষকে। তৃণমূলে ছড়িয়ে পড়ছে উগ্রবাদ, জন্ম নিয়েছে ভয়ংকর মুসলিম বিদ্বেষ। ২০০৫ সালে মনমোহন সিং সরকার কেন্দ্র, রাজ্য, অঞ্চল ও জেলা স্তরে মুসলমানদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত ক্ষেত্রে বিরাজমান অবস্থার ওপর প্রতিবেদন তৈরির জন্য দিল্লি হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি রাজেন্দ্র সাচারের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেন যা ‘সাচার কমিটি’ নামে পরিচিত।
সাচার কমিটি কেন্দ্রীয় সরকারি দফতর, রাজ্য সরকারি দফতর থেকে তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি প্রকাশিত সংখ্যাগণিত, গবেষণাপত্র ও পুস্তকাদি থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ৪৫০ পাতার তথ্যভিত্তিক এক প্রতিবেদন তৈরি করেন। প্রতিবেদনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মুসলমানদের বঞ্চনা ও বৈষম্যের নৈরাশ্যজনক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয় ভারতীয় মুসলমানদের অবস্থা তফসিলি সম্প্রদায় ও তফসিলি উপজাতীয়দের চেয়েও খারাপ অবস্থায় রয়েছে। দলিতরাও মুসলমানদের চেয়ে ভালো আছে। এই প্রতিবেদনে ভারতীয় মুসলমানদের ওপর পরিচালিত বৈষম্যের বিষয়টি জাতীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কমিটির একটি সুপারিশ ছিল বৈষম্যের বিষয়গুলো আইনিভাবে সমাধান করার জন্য একটি কৌশল উদ্ভাবন করার লক্ষ্যে একটি ‘ইকুয়াল অপারচ্যুনিটি কমিশন’ (ইওসি) গঠন করতে হবে।
এ ছাড়াও মুসলমানদের ‘মূলস্রোতে’ নিয়ে আসার জন্য বেশ কিছু সুপারিশ করা হয় প্রতিবেদনে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় মুসলমানদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর ব্যবস্থা করা, শিক্ষার সুযোগ বাড়ানো, মাদ্রাসা শিক্ষার যথাযথ গুরুত্ব, ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক সংস্থায় ঋণের সুবন্দোবস্ত, সরকারি ও আধা সরকারি চাকরিতে মুসলমানদের অংশগ্রহণ বাড়ানো এবং পরিকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো। প্রতিবেদনে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে এই পশ্চাদপদতা রাষ্ট্র কর্তৃক অনুসৃত বৈষম্যের নীতির ফল। রাষ্ট্র তার নীতি বদল না করলে এ পশ্চাদপদতা দূর হতে পারে না। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এই সুবিশাল জনগোষ্ঠী যদি স্থায়ী দারিদ্র, অশিক্ষা ও বুভুক্ষার মধ্যে বসবাস করেন তাহলে যে কেবল বিরাট মানব-সম্পদের অপচয় ঘটছে তাই নয়, একই সঙ্গে এই বিশাল জনগোষ্ঠীর নিজেদের ‘আলাদা’ বলে ভাববার বাস্তব ভিত্তি থেকে যাচ্ছে। এতে জাতীয় ঐক্য বিঘ্নিত হচ্ছে এবং সমাজের রূপান্তরের পথে বাধা তৈরি হচ্ছে। অপরদিকে অন্য জনগোষ্ঠীর মানুষদের মধ্যেও মুসলমানদের সম্পর্কে নানারকম বিদ্বেষমূলক ধারণা গড়ে উঠছে।
বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে মুসলমানদের মূল স্রোতে আনার পরিবর্তে বিজেপি সরকারের উগ্র হিন্দুত্ববাদী বিদ্বেষমূলক নীতি ভারতীয় সমাজকে বিভক্ত, বিষাক্ত ও রক্তাক্ত করেছে। কল্পকাহিনির ওপর ভিত্তি করে ভারতের শাসক দলের হঠাৎ করে আমদানি করা বৈধ নাগরিকত্বের ধারণা জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) ও সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) ভারতের নাগরিক ও সমাজের বন্ধনে নজিরবিহীন ভাঙন সৃষ্টি করেছে। হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের ফলে সৃষ্টি হয়েছে ঘৃণা, আর ঘৃণা থেকে দাঙ্গা-সহিংসতা। এর মাধ্যমে ভারতের গণতন্ত্র ও সভ্যতা লজ্জার মধ্যেই পড়ছে। ২০২০ এর ফেব্রুয়ারিতে দিল্লিতে সাম্প্রাদায়িক ঘটনা তার একটি উদাহরণ মাত্র। ভারতের একটি বড় অংশে প্রায় তিনশ বছর রাজত্ব করেছিল মুঘল সাম্রাজ্য। প্রায় তিনশো বছর রাজত্ব করা মুঘল সাম্রাজ্য দেশের ইতিহাসের একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ভারতের বেশিরভাগ সৌধ মুঘল আমলে তৈরি হয়েছিল। মুঘল সম্রাট শাহজাহানের অনন্য সৃষ্টি তাজমহল। মুঘল শাসনামল ভারতবর্ষের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। অথচ ভারতের মহারাষ্ট্রের স্কুলের সিলেবাস থেকে পুরোপুরি বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে মুঘল আমলের ইতিহাস। মুঘল সুলতানদের ইতিহাস সরিয়ে দিয়ে সেখানে নিয়ে আসা হয়েছে হিন্দু শাসক ছত্রপতি শিবাজীর প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যের ইতিহাস। কমিটির চেয়ারম্যান সদানন্দ মোরে জানাচ্ছিলেন, ‘আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা মহারাষ্ট্রের বাসিন্দা। তাই মারাঠা ইতিহাসের সঙ্গে তাদের সরাসরি যোগ আছে। সমস্যাটা হলো বইয়ে পৃষ্ঠা সংখ্যা সীমিত। তাই দুটো ইতিহাসই রাখা কঠিন, আবার মুঘল ইতিহাস রেখে মারাঠা ইতিহাস তো সরিয়ে দেওয়া যায় না!’ ইতিহাস পাঠ্যপুস্তক কমিটি বলছে, এই সিদ্ধান্তের পেছনে ধর্মীয় বা রাজনৈতিক কোনও কারণ নেই।
প্রশ্ন হলো, মুসলমানদের ইতিহাস বাদ না দিয়ে, কয়েক পৃষ্ঠার মুঘল ইতিহাস পড়ানো হলে খুব কী ক্ষতি হয়ে যেত? কেবল স্কুলের সিলেবাসে নয়, মুসলিম বিদ্বেষের প্রভাব পড়েছে ভারতের আদালতেও। অকাট্য প্রমাণ ও প্রামাণ্য নথিপত্রের ভিত্তিতে নয়, বরং হিন্দু ধর্মের কিছু মানুষের বিশ্বাসকে মান্যতা দিয়ে বাবরি মসজিদ মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট মসজিদের জায়গায় মন্দির নির্মাণের বিতর্কিত রায় দিয়েছেন। পরস্পরবিরোধী, পক্ষপাতমূলক রায়টি ছিল অসঙ্গতিপূর্ণ। আদালত নিজেই স্বীকার করেছেন, মসজিদের নিচে যে কাঠামোর সন্ধান মিলেছিল, তা কোনও মন্দিরেরই কাঠামো ছিল, এমনটা আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার (এএসআই)-এর রিপোর্টে স্পষ্ট হয়নি। তাহলে বিতর্কিত জায়গায় মন্দির নির্মাণের পক্ষে রায়ের ভিত্তি কী?
আদালত বলেছেন, ‘তবে ওই স্থানকে যে হিন্দুরা ভগবান রামের জন্ম স্থান হিসেবে বিশ্বাস করেন, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই।’ আদালতের আরেকটি যুক্তি ছিল, ‘তবে বিতর্কিত জমির ওপর রামলালার অধিকার স্বীকার করে নেওয়াটা আইন-শৃঙ্খলা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বহাল রাখার প্রশ্নের সঙ্গে সম্পৃক্ত।’ বাবরি মসজিদ মামলার রায়ে একটি ভয়ংকর ‘বিপজ্জনক তত্ত্ব’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যদি কেউ প্রশ্ন তোলেন যে, অমুক মসজিদের নিচে মন্দির কিংবা অমুক মন্দিরের নিচে মসজিদের কাঠামো আছে, তাহলে এই রায়ের তত্ত্ব অনুযায়ী মাটির ওপর খাড়া ভবন ভেঙে পরীক্ষা করতে হবে এবং বিশ্বাসকে মান্যতা দিতে কিংবা আইন-শৃঙ্খলা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বহাল রাখার স্বার্থে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী গোষ্ঠীর পক্ষে রায় দিতে হবে, তাতে প্রামাণ্য নথিপত্র থাকুক আর না থাকুক। সুপ্রিম কোর্টের এই বিপজ্জনক তত্ত্বের প্রয়োগ শুরু হয়েছে ভারতে।
সম্প্রতি ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের বরাবাঁকিতে যোগী আদিত্যনাথের সরকার ১০০ বছরের প্রাচীন একটি মসজিদ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। প্রশাসন দাবি করছে, ওই মসজিদের কাঠামোটি অবৈধভাবে নির্মিত হয়েছিল এবং এলাহাবাদ হাইকোর্টের অনুমতি নিয়েই তারা সেই স্থাপনাটি ভেঙেছে। কিন্তু মসজিদের খাদেম রমজান আলি বলছেন তাদের বক্তব্য পেশ করার কোনও সুযোগই দেওয়া হয়নি। আইনজীবী জাফরিয়াব জিলানির মতে, নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকা অবস্থায় এই মসজিদ ভেঙে আদালতের রায়ের অবমাননা করা হয়েছে। অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ড এক বিবৃতিতে দাবি করেছে, ওই মসজিদটি নিয়ে কখনও কোনও বিতর্ক ছিল না এবং সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে সেটি ধূলিসাৎ করা হয়েছে। সংস্থার সাধারণ সম্পাদক মৌলানা খালিদ সাইফুল্লা রেহমানি আরও বলেছেন, ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মুসলিমরা সেখানে নামাজ পড়ে আসছেন– যে বক্তব্য নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যেও কোনও দ্বিমত নেই। বিবিসির প্রতিবেদন মসজিদের পাশের হিন্দু প্রতিবেশী বেণী শর্মার উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেছে, ‘সেই ছোটবেলা থেকে এখানে কখনও নামাজ পড়া বন্ধ হয়েছে বলে দেখিনি।’
২০১৪ সালে বরাবাঁকির মসজিদের একটি দরগা থেকেই নির্বাচনি প্রচারের সূচনা করেছিলেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী। বাবরি মসজিদ ও বরাবাঁকির গরিব নেওয়াজ মসজিদ ছাড়াও আরও দুটি মসজিদ ভাঙার হুমকিতে পড়েছে। এই মসজিদ দু’টি ভাঙতে সুপ্রিম কোর্টের বিপজ্জনক তত্ত্বের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। মসজিদ দু’টি হলো বারানসির জ্ঞানবাপী মসজিদ বা আলমগিরি মসজিদ ও আগ্রা জামে মসজিদ বা জাহানারা মসজিদ।
সম্প্রতি ভারতের বারানসির একটি আদালত নির্দেশ দিয়েছে যে, জ্ঞানবাপী মসজিদ কোনও মন্দির ভেঙে গড়া হয়েছে কিনা- তা খতিয়ে দেখতে প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ চালাতে হবে। এ ঘটনার এক সপ্তাহ পর উত্তরপ্রদেশের মথুরার একটি আদালতে আরেকটি পিটিশন দায়ের করা হয়েছে। যেখানে রাজ্যটির আগ্রায় অবস্থিত জাহানারা মসজিদের নিচে হিন্দু দেবতা কৃষ্ণের মূর্তি আছে কিনা- তা খতিয়ে দেখতে একই ধরনের জরিপ চালানোর অনুমতি চাওয়া হয়েছে। মসজিদটি আগ্রা জামে মসজিদ নামেই বেশি পরিচিত। পিটিশনে বলা হয়েছে, মথুরা জামানস্থান মন্দিরে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে সেখান থেকে কৃষ্ণের মূর্তি নিয়ে আসেন মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব। পরে আগ্রায় জাহানারা মসজিদের নিচে সেটিকে পুঁতে রাখেন তিনি। জ্ঞানবাপী মসজিদে প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ চালানোর বিষয়ে বারানসির আদালতের রেফারেন্স দিয়ে পিটিশনে বলা হয়েছে, জাহানারা মসজিদের নিচে দেব-দেবীর মূর্তি আছে কি-না তা খতিয়ে দেখা জরুরি।
মসজিদ ভাঙার টার্গেটের পাশাপশি ভারতীয় মুসলিম নারীদের বিরুদ্ধে আরেকটি ভয়ংকর বিদ্বেষ ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। অতি সম্প্রতি অনেক মুসলিম নারীদের অনলাইনে অবমাননাও করতে দেখা যায়। ‘সুল্লি ডিলস’ নামে অ্যাপ ব্যবহারকারীদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, অনলাইনে একজন ‘সুল্লি’ কেনার এখনই সুযোগ। ভারতে উগ্র হিন্দুদের অনেকে ট্রলে মুসলিম নারীদের অবমাননা করতে ‘সুল্লি’ শব্দটি ব্যবহার করে। যদিও ভারত সরকার ‘সুল্লি ডিলস’ অ্যাপ বন্ধ করেছেন। কিন্তু আশংকার বিষয় হলো, হিন্দুত্ব উগ্রবাদের বিদ্বেষ তৃণমূলে পৌঁছে গিয়েছে ও ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
মহাভারতের প্রবাদে আছে, ‘তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে।’ মহাভারতের এই প্রবাদটির অন্তর্নিহিত অর্থ হলো- মানুষ তার কৃতকর্মের পরিণতি থেকে কোনোভাবেই রেহাই পায় না।
আফগানিস্তানে তালেবানরা ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করছে। তালেবানের সাথে সুসস্পর্ক রয়েছে পাকিস্তানের। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সাথে তালেবানরা বৈঠক করেছে। পাকিস্তান ও চীনের সাথে ভারতের সম্পর্ক বন্ধুত্বের নয়। তালেবানের পাশাপাশি রয়েছে আল-কায়েদা, হাক্কানী গ্রুপ, লস্করই তৈয়্যেবা। এদিকে ‘গাজওয়াতুল হিন্দ’ বা ‘হিন্দুস্থানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’কে সামনে রেখে সংগঠিত হচ্ছে বাংলাদেশ ও ভারতের জঙ্গিরা। বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত দুই জঙ্গি সংগঠন জামাতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ-জেএমবি, আনসার আল ইসলাম ও ভারতের জামআতুল মুজাহিদীন ইন্ডিয়া-জেএমআই একজোট হয়ে এই অপতৎপরতা শুরু করেছে বলে খবরে প্রকাশ।
সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে গ্রেফতার হওয়া চার জঙ্গির কাছ থেকে এ তথ্য পেয়েছে ভারতের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। এ অবস্থায় ভারত মসজিদ ভাঙা, মুসলিম নারীদের অপদস্থ করা তথা মুসলিম বিদ্বেষের নীতি থেকে দৃশ্যমানভাবে সরে না আসলে জঙ্গি হামলার বিপদের আশংকা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাত-উল-জিহাদ-আল-ইসলামি এবং তালিবানের সঙ্গে সখ্যতা রয়েছে। সিলেটের বুলবুলি হুজুর নামে খ্যাত মুফতি হাবিবুর রহমান হরকাত-উল-জিহাদ-আল-ইসলামি এবং তালেবান ও আল-কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কথা নিজেই স্বীকার করেছেন। ২০০৪ সালে ইসলামি বিপ্লব নামে একটি বুলেটিনে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন যে, তার সঙ্গে ওসামা বিন লাদেন ও পাকিস্তানের হরকাত-উল-জিহাদ-আল-ইসলামির সম্পৃক্ততা রয়েছে। তিনি সেই সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘হরকাত-উল-জিহাদ-আল-ইসলামির আমন্ত্রণের কারণেই আমার আফগানিস্তান ভ্রমণ সম্ভব হয়েছে। ...আমরা যারা আফগানিস্তানের যুদ্ধক্ষেত্র ভ্রমণ করছি তারা হলেন, শাইখুল হাদিস আজিজুল হক, আতাউর রহমান খান (কিশোরগঞ্জ-৩ আসন থেকে নির্বাচিত বিএনপির সাবেক এমপি), চট্টগ্রামের সুলতান যাউক, ফরিদপুরের আবদুল মান্নান, নোয়াখালীর হাবিবুল্লাহ, আমি নিজে এবং আরও তিনজন।’
তিনি পাকিস্তানে অবস্থিত মুজাহিদিন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন সেখানে অনেক বাংলাদেশি মুজাহিদিন-এর সাথে তার সাক্ষাৎ হয়েছে। সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেছেন, ‘তালেবানের পথ ধরে খেলাফতভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই কেবল জাতির ভাগ্য পরিবর্তন সম্ভব।’ তালেবানের বিজয় বাংলাদেশের জঙ্গিদের উজ্জীবিত করবে সন্দেহ নেই। শঙ্কার কথা, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নিশ্চিত করেছে যে কিছু জঙ্গি ও সন্ত্রাসী সংগঠন হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে যুক্ততা বজায় রেখে চলছে। এদের বেশিরভাগই আফগানিস্তান ফেরত। এদের মধ্যে রয়েছে- হরকাতুল জিহাদ বা হুজি।
গত ২৬ থেকে ২৮ মার্চ টানা তিন দিন দেশজুড়ে হেফাজত যে তাণ্ডব চালায়, তার সঙ্গে হুজির যোগসূত্র পাওয়া গেছে। আরেকটি গোয়েন্দা প্রতিবেদন বলছে, হেফাজতের প্রায় ডজনখানেক নেতার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের।
বাংলাদেশে জঙ্গি সংগঠনগুলোর প্রধান শত্রু আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু পরিবার। বঙ্গবন্ধু কন্যাকে যে ১৯ বার হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে তার বেশ কয়েকটির সাথে হরকাতুল জিহাদ, জামায়াতুল মুজাহিদিনসহ কয়েকটি জঙ্গি সংগঠন সম্পৃক্ত ছিল। অথচ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর ইসলামের প্রচার-প্রসারে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সরকার। বঙ্গবন্ধুর রক্তে ছিল ইসলামের প্রচার-প্রসারের তাগিদ। আর তাই বঙ্গবন্ধু সাংবিধানে মদ-জুয়া নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলামের প্রচার-প্রসারের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি তার সংক্ষিপ্ত শাসনামলে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে যে অসামান্য অবদান রেখেছেন তার মধ্যে অন্যতম হলো, ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড পুনর্গঠন, টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমার স্থান বরাদ্দ, হজ পালনের জন্য সরকারি অনুদানের ব্যবস্থা, সীরাত মজলিশ প্রতিষ্ঠা, বেতার-টেলিভিশনে ধর্মীয় অনুষ্ঠান প্রচার, ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.), শবে কদর, শবে বরাত উপলক্ষে সরকারি ছুটি ঘোষণা, মদ জুয়া নিষিদ্ধকরণ ও শাস্তির বিধান, রাশিয়াতে প্রথম তাবলীগ জামাত প্রেরণের ব্যবস্থা, ইসলামি সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) অধিবেশনে যোগদান করে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে এই সংস্থার অন্তর্ভুক্ত করা। বঙ্গবন্ধুর ইসলাম প্রচার ও প্রসারের ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ইসলাম ও আলেম সমাজের জন্য যা কিছু করেছেন, অন্য কোনও সরকার তা করে নাই।
বঙ্গবন্ধু কন্যার নির্দেশে দেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলায় মডেল মসজিদ নির্মাণ হচ্ছে। দেশে প্রায় এক লাখ মসজিদভিত্তিক মকতব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। খতিব-ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদেমদের জাতীয় স্কেলে বেতন নির্ধারিত হয়েছে। ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আলেমদের দীর্ঘ সময়ের দাবি কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। অথচ বঙ্গবন্ধু প্রবর্তিত মদ-জুয়া নিষিদ্ধের বিধান যারা বাতিল করলেন, হজের সরকারি অনুদান বন্ধ করলেন তারা ইসলামের সেবক বলে পরিচিত আর বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার ইসলামবিরোধী বলে মিথ্যা অপপ্রচারের শিকার হলেন। এর দু’টো কারণ হলো, স্বাধীনতাবিরোধীদের হাত ধরে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান। পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টি করায় জঙ্গিদের টার্গেট আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার। বাংলাদেশ সৃষ্টিতে ভারতের সক্রিয় সহযোগিতা থাকায় ভারতও জঙ্গিদের প্রতিপক্ষ। আবার ভারতের সঙ্গে আওয়ামী লীগ এর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকার কারণেও আওয়ামী লীগ জঙ্গিদের শত্রুপক্ষ।
উগ্র হিন্দুত্ববাদের বিদ্বেষে মসজিদ ভাঙা, মুসলিম নারীদের অবমাননা ও মুসলিম নির্যাতনের ঘটনার মাধ্যমে ভারত নিজের জন্য বিপদ ডেকে আনার পাশাপাশি বাংলাদেশকেও জঙ্গিবাদের ঝুঁকির মুখে ফেলছে এই কথা জোর দিয়ে বলা যায়।
লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন