ডা. জাহেদ উর রহমান
‘এয়ার ক্র্যাশ ইনভেস্টিগেশন’ নামের ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলের অনুষ্ঠানটি এক সময় আগ্রহ নিয়ে দেখতাম। অনুষ্ঠানটিতে খুব ছোট একটা ক্লু থেকেও বিমান দুর্ঘটনার কারণ খুঁজে বের করায় মানুষের অসাধারণ বিশ্লেষণ ক্ষমতা দেখে মুগ্ধ হতাম কিন্তু এর একটা ভয়ঙ্কর ‘সাইড ইফেক্টও’ তৈরি হয়েছিল আমার ভেতরে। এমনিতেই বিমানে চড়তে ভয় পেতাম সব সময়,এই অনুষ্ঠানটা সেই ভীতি আরও অনেক বাড়িয়ে দিয়েছিল। ভেবে অবাক হতাম ভীষণ উন্নত সব দেশের বিখ্যাত সব এয়ারলাইনে নানা রকম মানবীয় এবং যান্ত্রিক ত্রুটি থেকে যায় এবং বিমান দুর্ঘটনা ঘটে।
আজকের এই কলাম লিখতে গিয়ে সেই অনুষ্ঠানটার কথা মনে পড়লো একটা বিশেষ কারণে। বিমান দুর্ঘটনা ঘটে বিমানের যান্ত্রিক ত্রুটি,আবহাওয়ার গোলযোগ অথবা বৈমানিক কিংবা ভূমিতে বিমান পরিচালনাকারী (এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার) এর ভুলে। সেই অনুষ্ঠানে সব সময় বলা হয়– প্রতিটি বিমান দুর্ঘটনার একটা ভালো দিকও কিন্তু আছে, এটা পরবর্তী যে কোনও বিমান যাত্রাকে আরও নিরাপদ করে তোলে। সেই দুর্ঘটনার কারণ উদ্ঘাটন করে সেটা নিয়ে ব্যবস্থা নিয়ে বিমান দুর্ঘটনাগুলোকে কমিয়ে আনা যায় অনেকাংশে। আজকে যে অতি নিরাপদ বিমান ভ্রমণ মানুষ করে তার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে বিমান দুর্ঘটনাগুলো। মৃত মানুষগুলো যদি জানতে পারতেন তাদের জীবন হারানোর জন্য রক্ষা পাচ্ছে আরো অনেক মানুষের জীবন, তাহলে তারা নিশ্চয়ই সন্তুষ্ট হতেন।
বাংলাদেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ হুট করে চলে আসেনি। এটার পূর্বাভাস দিয়ে বিশেষজ্ঞগণ মানুষকে তার আচরণে শিথিলতা ত্যাগ করতে বলেছেন। গত শীতের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী কয়েকবার এটা নিয়ে মানুষকে সতর্ক করেছেন। এমনকি মার্চ মাসে বাংলাদেশে এটা শুরুর বেশ আগেই পৃথিবীর অনেক দেশে সেটা শুরু হয়ে গিয়েছিল। আমাদের কাছে এই তথ্যও ছিল– এমন একটা প্যানডেমিকের ক্ষেত্রে প্রথম ঢেউয়ের চাইতে দ্বিতীয় ঢেউ অনেক বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে থাকে। ১০০ বছর আগের ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ প্যানডেমিক আমাদের সামনে এই সত্য উন্মোচিত করেছিল। সেই উদাহরণকে মাথা রাখার কথা বলা হচ্ছিল বিশ্বব্যাপী।
গত বছর ১০২ তম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশে করোনার অস্তিত্ব ঘোষিত হয়। বিশ্বের প্রথম করোনা শনাক্তের দুই মাস এক সপ্তাহ আর ভারতে শনাক্ত হবার এক মাসেরও বেশি সময় পর বাংলাদেশে করোনা শনাক্ত হয়। অর্থাৎ একটা নতুন মহামারিতে কোন দেশ কোন ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে কোন ধরনের ফল পেয়েছে সেটা আমরা দেখার যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছিলাম। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সেটার খুব ভালো বাস্তবায়ন আমরা দেখিনি।
করোনার প্রথম ঢেউ মোকাবিলার ক্ষেত্রে আমাদের নানা রকম দুর্নীতি,অদক্ষতা,অব্যবস্থাপনা এবং সমন্বয়হীনতার সাক্ষী হতে হয়েছে। তখন একটা অজুহাত ছিল এই প্যানডেমিক পৃথিবীতে প্রথম তাই এসব নাকি ‘স্বাভাবিক’ ছিল। আগের অনুচ্ছেদটি পড়লেই বোঝা যায়, এই দাবি যৌক্তিক না, কিন্তু তর্কের খাতিরে মেনে নিলাম। তাহলে প্রশ্ন আসে প্রথম ঢেউয়ে প্রকাশিত হওয়া আমাদের দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে উঠতে আমরা কী করেছি?
করোনার প্রথম তবে যেসব ক্ষেত্রে আমাদের চরম ব্যর্থতা ছিল প্রতিটি নিয়ে আলোচনা করে দেখানো যায় সে জায়গাগুলোতে আমরা তেমন কিছুই করতে পারিনি। আমরা শিখিনি অথবা শিখতে চাইনি। সবগুলো বিষয় না গিয়ে একটি বিষয় ধরে এই ব্যাপারটি বোঝা যাক।
গত বছর করোনার প্রকোপে এই দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চরম দৈন্যদশা আমাদের সামনে প্রকাশিত হয়। এই রোগের সবচেয়ে জটিল পরিস্থিতিতে যেহেতু আইসিইউ সাপোর্টের প্রয়োজন হয়, তাই আমরা তখন দেখেছিলাম সারাদেশ থেকে রোগীদের ঢাকামুখী স্রোত। তখনই আমরা জানতে পারি মাথাপিছু আইসিইউয়ের সংখ্যায় বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। দেশের ৪৭ টি জেলায় একটি আইসিইউ বেডও নেই। উন্নয়নের চরম বড়াই করা দেশটির তিন-চতুর্থাংশ জেলায় আইসিইউ না থাকার খবরটি রীতিমতো অবিশ্বাস্য।
এরপর মনে হলো সরকার এই বিষয়টিতে নজর দিতে চাইছে। গত বছরের ২ জুন একনেকের সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিটি জেলা হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট স্থাপনের নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে প্রতিটি হাসপাতালে ভেন্টিলেটর স্থাপন এবং উচ্চমাত্রার অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা বাড়াতে নির্দেশ দেন। এ জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনার নির্দেশও দেন। এর আগে গত বছরের ২৭ এপ্রিল দেশের সব জেলায় আইসিইউ স্থাপন করা হবে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
বিমান দুর্ঘটনার তদন্ত থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান কীভাবে পরবর্তী বিমান ভ্রমণকে আরও বেশি নিরাপদ করে তোলে সেটা নিয়ে কথা বলছিলাম কলামের শুরুতে। আমাদের দেশে করোনার প্রথম ঢেউয়ে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা,বহু মানুষের সময় মতো চিকিৎসা না পেয়ে মারা যাওয়া, ভীষণ কষ্টের মধ্য দিয়ে যাওয়া এসব আমাদের তো এই দ্বিতীয় ঢেউয়ে অনেক ভালোভাবে প্রস্তুত করে রাখার কথা ছিল। হয়েছে কি সেটা? দশ মাস পর কতটুকু উন্নতি হলো আইসিইউ পরিস্থিতির?
একটি আইসিইউ বেডও নেই এমন জেলার সংখ্যা বর্তমানে ৪২। হ্যাঁ,প্রধানমন্ত্রীর উপর্যুপরি নির্দেশনা এবং নির্দেশের পর প্রায় এক বছরে মাত্র পাঁচটি জেলায় নতুন করে আইসিইউ বেডের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই উন্নতিটুকু হয়েছে এই দেশে সবচেয়ে ক্ষমতাধর মানুষটির বারংবার নির্দেশের পর।
সাম্প্রতিক রিপোর্টে দেখা যায় নানা রকম অজুহাত দেওয়া হচ্ছে– কেন আইসিইউ স্থাপন করা যায়নি। কোথাও বলা হচ্ছে অবকাঠামো না থাকার কথা,আবার কোথাও অজুহাত পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত জনবল না থাকার। একটা দেশের চরম জরুরি অবস্থায় জরুরি ভিত্তিতে অবকাঠামো তৈরি এবং জনগণ প্রশিক্ষিত করা যাবে না,এটা কোনও যুক্তিই নয়। এমন একটা সময়ে এসব অজুহাত দেখানো হচ্ছে যখন দেশে ‘মানি ইজ নো প্রবলেম’– গত অর্থবছরের বাজেটে উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ ছিল দুই লক্ষ কোটি টাকার বেশি। শুধু তাই নয় করোনা মোকাবিলার জন্য জরুরি তহবিল রাখা হয়েছিল ১০ হাজার কোটি টাকা যার অতি সামান্যই খরচ হয়েছে এখন পর্যন্ত। তাহলে কেন এই ক্ষেত্রে উন্নতি হয়নি?
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে যখন আমি ইন্টার্নশিপ করছি তখনকার একটা স্মৃতি মনে পড়ল। সিটি স্ক্যান মেশিনটা অনেক সময়ই ঠিক থাকতো না। ঠিক করাতেও খুব গড়িমসি করা হতো। এমনকি যখন ঠিক থাকত তখনও রোগীর ভীষণ চাপ এবং নানারকম অব্যবস্থাপনার কারণে পরীক্ষা করতে গিয়ে মানুষ সমস্যায় পড়ত। তখন অনিবার্যভাবেই কিছু জরুরি ক্ষেত্রে রোগীকে সিটিস্ক্যান করানোর জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ইমার্জেন্সির আশপাশে গজিয়ে ওঠা ডায়াগনোস্টিক সেন্টারগুলোতে পাঠাতে হতো। পাঠক আশা করি বুঝতে পারছেন কেন সরকারি সেই সিটিস্ক্যান মেশিন ঠিক মতো কাজ করতো না।
যে কেউ খোঁজ নিলেই জানবেন যে ৪২ টি জেলায় এখনও সরকারি পর্যায়ে একটি আইসিইউ বেডও নেই সেখানেই প্রায় সব জেলায় বেসরকারি পর্যায়ে আইসিইউ সেবা আছে। ভুক্তভোগীরা তো জানেনই,এই সমাজের অন্য সচেতন মানুষরাও জানেন এই আইসিইউগুলোকে কেন্দ্র করে কী ভয়ংকর ব্যবসা হয়। প্রয়োজনের চাইতে বেশি সময় রাখা, অপ্রয়োজনেও রোগীকে সেখানে রাখা এমন নানা অনিয়মে পরিপূর্ণ এই সেবা। কারণ একটা দিন আইসিইউতে থাকা মানে কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকার বিল,হাসপাতালে ধরনের উপরে ভিত্তি করে এটা এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে হাই-ফ্লো অক্সিজেন, আইসিইউ এর জন্য তো বটেই, একটা খালি বেডের জন্যও হাহাকার লেগে গেছে। সরকারি পর্যায়ে যেহেতু গত বছরের চাইতে সেবা দেওয়ার পরিধি বাড়েনি বরং কমেছে ক্ষেত্র বিশেষে, তাই মানুষ এখন প্রাণপণে চেষ্টা করছে অন্তত বেসরকারি হাসপাতালে হলেও একটা শয্যার ব্যবস্থা করতে। কিংবা যেসব রোগীর আইসিইউ প্রয়োজন তারা প্রাণপণে খুঁজে বেড়াচ্ছেন যেকোনও মূল্যে যেকোনও খানে একটা আইসিইউ। এমন গল্পে ভরে আছে আমাদের ফেসবুকের টাইমলাইন। কিন্তু আমরা কি জানি বেসরকারি খাতে এইরকম একটা চিকিৎসার জন্য কি ভয়ঙ্কর মাশুল দিতে হয় এমনকি একটা সামর্থ্যবান পরিবারকেও?
মানুষের এই ভয়ঙ্কর বিপদের দিনে বেসরকারি হাসপাতালগুলো অকল্পনীয় রকম মুনাফা করছে। অর্থনীতির তত্ত্ব অনুযায়ী চাহিদার তুলনায় জোগান যেহেতু অনেক কম জোগানদাতা হাঁকতে পারছেন যে কোনও মূল্য। প্রিয়জনের জীবন বাঁচানোর অনিবার্য তাগিদে মানুষ মেনে নিচ্ছে সব। এরপর রোগী বাঁচুক বা মরুক বহু পরিবার পথে বসে। মূল ধারার মিডিয়াগুলো খুব কমই এই ধরনের বিষয় নিয়ে রিপোর্ট করছে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা ভয়ংকরভাবে বেসরকারিখাত নির্ভর। এই খাতে অকল্পনীয় পরিমাণ ব্যবসা হয়। সুতরাং দেশে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় খাত যত শক্তিশালী হয়ে উঠবে বেসরকারি খাতের ব্যবসায় বড় সমস্যা হবে তো বটেই। সে কারণেই নানা চক্র মিলে এই দেশের রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা ঠিকভাবে গড়ে উঠতে দিচ্ছে না। এই দক্ষিণ এশিয়ায় জিডিপি’র অনুপাতে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় আমাদের দেশে সর্বনিম্ন। এ কারণেই ব্যক্তিগত খরচের অনুপাত সারা পৃথিবীতে ধাপে ধাপে কমে আসলেও আমাদের ক্ষেত্রে সেটা বাড়ছে নিয়মিত। সর্বশেষ হিসাবে মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৭২ শতাংশ মানুষকে নিজ পকেট থেকে দিতে হয়। ৫ বছর আগেও মানুষকে ব্যক্তিগতভাবে ব্যয় করতে হতো আরও কম - ৬৭ শতাংশ।
এই আলোচনায় আইসিইউ স্রেফ একটা উদাহরণ, প্রতিটি ক্ষেত্রে ঘটছে ঠিক এটাই। একজন প্রধানমন্ত্রী যতই আন্তরিক হোন না কেন সরকারের নানা পর্যায়ে ঘাপটি মেরে থাকা চক্র এই পদক্ষেপগুলোকে সফল হতে দেয় না। ব্যক্তিখাতকে পুরোপুরি বাতিল করে সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন একটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা তৈরি করা ছাড়া আমাদের এই সংকট কাটবে বলে আমি বিশ্বাস করি না। সংকটের মূলকে জিইয়ে রেখে নেওয়া কোনও পদক্ষেপ ব্যর্থ হতে বাধ্য।
লেখক: শিক্ষক ও অ্যাকটিভিস্ট
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন