দু’বছর আগে যখন দলে দলে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ শুরু করে, তখন অনুমান করা গিয়েছিল- তারা একদিন বাংলাদেশের জন্য বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াবে। এর আগেও রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
যে সংখ্যায় তারা প্রবেশ করেছিল, তার একটা ক্ষুদ্রাংশ মিয়ানমারে ফিরে গেছে। বাকিরা এখানেই থেকে গেছে। তাদের সংখ্যা কম হলেও ৪ লক্ষাধিক।
তবে এবার মিয়ানমারের বর্বর সেনাবাহিনী ও পুলিশ রাখাইন রাজ্যে ভয়াবহ তাণ্ডবলীলা সৃষ্টি করেছে, নির্বিচারে নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে, নারী ধর্ষণ করেছে, বিশেষ করে যুবক সম্প্রদায়কে হয় হত্যা, না হয় দেশত্যাগে বাধ্য করেছে।
যাতে আর কোনোদিন তারা তাদের বসতবাড়িতে ফিরে যেতে না পারে, সেই লক্ষ্যে ঘরবাড়ি ধ্বংস করে দিয়েছে। সে কারণে মাত্র ৩ সপ্তাহে ৩ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিল। সারা বিশ্ব দেখেছে সেই করুণ দৃশ্য।
কীভাবে তারা জীবনবাজি রেখে নদীপথে, জঙ্গল ও পাহাড় পেরিয়ে কী অসহায়ভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশ সরকার মানবতাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তাদের আশ্রয় দিয়েছে। স্থানীয় জনগণ নিজেদের বাসস্থানে পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের থাকার জায়গা দিয়েছে।
এ পর্যন্ত প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারের বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান করছে। রোহিঙ্গাদের কারণে আশপাশের বন-জঙ্গলের বিরাট ক্ষতি হয়েছে, মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় ঘটেছে। দাবি উঠেছে, তাদের দ্রুত ফিরিয়ে নেয়ার। সারা বিশ্বের দৃষ্টি রোহিঙ্গাদের ওপর।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধান, মানবাধিকার সংগঠন, দাতা সংস্থা, জাতিসংঘের প্রতিনিধিসহ দায়িত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে গেছেন। রোহিঙ্গাদের জন্য তারা আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ, প্রয়োজনীয় ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রী সরবরাহ, মেডিকেল ক্যাম্প স্থাপন, খাদ্য ও পানীয় সরবরাহ ইত্যাদি করেছেন।
তবে সবারই এক কথা- রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরে যেতে হবে। জাতিসংঘে এ নিয়ে কয়েকবার আলোচনা হয়েছে এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দিয়ে রোহিঙ্গা ইস্যুকে আন্তর্জাতিক সমস্যা উল্লেখ করে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনামূলক প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু রোহিঙ্গা সংকটের কোনো সমাধানই হয়নি।
পৃথিবীর বৃহৎ শক্তিগুলো তাদের স্বার্থের অনুকূলে বিভিন্ন সময়ে বক্তব্য পেশ করছে; যা রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আজ পর্যন্ত কার্যকর হয়নি। কোনো কোনো সরকারপ্রধান মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে অবরোধ সৃষ্টির কথা বললেও চীন ও রাশিয়ার কারণে তা কার্যকর করা যায়নি।
কোনো কোনো দেশ মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কিছু কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও বরং প্রতিটি দেশ নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্টতার কারণে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে যে ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রয়োজন ছিল, তা নিতে নারাজ বলে মনে হয়।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের পক্ষে চীন সবসময় কথা বলে আসছে; কিন্তু মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার পক্ষে তারা নয়। কেন নয়, তা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
এবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চীন সফরে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে অনুরোধ জানিয়েছেন; কিন্তু ফেরত নেয়ার ক্ষণেই দেখা গেল, রোহিঙ্গারা বেঁকে বসেছে। বিশাল সমাবেশ ডেকে রোহিঙ্গারা দাবি তুলেছে, নাগরিকত্ব প্রদান ও সম্পূর্ণ নিরাপত্তা না দিলে তারা দেশে ফিরে যাবে না।
অথচ এ জন্য বাংলাদেশকে দোষারোপ করা হচ্ছে- বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে দিতে অক্ষম। জাপান বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাষ্ট্র। মিয়ানমারের সঙ্গেও দেশটির সম্পর্ক ভালো। জাপান রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে কিছু উদ্যোগ নিয়েছিল; কিন্তু তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থের কারণে উঁচু গলায় কিছু বলছে না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসম্যান যেভাবে রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের পরামর্শ দিয়েছেন, অনেকেই একে বিপজ্জনক বলে মনে করছেন। বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এতে কোনো সাড়া দেননি।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত সবসময় বাংলাদেশকে সমর্থন করে আসছে এবং রোহিঙ্গা-প্রশ্নে যেসব সাহায্য-সহযোগিতা এসেছে, তার উল্লেখযোগ্য পরিমাণ এসেছে ভারত থেকে। রাশিয়া তো বোধহয়, তার দেশের অস্ত্র বিক্রির স্বার্থের কারণে মিয়ানমারকে অসন্তুষ্ট করতে রাজি নয়। এই যখন আন্তর্জাতিক বাস্তবতা, তখন রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান কোন পথে- এ প্রশ্ন তোলা স্বাভাবিক।
এ ব্যাপারে এখন প্রয়োজন জাতিসংঘসহ বিশ্ব নেতাদের এগিয়ে আসা। বিশ্বের অন্যান্য ক্ষেত্রে যেভাবে শরণার্থী সংকটের সমাধান করা হয়েছে, বাংলাদেশের ব্যাপারে অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
এ ব্যাপারে আগ বাড়িয়ে কিছু বলা না গেলেও বিশ্ব সম্প্রদায় আন্তরিক হলে, বিশেষ করে ওআইসির সমর্থন পেলে সংকটের পথ সহজ হবে বলে মনে হয়। আসলে জাতিসংঘকে দোষ দিয়ে কোনো লাভ নেই। জাতিসংঘ যারা নিয়ন্ত্রণ করে, সেই মহাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে কয়েকটি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো দেয়ার অধিকার আছে।
তারা সংকট নিরসনে যুক্তি ও মানবতাবাদী হয়ে এগিয়ে না এলে বাংলাদেশের পক্ষে এই ১১ লাখ রোহিঙ্গা এবং এর সঙ্গে প্রতিবছর যুক্ত হওয়া ১ লাখ নতুন মুখের স্থায়ীভাবে ভরণপোষণ করা সম্ভব নয়।
শুধু অর্থনীতি নয়; নিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা, হত্যা, ধর্ষণ, মাদকাসক্তি এবং সন্ত্রাসসহ সবকিছু বিবেচনায় নিলে রোহিঙ্গারা আজ বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের জন্য মহা অশুভ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
রোহিঙ্গাদের সর্বশেষ অবস্থানে বাংলাদেশ সত্যিই বিব্রতবোধ করছে। কেউ নিজ ইচ্ছায় যেতে না চাইলে বলপ্রয়োগ করে ফেরত দেয়া জাতিসংঘের নীতি নয়। আর ক্ষমতা প্রয়োগ করে তাদের ফেরত দিতে গেলে যে ভয়াবহ বাস্তবতার সৃষ্টি হবে; তা যাতে না হয়, সেই কারণেই বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আগমনের বিরোধিতা করেনি।
কিন্তু রোহিঙ্গাদের কারণে বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে দেয়া যায় না। সরকার দ্রুত উন্নয়নশীল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল।
অনেক উন্নত ও ধনী রাষ্ট্র যেখানে দ্রুত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ব্যর্থ হচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশ দ্রুত উন্নয়নে সফলতা অর্জন করেছে। আজ বাংলাদেশের বার্ষিক উন্নয়ন বাজেট প্রায় ৫.২৩ লাখ কোটি টাকার উপরে। সুতরাং যে কোনো বিষয়ে আমরা আজ পেছনের দিকে ধাবিত হতে পারি না।
রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের জন্য অস্তিত্বের প্রশ্ন। এটি বাংলাদেশের একক কোনো সংকট নয়- বিশ্ববাসীর মানবতার সংকট। এরূপ সংকট জাতিসংঘ যদি সমাধান করতে না পারে, তাহলে জাতিসংঘের থেকে লাভ কী?
হঠাৎ করে দেশের বাইরে ও ভেতরে বেশকিছু অস্থিরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে; কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগেও যা বলেছেন, এখনও তাই বলছেন- এ অঞ্চলে যে কোনো সংঘাতের পথ এড়িয়ে সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে।
মনে হয়, কোনো কোনো মহল সংঘাত সৃষ্টিতে আগ্রহী। ইয়েমেনে যা ঘটে চলেছে; সিরিয়া যে কারণে বিধ্বস্ত- এরূপ একটা যুদ্ধময় পরিবেশ বাংলাদেশে সৃষ্টি করা যায় কি না; এরূপ অসৎ উদ্দেশ্য যাদের রয়েছে, তারা রোহিঙ্গা ইস্যুকে আরও জটিল করার চেষ্টা করছে। তারাই বোধহয় যুক্তি দিচ্ছে, বর্তমানে রোহিঙ্গাদের ফেরত দেয়া সঠিক হবে না।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও মানবিক কারণে নির্যাতিত দেশত্যাগী রোহিঙ্গাদের এ দেশে বসবাসের সুযোগ দিয়েছেন। দেশরত্ন, সফল রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার এ উদ্যোগ দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে।
ইতিমধ্যে তিনি বিশ্বে ‘মানবতার মা’ হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছেন। বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও উদারনীতি বিশ্বে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে; কিন্তু দীর্ঘদিন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে অবস্থান করলে আমাদের দেশের স্থিতিশীলতা, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাহীনতা, পরিবেশ বিপর্যয়সহ অনেক সমস্যা সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে।
দ্রুত এর সুষ্ঠু সমাধান ছাড়া এ মুহূর্তে কোনো কিছু ভাবার নেই। কূটনৈতিক ব্যর্থতার যেসব কথা বলা হচ্ছে বিরোধী দল থেকে, এটা আদৌ সঠিক নয়। বাংলাদেশ সরকার সবসময় কূটনৈতিক চ্যানেলে সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে অযথা জল ঘোলা করার কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশ সরকার একক কোনো সিদ্ধান্তে নয়; বরং বিশ্ববাসীর সমর্থন নিয়েই রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আন্তরিক। মানবতার এ চরম বিপর্যয়ে বিশ্ব বিবেক এগিয়ে আসুক, এ প্রত্যাশা সমগ্র দেশবাসীর।
ডা. এসএ মালেক : লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন