সমষ্টিগত স্বপ্নগুলো সাধারণত খুব বড় বড় এবং সুন্দরও হয় অসম্ভব সুন্দর। এত সুন্দর যে, মনে হয় না এগুলো অলীক কল্পনা মাত্র, কখনোই বাস্তবিক হবে না। কিন্তু তবুও হয় তো। মানুষের পক্ষে অসম্ভব বলে তো কোনো কিছু নেই, সব অসম্ভবকে তো সে সম্ভব করেছে; বিশেষ করে তখন, যখন কাজ করেছে একসঙ্গে। এই মুহূর্তে আমাদের সামনে অনেক সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন রয়েছে, যার সবক’টিই সমষ্টিগত। এর অর্জনটা মাত্র বাকি, অর্জিত হলে দুঃখ থাকবে না আর অসম্মান ঘটবে না দেশে-বিদেশে, কারণ রইবে না ক্ষোভ-বিক্ষোভের। স্বপ্নগুলো আমাদের জানা। হামেশাই শুনছি। এক নিঃশ্বাসে বলে দেয়া যাবে। যেমন প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি বড় রাজনৈতি দল যদি তাদের ভেতরকার ঝগড়া-ফ্যাসাদ মিটিয়ে ফেলে একটা স্থায়ী সমঝোতায় আসে। দেশে যদি সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে কি চমৎকার ব্যাপারই না হতো। আইনের শাসন, সৎ ও যোগ্য লোকের নির্বাচন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা এবং সব মিলিয়ে আশা করা যাবে যে, আমাদের এই রাষ্ট্রকে কোনো দিক দিয়েই একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র বলা যাবে না, যেমনটা কেউ কেউ এখন বলতে চাচ্ছে। কিন্তু এই স্বপ্নগুলোকে বোধ হয় একটু খতিয়ে দেখা দরকার, যাতে বুঝতে পারি এর বাস্তবায়নের সম্ভাবনা কতটুকু এবং বাস্তবায়িত হলে আমরা কতটা সামনে এগোতে পারব। অর্থাৎ সমর্থ হব উন্নতি করতে।
প্রথম আশাটা হচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বী ও সর্বক্ষণ ঝগড়ায় নিমগ্ন দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমঝোতা। তার জন্য একটা ফর্মুলাও খুঁজে বের করা যেতে পারে। এমন হতে পারে যে, হস্তগত করার মতো সম্পত্তি ও ক্ষমতা যা আছে তা ষাট চল্লিশ অনুপাতে তারা ভাগাভাগি করে নেবে। ক্ষমতায় যারা থাকবে, তারা পাবে শতকরা ষাট ভাগ আর যারা ক্ষমতার বাইরে থাকবে তারা পাবে চল্লিশ ভাগ। প্রতি পাঁচ বছর পর পর ব্যবস্থার বদল হবে, এখন যারা বাইরে আছে তারা ক্ষমতায় যাবে, গিয়ে বরাদ্দমতো ষাট ভাগ পেতে থাকবে আর ক্ষমতাসীনরা নেমে এসে চল্লিশ ভাগ ভোগ করবে। এ রকম ব্যবস্থা চলতে থাকবে, যতদিন পর্যন্ত খোদা না করুন কোনো বিপর্যয় না ঘটে। বণ্টনটা যাতে সুষ্ঠু হয়, সেটা দেখভাল করার জন্য একটি স্বাধীন নিরপেক্ষ কমিশন থাকবে, প্রয়োজনে বিদেশিদের সাহায্যও নেয়া যেতে পারে। এই রকম ব্যবস্থা করা গেলে রাজনীতিতে সংঘর্ষ থাকবে না, টেনে নামানো এবং উঠে বসার জন্য ব্যস্ততার কারণ রইবে না। কেননা কারো জন্যই আশঙ্কা থাকবে না বঞ্চিত হওয়ার। এই যে নির্বাচন নিয়ে এতসব প্রস্তাব-পাল্টা প্রস্তাব, নির্বাচনের যথার্থ ব্যবস্থাকরণ এসবেরও কোনো আবশ্যকতা রইবে না, কেননা নির্বাচনের দরকারই হবে না। ভোটার তালিকা তৈরি, নির্বাচন কমিশনসহ টাকা-পয়সার অঢেল যে অপচয় তা থেকে দেশ ও জাতি অব্যাহতি পাবে। দেশে বেশ ক’টা গণতান্ত্রিক রাজবংশই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। বড় ভাই ছোট ভাই মিলে দেশ শাসন করবে, আজ যে ছোট ভাই পাঁচ বছর পরে সে বড় ভাই এর চেয়ে গণতান্ত্রিক বন্দোবস্ত আর কি-ই বা হতে পারে। দলের ভেতরেও গণতন্ত্র থাকবে, দলই ঠিক করে নেবে প্রধান কে হবে। অবশ্য দল এটাও বলে দিতে পারে যে, যিনি দলের প্রধান, তিনিই ঠিক করে দেবেন পরবর্তী প্রধান কে হবে, অর্থাৎ দলের ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটবে তার কাজটির মধ্য দিয়ে।
কিন্তু সত্যি সত্যি যদি এমন একটা সমঝোতা হয়ে যায়, তাহলে জনগণের অবস্থা কি দাঁড়াবে? এখন এক ভাই হস্তগত করে অন্য ভাই তাতে বাধা দেয়। তখন তো বাধা দেয়ার কেউ থাকবে না, দায় থাকবে না কোনো প্রকার জবাবদিহিতার। দুই ভাইতে মিলে লুণ্ঠন করবে এবং শান্তির সঙ্গে ভাগবাটোয়ারা করে নেবে। হাতের পরিধি বাড়বে তাদের। বাড়বে মুখের গ্রাস। জনগণ টু-শব্দটি করতে পারবে না। করলে দুই ভাই মিলে একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়বে। দেশের সম্পদ পাচার হয়ে যাবে, লোকে তা দেখবে, কিন্তু কিছু বলার মতো সাহস খুঁজে পাবে না। না, এ রকমটা ঘটলে তাকে ঠিক স্বর্গবাস বলা যাবে না, অবস্থাটা বরং নারকীয়ই হবে বলেই আশঙ্কা। এখন তবু মিছিল, মিটিং, হরতাল, বিবৃতি দান করা সম্ভব হচ্ছে, আলোচনা-সমালোচনা করছি, ভোট এলে ভোটার হিসেবে পয়সা কড়ি দু’চারটে হাতে আসছে।
তখন সেসব গুড়েবালি পড়বে; স্বৈরাচার কাকে বলে টের পাওয়া যাবে। তার চেয়ে যা আছে তা-ই বরং থাকুক, মাসতুত ভাইদের মধ্যে ঝগড়াটা থাকুক, তারা সহোদর ভাই হয়ে গেলে বিপদ আছে। এরপর ধরা যাক সুশাসনের ব্যাপারটা। এটা কে না চাইবে। শাসক চাইবে। শাসিতও চাইবে। তবে এই দুই পক্ষের মধ্যে তফাৎটা আকাশ-পাতালের চেয়ে কম নয়। শাসক শ্রেণীর কাছে সুশাসন অর্থ হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা। আইনশৃঙ্খলা যে কত বেশি প্রয়োজন তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের কোনো অভাব ঘটেনি। শাসকদের জন্য আইনশৃঙ্খলা কেন প্রয়োজন, সেটা অবশ্য তারা খুলে বলেনি কখনো, বলবেও না। কেননা তারা যখন সুশাসন চায়, তখন ইচ্ছাটা থাকে নির্বিঘেœ লুণ্ঠনের। লুণ্ঠনকে অবশ্য সুশাসন বলে স্বীকার করা কঠিন। কিন্তু শাসকের গোপন দৃষ্টিতে লুটপাটের অবাধ সুযোগই হচ্ছে প্রকৃত সুশাসন। অস্বীকার করার কি কোনো উপায় আছে যে, এ দেশে শাসন অর্থই হচ্ছে শোষণ। এটা অতীতে সত্য ছিল, দুই-দুইবার স্বাধীন হওয়ার পরও অসত্য হয়ে যায়নি। অসত্যই যদি হবে, তাহলে বিত্তবানরা অমন উন্মত্ত কেন ক্ষমতায় যাওয়ার ব্যাপারে? শাসক শ্রেণী চায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি হবে চমৎকার, জনগণ টু-শব্দটি করবে না, করা মাত্র এমনভাবে শাস্তি দেয়া হবে যে, চিরকালের জন্য তারা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। আর ওই নিñিদ্র আইনশৃঙ্খলার মধ্যে শাসকরা আইনি-বেআইনি সুশৃঙ্খল-বিশৃঙ্খল সব পদ্ধতিতে বিত্ত সঞ্চয় করবে। বিনিয়োগ ঘটবে, উৎপাদন বাড়বে, কিন্তু সব মুনাফা চলে যাবে ক্ষমতাবানদের হাতে, তারা সেটা ভোগ করবে, নষ্ট করবে এবং পাচার করে দেবে। শাসক শ্রেণী এবং তাদের প্রতিনিধিরা যখন সুশাসনের কথা বলে, তখন আওয়াজটা যাই হোক অন্তর্নিহিত অর্থ থাকে এটাই।
সুশাসন জনগণও চায়। কিন্তু তাদের সুশাসন সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। তারা চায় নিরাপত্তা, চায় মৌলিক অধিকারগুলোর প্রতিষ্ঠা। সুশাসন বলতে তারা বোঝে ঘুষ থাকবে না, পুলিশকে দেখে ভয় পাওয়ার দরকার হবে না। এই যে চিকিৎসা, শিক্ষা, নিরাপত্তা সব কিছু ব্যক্তিগত ব্যবস্থাপনায় চলে যাচ্ছে তা ঘটবে না। বেকারত্ব থাকবে না, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর হবে। কিন্তু এই সুশাসন প্রতিষ্ঠা কি তথাকথিত আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার উন্নতি ঘটালেই সম্ভব? মোটেই নয়। জনগণ যে সুশাসন চায় তা আনতে হলে রাষ্ট্রের বর্তমান চেহারা-চরিত্রে একেবারে মৌলিক পরিবর্তন নিয়ে আসতে হবে। সমাজ তখন বড় হবে রাষ্ট্রের তুলনায়। কিন্তু সে সমাজ অবশ্যই আজকের সমাজ থাকবে না। সমাজ নিজেও তখন বদলে যাবে। সেখানে মানুষের সঙ্গে মানুষের বিচ্ছিন্নতা থাকবে না, থাকবে গভীর মৈত্রী। মানুষে মানুষে অধিকার ও সুযোগের ক্ষেত্রে বৈষম্য থাকবে না। প্রতিষ্ঠিত হবে সমতা। রাষ্ট্রক্ষমতা একটি নির্দিষ্ট কেন্দ্রে আটকে থাকবে না, বিস্তৃত হয়ে পৌঁছে যাবে সমাজের সর্বত্র এবং সর্বস্তরে জনপ্রতিনিধিদের পরিচালনার প্রতিষ্ঠা ঘটবে। সব কাজ হবে মাতৃভাষার মাধ্যমে; শিক্ষা হবে সর্বজনীন, মেধার বিকাশ ঘটবে পারস্পরিক সহযোগিতার ভেতর দিয়ে। উৎপাদনে থাকবে সামাজিক উদ্যোগ। ওই উদ্যোগে কর্মসংস্থান বাড়বে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য হিংস্র ও অপরাধপ্রবণ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় বাহিনীর প্রয়োজন হবে না, স্থানীয় মানুষ নিজেরাই দায়িত্ব নেবে সুশাসনের।
কিন্তু ওই সুশাসন তো আপনা-আপনি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার নয়। শাসক শ্রেণী তো এটা কখনোই চাইবে না। কেননা এমনটা ঘটলে শাসক শ্রেণী বলে আলাদা কোনো শ্রেণীই থাকবে না; রাষ্ট্র তার ক্ষমতার অনেকটাই হারাবে এবং জনগণ নিজেই হবে নিজেদের শাসনকর্তা। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের অবসান ঘটবে, রাষ্ট্রীয় অপচয় চলে যাবে উৎপাদন বৃদ্ধির ধারাপ্রবাহে। শাসক শ্রেণী তাদের লুণ্ঠনের প্রতিযোগিতায় এখন যে নৈরাজ্য তৈরি করেছে এবং তাদের আদর্শ ও পৃষ্ঠপোষকতায় অনুপ্রাণিত এবং বলীয়ান হয়ে বেকার ও অর্ধবেকারের যেসব অপরাধমূলক কাজে ব্যস্ত হয়েছে তা মনে হবে দুঃস্বপ্নের স্মৃতি বৈ অন্য কিছু নয়। কিন্তু পরিবর্তনের এই কাজে প্রধান প্রতিবন্ধক হবে শাসক শ্রেণীই। তারা দেখবে সামাজিক বিপ্লব ঘটতে যাচ্ছে, তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য অত্যাবশ্যকীয় আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাটি ভেঙে পড়বে এবং তা দেখে তারা উন্মত্ত হয়ে উঠে সমাজ পরিবর্তনের ওই রাজনৈতিক প্রচেষ্টার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে; বলবে তোমরা আসলে দুঃশাসন চাও, এই দেখ আমরা প্রকৃত সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছি। আইনের শাসন কায়েমের স্বপ্নটাও প্রচার করা হয়ে থাকে। সেটাকেও মনে করা হয় সুশাসনের অংশ। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও প্রশ্ন উঠে একটি নয়, কয়েকটি। প্রথম প্রশ্ন, আইন কার স্বার্থ দেখে; দ্বিতীয় প্রশ্ন, আইন কীভাবে প্রয়োগ করা হয়; তৃতীয় প্রশ্ন, সাধারণ মানুষের জন্য ন্যায়বিচার পাওয়া কতটা সম্ভব। আইনের শাসন চাই এটা ভালো কথা, কিন্তু ওই যে অস্বস্তিকর প্রশ্নগুলোর জবাব কি?
প্রথম প্রশ্নের জবাব হলো এই যে, আইন স্বার্থ দেখে সম্পত্তিবানদের। ব্যক্তিগত সম্পত্তি রক্ষাই হচ্ছে বিদ্যমান আইন ব্যবস্থার প্রধান উদ্দেশ্য। ব্যক্তিগত সম্পত্তি রাষ্ট্রের সঙ্গে জড়িত। রাষ্ট্র শাসক শ্রেণীর স্বার্থ দেখে। তাই ওই শ্রেণীর সদস্যদের ভালো-মন্দ দেখাটাই আইনের দায়িত্ব। একটু আগে যে সামাজিক বিপ্লবের কথা উল্লেখ করছিলাম আইনের চোখে সে বিপ্লবের পক্ষে চেষ্টা করাটা হবে রাষ্ট্রদ্রোহিতা। তাই তার জন্য সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা আছে এবং থাকবে। আইনের শাসন বলে কথা। শাসন কাঠামোর ভেতরে আইনের প্রয়োগ, সে খুবই নিষ্ঠুর প্রক্রিয়া। যেমন পুলিশের কাজ। এ দেশে পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলা হয়েছিল ব্রিটিশ শাসকদের স্বার্থের পাহারা দেয়ার জন্য, আইন প্রয়োগের দায়িত্বও প্রকারান্তে দেয়া হয়েছিল তাদেরকেই।
ব্রিটিশ গেছে, পাকিস্তানিরা গেছে, কিন্তু পুলিশ বাহিনীকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার রীতি ও পদ্ধতিটা অবিকল রয়েছে; বরং আরো খারাপ হয়েছে।
সাধারণত মানুষ ন্যায়বিচার পাবে বিদ্যমান বাস্তবতায় এমনটা আশা করে না। আইনের শাসন ঠিকই চলছে, আদালত হচ্ছে, সেখানে গিয়ে নালিশ করা সম্ভব। কিন্তু আদালত তো অনেক দূরে। সেখানে যেতে হলে কোর্ট ফি লাগে এবং ফির তুলনায় বহুগুণ বেশি দরকার উকিল-ব্যারিস্টার, টাউট, মুহুরি, পেশকারদের দেয়ার মতো অর্থ। সাধারণ মানুষ এত টাকা পাবে কোথায়? ঘরবাড়ি বিক্রি-বন্ধক রেখে না হয় গেলই, হাজির হলো, কিন্তু প্রতিপক্ষ, যে পক্ষ অপরাধ করেছে, অপরাধ করার ক্ষমতা যে রাখে, তার টাকার জোর কম হওয়ার কথা নয়, বেশিই হবে। তার সঙ্গে এই বিচারপ্রার্থী পারবে কেন? আরো একটা ব্যাপার, এই যে উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার নেই এর ফলটা কী? ফলটা হলো আদালতকে আরো দূরে ঠেলে দেয়া। বিচারপ্রার্থী বোঝেই না কোন কোন যুক্তি নিয়ে তর্কবিতর্ক চলছে; বুঝলে সে সাহায্য করতে পারত এবং তার ভয়ও যেত কেটে। বিবাদীরও সেই একই দশা। বাংলা ব্যবহার না করাটা কিন্তু এই ফলের সঙ্গেই যুক্ত।
সংসদে সৎ ও যোগ্য লোক পাঠানো যাবে এমন প্রত্যাশা নির্দিষ্ট সময়ান্তে জাগে। এও একটা সুন্দর আশা বটে। বলা ভালো চমৎকার ও সুন্দর আশা।
সৎ লোক নির্বাচনের কথাটা জামায়াতে ইসলামী এক সময় খুব বড় গলায় বলত। একাত্তরে হানাদারদের সঙ্গে সহযোগিতা করে এ দেশের মানুষের সঙ্গে তারা যে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে সেই বেইমানিটাকে তারা মনে হয় অসৎ কাজ বলে মনে করেনি এবং তাদের আদর্শ হচ্ছে তালেবানরা, আফগানিস্তানে যারা সৎ মানুষের শাসন কায়েম করে সমাজ থেকে সভ্যতার সব আলোকে নির্বাসিত করার উদ্যোগ নিয়েছিল, মানুষকে ঠেলে দিচ্ছিল মধ্যযুগীয় অন্ধকারে, নারীকে আটক করেছিল ঘরের কোণে। জামায়াত এখন আর সৎ লোক চাই বলে না, তাদের মূল কাজটা হচ্ছে বিএনপির সঙ্গে আবার ক্ষমতায় যাওয়া। সৎ ও যোগ্য লোকদের নির্বাচিত করার ধ্বনিটা এখন জোরেশোরে পাওয়া যায় সুশীল সমাজের কণ্ঠ থেকে। এদের চোখে সৎ মানুষ মানে হচ্ছে তারা, যারা ঋণখেলাপি নয়, যাদের গায়ে দুর্বৃত্তপনার গন্ধ নেই। এই ধরনের লোক যদি দক্ষ হয়, তাহলে তো কথাই নেই। আর কিছু চাওয়ার থাকে না। কিন্তু এসব সৎ ও যোগ্য লোক যদি রাষ্ট্র ক্ষমতায় গিয়ে দেশের সম্পদ পাচার করে দেয়, তখন জনগণ কি করবেন তা নিয়ে সুশীলরা মাথা ঘামান না। কে জানে হয়তো বা ওই রকমের কাজকে তারা সমর্থনই করেন। আর যে ব্যবস্থার ওপর আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ দাঁড়িয়ে রয়েছে তাকে যে বদলানো দরকার এমন কথা শুনলে তো ওইসব সৎ ও যোগ্য লোক রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা রুজু করতে চাইবেন। না, সৎ ও যোগ্যদের দিয়ে জনগণের সুবিধা হবে না; বরং অসুবিধা হওয়ারই আশঙ্কা। কেননা সম্পদ পাচারই বলি, কি অন্যায় ব্যবস্থা রক্ষা করার দায়িত্ব পালনের বিষয়েই বলি, এসব কাজ তারা বরং অসৎ ও অযোগ্য লোকদের তুলনায় অধিক দক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতার সঙ্গেই সম্পন্ন করতে পারবেন। আসলে ব্যক্তির যোগ্যতার চেয়েও তার অঙ্গীকারটা কোন ধরনের জনগণের পক্ষে নাকি বিপক্ষে সে বিবেচনাটা রাজনীতিতে অধিক জরুরি। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যটা যদি হয় দেশের মানুষের স্বার্থের সঙ্গে শত্রুতা করা, তাহলে ব্যক্তির যত গুণই থাকুক না কেন, তাতে সমষ্টিগত স্বার্থের কোনো লাভ হবে না, ক্ষতি ছাড়া।
গণমাধ্যম স্বাধীন ও নিরপেক্ষ থাকবে এটাও একটা সুন্দর স্বপ্ন বটে, কিন্তু গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বলতে কি বুঝব? আমরা স্বাধীন গণমাধ্যম নয়, জনগণের পক্ষের গণমাধ্যম চাই। আর সে প্রসঙ্গেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, গণমাধ্যমের পক্ষে নিরপেক্ষতা বলে কোনো কিছু বজায় রাখা সম্ভব নয়।
লড়াইটা যেখানে প্রতিনিয়ত চলছে ন্যায়ের সঙ্গে অন্যায়ের, সেখানে ন্যায়ই হচ্ছে দুর্বল পক্ষ এবং সেই পরিস্থিতিতে আমি কোনো পক্ষেরই নই, আমি নিরপেক্ষ বলার অর্থ দাঁড়ায় অন্যায়কে সমর্থন করা। না, আমরা নিরপেক্ষতা চাই না, এটা চাই যে গণমাধ্যম পক্ষে থাকবে জনগণের। আধুনিক হওয়া দরকার-এই রবটাও আছে বৈকি! আধুনিকতা জিনিসটা কি? আওয়াজদাতারা বলবে সেটা হচ্ছে পুজিবাদী বিশ্বের অনুকরণ করা। তা অনুকরণ তো চলছেই। দেশে একটা পরশ্রমজীবী ও উৎপাদনবিমুখ, স্বদেশে থেকে পরবাসী গোষ্ঠী তো তৈরি হয়েছেই; এর আয়তন বাড়বে। কিন্তু সারাদেশে যদি এমন আধুনিকে ছেয়ে যায়, তাহলে সত্যিকারের আধুনিক মানুষ পাওয়া তো কঠিন হবে। সেই মানুষই তো আধুনিক, যার দৃষ্টিভঙ্গিতে আছে আন্তর্জাতিকতা, কিন্তু যে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে নিজের ভূমিতে-যে ভূমি তার চারপাশের জনজীবন, ইতিহাস, ঐতিহ্য, মাটি, প্রকৃতি, সব কিছু মিলে গঠিত। পুঁজিবাদী হওয়ার আধুনিকতা অনেক পাওয়া গেছে, আমাদের জন্য প্রয়োজন দেশপ্রেমিক মানুষ হওয়া।
বলছিলাম অন্যায়ের কথা।
চারদিকে অন্যায়। আমরা যেন অন্যায়ের ভেতর টিকে আছি। এই অন্যায়টাকে চিহ্নিত করব কি দিয়ে? সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উপায়টা হচ্ছে এটা বুঝে নেয়া যে, আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজের প্রধান সত্যটা হলো বৈষম্য এবং বৈষম্যই হলো নিজে সবচেয়ে বড় অন্যায় এবং অন্য নানা অন্যায়ের উৎস। এখানে পুরনো একটা প্রশ্ন আবার নতুন করে জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে অন্যায়ের ব্যাপারটা বোঝার জন্য। প্রশ্নটা হলো পাকিস্তান নামে ওই যে দুর্দণ্ড প্রতাপ রাষ্ট্র ওটি ভাঙল কেন? ভাঙার অন্যান্য কারণ অবশ্যই ছিল, কিন্তু মূল কারণটা অন্য কিছু নয়, সেটা হলো বৈষম্য। অভাব ছিল; কিন্তু অভাব এতটা দুঃসহ হতো না, যদি বৈষম্য না থাকত। যদি দেখা যেত সবাই সমানভাবে কষ্ট পাচ্ছে এবং ঐক্যবদ্ধভাবে চেষ্টা করছে অভাব দূর করতে। কিন্তু তেমনটা ঘটেনি, দেখা গেছে পূর্ববঙ্গকে শ্মশানে পরিণত করে পশ্চিম পাকিস্তান স্ফীত হচ্ছে। এটা ছিল অসহ্য। যে জন্য পূর্ববঙ্গের মানুষ প্রথমে প্রতিবাদ এবং পরে বিদ্রোহ করেছে। আশা ছিল যে, বাংলাদেশে আর যাই থাক বৈষম্য থাকবে না। সবাই ঐক্যবদ্ধ হবে এবং অভাবকে পরাভূত করবে। সেটাই ছিল স্বপ্ন; সবচেয়ে বড় এবং সর্বাধিক সুন্দর সমষ্টিগত স্বপ্ন। মানুষ কেবল হানাদারকে হটাতে চায়নি, বৈষম্যের অন্যায়কেও নিশ্চিহ্ন করা যাবে বলে ভরসা করেছে। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটল না। বড় স্বপ্নটা পরাভূত হলো।
শাসক ও শাসিত ভাগ হয়ে গেল। নতুন শাসকরাও আগের শাসকদের মতোই ভুলতে থাকল শাসিতদের শুকিয়ে মেরে। শাসক শ্রেণী সব সময় তাই নানা ধরনের স্বপ্ন ফেরি করে বেড়ায়; মূল স্বপ্নটাকে আড়ালে ঢাকার জন্য। সে স্বপ্নের ব্যাপারটাকে লোকে যাতে ভুলে যায়, তেমন বিভ্রান্তি সৃষ্টির আগ্রহটাও থাকে সঙ্গে। কিন্তু জীবন তো আছে। জীবন থাকলে মুক্তি যে কামনা সেটাও থাকবে। শাসক ও শাসিতের দ্বন্দ্বটা চলছে। যেমন চলেছিল আগে ব্রিটিশ যুগে, পাকিস্তানের কালে। শাসকের স্বপ্ন আর শাসিতের স্বপ্ন এক নয়, হতে পারে না। বৈষম্য যত বাড়ছে দুই স্বপ্নের দূরত্ব এবং বিরোধটা ততই তীব্র হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত কে জিতবে? শাসক, না শাসিত? শাসিতেরই জেতার কথা, কেননা তারা সংখ্যায় অনেক এবং তাদের ভেতরে বিক্ষোভটা ক্রমবর্ধমান এবং মানুষের পক্ষে অসম্ভব বলে কিছু নেই। তবে প্রশ্নটা থাকবে এ লড়াইয়ে আমরা কে কোন পক্ষে? এই প্রশ্নটা একাত্তরে ছিল, আজো রয়েছে। কারণ লড়াইটা শেষ হয়নি।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক
( মানব কণ্ঠ )
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন