এই অসবর্ণ বিয়ে কি বর্ণবাদের প্রতি কোনো বার্তা দিল?
21 May 2018, Monday
লন্ডনে বসবাস এবং দীর্ঘজীবন লাভের জন্য আমার এক জীবনেই দুটি ঐতিহাসিক রাজকীয় বিয়ে, একটির ট্রাজিক পরিণতি এবং বর্তমান বিয়েটির মহা আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠান দেখে গেলাম। রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের নাতি এবং প্রিন্স চার্লস ও ডায়ানার পুত্র প্রিন্স হ্যারির বিয়ে হল। গত শনিবার (১৯ মে) মিশ্র বর্ণের সাধারণ ঘরের মেয়ে মেগান মার্কেলের সঙ্গে। মেগান আমেরিকায় আফ্রিকান-আমেরিকান পরিবারের ডিভোর্সি কন্যা এবং কিছুকাল ছিলেন অভিনেত্রী। এ বিয়েতে ব্রিটেনের পড়ন্ত অর্থনৈতিক অবস্থাতেও বত্রিশ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ করা হয়েছে। অতিথিরা এসেছিলেন সারা বিশ্ব থেকে, হ্যারি-মেগানের প্রেমের কথা জানাজানি হতেই ব্রিটিশ মিডিয়া তাকে প্রায় রূপকথায় পরিণত করেছিল। প্রিন্সেস ডায়ানার মতো অত রূপসী না হওয়া সত্ত্বেও মেগান প্রায় তারই মতো পাবলিসিটি পেয়েছেন।
রাজপরিবারের সবাই এ বিয়েতে সম্মতি দিয়েছেন, উল্লসিত হয়েছেন। রানী এ বিয়েতে আগাম অনুমোদন দিয়েছেন। মেগানের বাবা হার্ট অপারেশনের দরুন এ বিয়েতে আসতে পারেননি। তবে তার মা ডোরিয়া রোগল্যান্ড এসেছেন এবং রানীর সঙ্গে প্রথমেই চা-চক্রে মিলিত হয়েছেন। মেগানের বাবার অনুপস্থিতিতে কন্যা সম্প্রদানের কাজটি করেছেন প্রিন্স চার্লস। চার্লস-ডায়ানার এবং হ্যারি ও মেগানের বিয়েকে ঐতিহাসিক বললাম এই কারণে যে, ব্রিটিশ রাজপরিবারের যে ট্র্যাডিশন ছিল অন্য দেশের রাজপরিবার থেকে বধূ সংগ্রহ করা, যেমন রানী ভিক্টোরিয়া এসেছিলেন জার্মান পরিবার থেকে, চার্লস-ডায়ানার বিয়েতে সেই ট্র্যাডিশন ভেঙে যায়। ডায়ানা অভিজাত পরিবারের মেয়ে হলেও কোনো রাজপরিবারের মেয়ে ছিলেন না।
গত শনিবারের হ্যারি-মেগান বিয়ে আরও ঐতিহাসিক। মেগান অতি সাধারণ ঘরের এবং আফ্রিকান-আমেরিকান পরিবারের মেয়ে। বাকিংহাম প্যালেসে কোনো সাধারণ ঘরের মিশ্র বর্ণের মেয়ে ঢুকবে এটা কয়েক বছর আগেও কল্পনা করা যায়নি। এখন ব্রিটিশ রাজপরিবারের শতাব্দীপ্রাচীন কঠিন আভিজাত্যের বেড়া ভেঙে গেল। এ বিয়ের আরও দুটি বৈশিষ্ট্য আছে। যুগের পরিবর্তন ব্রিটিশ মনার্কি অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বুঝতে পেরেছেন যে বিশ্বে রাজতন্ত্রের যুগ শেষ হয়ে এসেছে। এখন যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আভিজাত্যের দুর্গ থেকে সাধারণ মানুষের স্তরে নেমে না এলে এই রাজতন্ত্র টিকবে না। তাই রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ আগের মনোভাব পাল্টে হ্যারি-মেগানের বিয়েতে সহজেই সম্মতি ও আশীর্বাদ দিয়েছেন এবং মেগানের অশ্বেতাঙ্গ মায়ের আত্মিয়তা মেনে তাকে বাকিংহাম প্যালেসে স্বাগত জানিয়েছেন।
হ্যারি-মেগানের এ বিয়ের আরও একটি বৈশিষ্ট্য আছে। সেটি রাজনৈতিক। ব্রেক্সিটকে কেন্দ্র করে ব্রিটেনের মানুষ এখন দ্বিধাবিভক্ত। থেরেসা মে’র সরকার অনৈক্য-জর্জরিত এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে বিরোধ ব্রিটেনের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে অস্থিরতা সৃষ্টির আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে। ব্রিটেনের এ বিপন্ন মুহূর্তে হ্যারি-মেগানের বিয়ে এক বিরাট ডাইভার্সনের কাজ করেছে। মিডিয়াগুলো হ্যারি-মেগানের প্রেম ও বিয়েকে প্রায় রূপকথার কাহিনীতে পরিণত করেছে। ব্রিটেনের মানুষ এ রূপকথায় উল্লসিত হয়ে আপাতত বিরোধ ও অনৈক্য ভুলে বিয়ের উৎসবে শামিল ও ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। এটা ব্রিটিশ রাজনীতির অচলাবস্থা দূর করবে বলে অনেকেই আশা করছেন। তা যদি হয়, হ্যারি-মেগানের এই প্রেম ও পরিণয় ব্রিটেনের জনগণের জন্য এক মহাকল্যাণকর ভূমিকা পালনের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বিশ্বের অধিকাংশ মানুষের কামনা হ্যারি-মেগানের বিয়ে স্থায়ী হোক এবং ব্রিটিশ জনগণের জন্য স্থায়ী কল্যাণ বহন করুক।
আমার সব কথার শেষ কথা, হ্যারি-মেগানের এ বিয়ে ব্রিটিশ রাজপরিবারের জন্য ইতিহাসের একটি কঠিন প্রতিশোধ। বেশিদিন আগের কথা নয়। গত শতকের মধ্যভাগের কথা। সম্রাট পঞ্চম জর্জের মৃত্যুর পর তার জ্যেষ্ঠ পুত্র ডিউক অব উইন্ডময় সম্রাট অষ্টম এডওয়ার্ড নাম ধারণ করে সিংহাসনে বসেছিলেন। তিনি সিমসন নামের এক মার্কিন ডিভোর্সি মহিলার প্রেমে পড়ে তাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়ায় রাজপরিবার, এমনকি পার্লামেন্টের চাপে সিংহাসন ত্যাগ করতে হয় তাকে। তাকে সারাজীবন বিদেশে নির্বাসিত জীবনযাপন করতে হয়েছিল। তাকে সিংহাসন থেকে সরিয়ে তার ছোট ভাই ডিউক অব ইয়র্ককে সম্রাট ষষ্ঠ জর্জ নামে (বর্তমান রানীর পিতা) সিংহাসনে বসানো হয়েছিল।
ইতিহাসের কী প্রতিশোধ! সিমসনের অপরাধ ছিল তিনি সাধারণ মার্কিন পরিবারের মেয়ে ছিলেন এবং তার প্রথম বিয়ে টেকেনি। এখন এ শতকের প্রথমার্ধেই মেগান নামে যে তরুণী বধূ হিসেবে ব্রিটিশ রাজপরিবারে ঢুকলেন, তিনি আমেরিকার আফ্রিকান-আমেরিকান অতি সাধারণ ঘরের মেয়ে এবং ডিভোর্সি। রাজপরিবারের বধূ হিসেবে রানীকে কোলে টেনে নিতে হচ্ছে এই মিশ্রবর্ণের তরুণীকেই। এ ঘটনায় ইতিহাস কি মুখ লুকিয়ে হাসছে না?
দ্বিতীয় ঘটনাটি অল্পদিন আগের। রানীর ছোটবোন প্রিন্সেস মার্গারেট ক্যাপটেন টাউনসেন্ড নামে এক যুবকের প্রেমে পড়েছিলেন। তিনি ছিলেন প্যালেসের অশ্বশালার এক কর্মচারী এবং তালাকপ্রাপ্ত স্বামী। তরুণী মার্গারেট তারই প্রেমে পড়ে তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। অনেক আকুতি-মিনতি সত্ত্বেও রানী এবং পার্লামেন্ট এ বিয়েতে সম্মতি দেননি। মার্গারেটের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসে। শেষ পর্যন্ত এক ফটোগ্রাফারের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। রাজপরিবার তাকে লর্ড খেতাব দিয়ে জাতে তোলেন। এ বিয়েও টেকেনি। মার্গারেট কিছুকাল উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন করে অকালে মৃত্যুবরণ করেন। এ কারণেই বলছি, হ্যারি-মেগানের বিয়ে ব্রিটেনের জনগণের জন্য কল্যাণকর এবং রাজপরিবারের জন্যও কল্যাণকর। কিন্তু এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ইতিহাসের প্রতিশোধ গ্রহণও।
একুশ শতকের সবচেয়ে বড় ঘটনা আমেরিকার হোয়াইট হাউসে কালো প্রেসিডেন্টের দুই মেয়াদে অবস্থান এবং ব্রিটেনের রাজপরিবারের অসবর্ণ বিয়ে এবং মিশ্রবর্ণের সাধারণ ঘরের তরুণীর রাজকুমারী হয়ে প্রবেশ। তাতে কি বিশ্বে বর্ণবিদ্বেষ ও জাতিবিদ্বেষ হ্রাস পাবে এবং বিশ্বে সব বর্ণের মানুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা পাবে? আমেরিকার আফ্রিকান-আমেরিকান সম্প্রদায়ের অধিকাংশ মানুষ এমনটা আশা করেন না। তারা মনে করেন, বারাক ওবামার প্রেসিডেন্ট হওয়া এবং মেগানের ব্রিটিশ রাজপরিবারে প্রবেশ যুগান্তকারী ঘটনা বটে, কিন্তু তাতে বিশ্বব্যাপী বর্ণবিদ্বেষ ও জাতি-বিরোধ এখনই হ্রাস পাবে না।
ওবামার মতো একজন কালো বর্ণের মানুষকে দেশের প্রেসিডেন্ট করার প্রায়শ্চিত্ত শুরু করেছে মার্কিন শ্বেতাঙ্গ সমাজের এক বিরাট অংশ ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো এক চরম প্রতিক্রিয়াশীল, বর্ণবিদ্বেষী এবং ইগোইস্টিক শ্বেতাঙ্গকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে। ক্ষমতায় বসেই তিনি ওবামার সব ভালো কাজ বাতিল করার নীতি গ্রহণ করেছেন। ওবামা ইরানের সঙ্গে যে পরমাণু চুক্তি করেছিলেন, তা থেকে বেরিয়ে এসেছেন। প্যালেস্টাইনের মানুষকে বর্বরতম পন্থায় হত্যা করার জন্য ইসরাইলকে লেলিয়ে দিয়েছেন। বিশ্বে অশান্তি সৃষ্টির সর্বনাশা পদক্ষেপ নিয়েছেন।
ব্রিটেনের অধিকাংশ মানুষ আমেরিকার শ্বেতাঙ্গদের এক বিরাট অংশের মতো মাত্রাহীন বর্ণবিদ্বেষী নয়। ব্রিটিশ রাজপরিবার নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা এবং যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য বাকিংহাম প্যালেসে মিশ্রবর্ণের বধূ গ্রহণ করেছেন। ব্রিটিশ সরকারে পাকিস্তানের বাস ড্রাইভারের ছেলে এখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। লন্ডনের মেয়রও এখন পাকিস্তানের বাস ড্রাইভারের এক ছেলে। তাতে মনে হয় ব্রিটেন ট্রাম্পের বর্ণবিদ্বেষ ও জাতিবিদ্বেষের বিপরীত দিকে যাত্রা শুরু করেছে। তাতে বিশ্বময় বর্ণবিদ্বেষ ও জাতিবিদ্বেষের প্রাবল্য এখনই শেষ হবে, তা যে আশা করা যায় না সে কথা আগেই বলেছি। কিন্তু এ পরিবর্তনের হাওয়া যে ধীরে ধীরে মানবতাকে সব বিরোধ ও বিদ্বেষমুক্ত করবে এটা আশা করা যায়।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় স্বাধীনতার জন্য ভারতীয় উপমহাদেশ যখন অশান্ত হয়ে ওঠে, তখন সে সময়ের ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল দম্ভ করে বলেছিলেন, ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে নিলামে তোলার জন্য আমি প্রধানমন্ত্রী হইনি।’ তিনি মহাত্মা গান্ধীকে অভিহিত করেছিলেন ন্যাংটা ফকির নামে। সেই চার্চিলকে তার জীবদ্দশাতেই উপমহাদেশের স্বাধীনতা দেখে যেতে হয়েছে এবং যে গান্ধীকে ব্রিটিশ কারাগারে দীর্ঘকাল বন্দি জীবনযাপন করতে হয়েছে, ব্রিটিশ রানীকে তার সমাধিতে গিয়ে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিতে হয়েছে।
ইতিহাসের প্রতিশোধ বড় ভয়ানক। এ প্রতিশোধেরও একটা কল্যাণকর দিক আছে। এ কল্যাণকর দিকটির জন্যই হ্যারি-মেগান বিয়ে সম্ভব হয়েছে। অর্থাৎ অসম্ভব সম্ভব হয়েছে। ব্রিটেনের এ বর্ণসমতার ধারা একদিন সারা ইউরোপে ছড়াবে এবং আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ সমাজের এক বড় অংশকে প্রভাবিত করবে, ট্রাম্পের চণ্ডনীতি প্রতিহত হবে সেই শুভ দিনের আশা করা যায়। তবে দিনটি খুব কাছের নয়। সেজন্য সামনে রয়েছে আরও বিরোধ এবং আরও অশান্তি।
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন