তরুণ প্রজন্মের কাছ থেকেই নেতৃত্ব আসতে হবে
03 December 2019, Tuesday
আমাদের তরুণদের ভবিষ্যৎকে উজ্জ্বল করার কাজটি তাদের নিজেদেরই করতে হবে এবং ভুলে যেতে হবে ব্যর্থ নেতৃত্বের দিকে ফিরে তাকানোর অভ্যাস। বিগত দিনের নেতারা বর্তমান তরুণ প্রজন্মের অপূরণীয় ক্ষতি করেছেন। তরুণরা যখন সামনে তাকাচ্ছে তখন তারা কোনো আশাপ্রদ ও নিরাপদ ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে না।
আমাদের শিক্ষিত তরুণদের একথা জানা উচিত, রাজনীতি হচ্ছে শাসন করার বুদ্ধিমত্তার আলোকিত প্রক্রিয়া। সেখানে ব্যক্তির খেয়াল-খুশির কোনো জায়গা নেই। রাজনীতি বলতে কী বোঝায়, সে সম্পর্কে দার্শনিক প্লেটো থেকে শুরু করে রুশো এবং আরও অনেকের শিক্ষাই আমরা লাভ করেছি।
দুর্বৃত্তপনা, প্রতারণা, দুর্নীতি তথা জনগণের অর্থ লুটপাট করাকে রাজনীতি বলে না। একজন রাজনৈতিক নেতার যেমন গভীর জ্ঞান থাকতে হয়, তেমনি থাকতে হয় জনগণের প্রতি প্রবল দায়িত্ববোধ।
গণতন্ত্র ধ্বংসের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া জনজীবনের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে তার ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেনি। নীতিহীন বিভক্তিকরণের রাজনীতির কর্মী হওয়ার ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কিংবা শিক্ষকদের কোনো প্রকার দ্বিধা বা অনীহা দেখা যায়নি।
সবচেয়ে জঘন্য ব্যাপার হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকার পরও ছাত্রনেতারা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘টর্চার সেল’ গড়ে তুলতে পেরেছে। এর ফলে অচিন্তনীয় ক্ষতি হয়েছে উচ্চশিক্ষার।
ছাত্র-শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সবসময় বিরাজ করছে বিরোধ-বিদ্বেষের পরিবেশ, যা মোটেও লেখাপড়ার অনুকূল নয়। একে দেশের কিংবা ছাত্রদের ভবিষ্যতের জন্য শুভ ও সুস্থ রাজনীতি বলা যায় না।
যারা বিত্তবান হওয়ার ব্যবসাকে রাজনীতি হিসেবে দেখেন তারা আসলে সুন্দর সমাজের জন্য যা কিছু শুভ ও কল্যাণকর তার সবকিছুরই শত্রু। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের দলীয় রাজনীতির সংস্পর্শ পরিত্যাগ করা উচিত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের করতে হবে জ্ঞানভিত্তিক রাজনীতির অনুশীলন। তারা দেশ শাসনের বিজ্ঞান হিসেবে জানবে দলীয় রাজনীতিকে। গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র সুশাসনের যে কাঠামো দিয়েছে তাকে উপলব্ধি করতে হবে তাদের। রাজনীতি হোক আর দেশ শাসন হোক, এর কোনোটাই ব্যক্তিগত ব্যাপার নয়।
নবীন বাংলাদেশে অনভিজ্ঞ নেতৃত্বের কারণে রাজনীতির লক্ষ্য-উদ্দেশ্যই বদলে গেছে। রাজনীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রধানত প্রতারণা এবং ব্যক্তিস্বার্থে জনগণের অর্থ লুটপাট করা। আমাদের চলমান লোভ-লালসার রাজনীতিতে নীতি-চরিত্রের কোনো বালাই নেই। যাদের আত্মসম্মানবোধ আছে তাদের কাছে এ অবস্থা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
আমরা যারা বিদায়ী প্রজন্ম তারা দুঃখ-বেদনার সঙ্গে এ উপলব্ধিতে উপনীত হয়েছি যে, গণতান্ত্রিক পথে পুলিশি শক্তিনির্ভর রাজনীতির পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। যারা এখন ক্ষমতায় সমাসীন রয়েছেন তারা বিরোধী দলকে এই বলে উপহাস করে থাকেন যে, তারা রাস্তায় যথেষ্ট শক্তি প্রদর্শনে সক্ষম হচ্ছে না।
অথচ হাজার হাজার রাজনৈতিক নেতাকর্মী কারাগারে বন্দি জীবনযাপন করছেন এবং তাদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার পুলিশি মামলা রয়েছে। সেজন্য কাউকে বিব্রতবোধ করতে হচ্ছে না।
জনগণের সরকারের ক্ষমতায় থাকার বৈধ ভিত্তি হচ্ছে জনসমর্থন, এ সত্যকে স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে স্বীকার করতে হবে। আমাদের পুলিশকে আমাদের পুলিশ হয়ে থাকতে হবে। আমাদের পাবলিক সার্ভেন্টদের দায়িত্ব হচ্ছে দেশের নর-নারী নির্বিশেষে সবাইকে সেবা করা।
সশস্ত্র বাহিনীকে প্রশ্নাতীতভাবে জনগণের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে হবে। রাজনৈতিক বিভক্তি তাদের স্পর্শ করতে পারবে না, বিপদের মুহূর্তে যাতে তাদের ওপর সবচেয়ে বেশি আশা ও ভরসা করা যায়।
স্বাধীনতার জন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধকে জনগণের মুক্তিযুদ্ধে রূপদান করতে হবে। এ সত্য সম্পর্কে যারা উদাসীন তাদের মুক্তিযোদ্ধা বলা যাবে না। নতুন প্রজন্ম হবে স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার মুক্তিযোদ্ধা।
আমরা যে পরিবর্তন প্রত্যাশা করি তা যে শান্তিপূর্ণ পথে, সংলাপ ও বিতর্কের মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব নয়, সেটা হংকংয়ের প্রতিবাদী তরুণরা নিশ্চিত করেছে। তারা চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে নির্দয় হস্তক্ষেপের আশঙ্কা ও ভীতি থাকা সত্ত্বেও নিজেদের ভবিষ্যৎকে নিজেদের হাতে তুলে নেয়ার বলিষ্ঠ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
হংকংয়ের গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা ও স্বকীয়তা রক্ষার জন্য তারা সামনে এগিয়ে গিয়েছে; পেছনে ফিরে তাকায়নি কিংবা অগ্রজদের নেতৃত্বের জন্য অপেক্ষা করেনি।
মূল চীনের পক্ষ থেকে মারাত্মক হুমকিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে হাজার হাজার প্রতিবাদী তরুণ হংকং সিটি সেন্টারে সমবেত হয়। তরুণদের উত্থানের প্রাথমিক কারণ হিসেবে কাজ করে চীন সরকারের বলপ্রয়োগের হুমকি প্রদর্শন এবং তার বিরুদ্ধে জনগণের অসন্তোষ। তারা পলিটেকনিক বিশ্ববিদ্যালয়কে দুর্গ করে তোলে।
হংকংয়ের ওপর প্রবলতর ক্ষমতা প্রয়োগ করার চৈনিক প্রতিজ্ঞাকে প্রতিহত করে দেয় তরুণ প্রতিবাদীরা, যাদের বেশিরভাগ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। পুলিশের আক্রমণাত্মক হামলা তারাই প্রতিহত করে। শেষ পর্যায়ে তারা দুটি ক্যাম্পাসে ব্যারিকেড তৈরি করে অবস্থান গ্রহণ করে। তাদের অধিকাংশকে জেলে ঢুকানো হয়েছে।
পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় তাদের একজন নিহত হয়; কিন্তু তরুণরা কখনও ছাড় দেয়নি কিংবা আন্দোলন থেকে সরে পড়েনি। এটাই নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমের শক্তি। তারা ছিল তাদের জনগণের শ্রেষ্ঠ সন্তান।
হংকংয়ে যেসব সরকারি কর্মকর্তা ক্ষমতার অপব্যবহার করতে গিয়ে মানবাধিকার লংঘন করেছে, তাদের ওপর বিধিনিষেধ জারির জন্য চলতি সপ্তাহে আমেরিকার কংগ্রেস প্রায় সর্বসম্মতিক্রমে একটি বিল পাস করেছে এবং তরুণদের উত্থানকে সমর্থন জানিয়েছে।
পরবর্তী পর্যায়ে প্রতিবাদী তরুণরা স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে গণতান্ত্রিক লক্ষ্যগুলোর জন্য নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করেছে। হংকং সরকারকে ধন্যবাদ যে তারা পুলিশ ব্যবহার করে নির্বাচনী বিজয় ছিনিয়ে নেয়নি।
বাংলাদেশের সংকট আরও খারাপ। এখানে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকেজো করে ফেলা হয়েছে। ব্যাংকসহ সম্পূর্ণ অর্থনীতি বিধ্বস্ত। সাধারণ মানুষের জীবনে দুর্দশার সীমা নেই। নানা ধরনের হয়রানি তো রয়েছেই। ক্ষমতাসীনরা ছাড়া অন্য কারও যেন বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। জীবনের কোনো মূল্য নেই। আমরা সবাই ক্ষমতাসীনদের কাছে অসহায়।
ভোটের নির্বাচন অস্বীকার করে বর্তমান সরকার বলেই দিয়েছে, জনগণের প্রতি তাদের দায়বব্ধতা নেই। সর্বত্রই বিরাজ করছে ভয়ভীতি। গণতন্ত্রের জন্য সুদীর্ঘ সংগ্রাম করা সত্ত্বেও জনগণ পুলিশি মামলার ভয়ে সন্ত্রস্ত, তারা আইনের শাসনের নিরাপত্তা ভোগ করতে পারছে না।
স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার জন্য আমাদের তরুণ প্রজন্মকে এ ভয়কে জয় করতে হবে। দুর্নীতির মহামারী কিংবা অযোগ্যতা ও অব্যবস্থাপনার সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া মোটেও সহজ ব্যাপার নয়। দুর্নীতি সব মানবিক মূল্যবোধকে শেষ করে দেয়।
কিন্তু তাই বলে আমরা আমাদের নতুন প্রজন্মকে ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার কর্তব্য থেকে সরে থাকতে বলতে পারি না। যেহেতু কোনো কার্যকর সরকারের অস্তিত্ব নেই, সেহেতু বিশৃঙ্খল অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার জন্য অপেক্ষা করার কথা বলা অর্থহীন।
নেতৃত্বের ক্ষেত্রে যে শূন্যতা বিরাজ করছে তা পূরণ করতে এগিয়ে আসতে হবে নতুন প্রজন্মকে। যদি তারা বর্তমানকে রূপদান না করতে পারে তাহলে তাদের এবং এ দেশের ভবিষ্যৎ সুন্দর হবে না।
তরুণদের উপলব্ধি করতে হবে, তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের বিরাট আশা ধ্বংস হতে বসেছে। তাই তাদের তারুণ্যের শক্তি ও উদ্দীপনাকে ব্যবহার করতে হবে রাজনীতিতে সম্মান ও মর্যাদাবোধ এবং নিঃস্বার্থ জনসেবার আদর্শ ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে।
আমাদের ছেলেমেয়েদের জন্য সুন্দর ও নিরাপদ ভবিষ্যৎ নির্মাণের ভিত্তি স্থাপন করার ব্যাপারে আমরা সবাই যে উদাসীন ছিলাম তা নয়। তবুও স্বীকার করতে হবে, আমাদের মধ্যে গোলামির মানসিকতা দৃঢ়মূল থাকার কারণে অনেকের সাহসী ভূমিকাও ব্যর্থ হয়েছে।
আমাদের শিক্ষিত লোকদের সুবিধাবাদী মনোভাবও উপেক্ষা করার মতো নয়। তরুণদের অবশ্যই মর্যাদাবোধের অধিকারী হতে হবে। মর্যাদাবোধের অভাব আমাদের জাতীয় সমস্যা।
বর্তমানের নায়ক নতুন প্রজন্ম, ভবিষ্যতের নির্মাতাও হবেন তারা। তাই তাদের জেগে উঠতে হবে, নেতৃত্ব দিতে হবে। স্বপ্নকে সার্থক করতে এগিয়ে আসতে হবে। দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির মধ্যে কোনো মর্যাদাবান জাতি বেঁচে থাকতে পারে না।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন : আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন