ভালোরা দুর্বল আর দুর্নীতিবাজরা ক্ষমতাবান ভাঙতে হবে এ ধারণা
05 May 2018, Saturday
আজ আমাদের একথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করতে হবে যে মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার অব্যবহিত পর ১৯৭২ সালে জনগণ প্রদত্ত গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রে মূর্ত হয়ে ফুটে উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন হচ্ছে না। বরং বাংলাদেশ স্বৈরতন্ত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষার উর্বর ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে চরম অগণতান্ত্রিকভাবে দলীয় নেতারা দেবতার মতো পূজা পাচ্ছেন, তাদের বদলানো যাবে না। নেতৃত্বের ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক পরিবর্তনকে দেখা হচ্ছে বিরাজনীতিকরণ হিসেবে। আমরা মোটের ওপর সবাই নেতাপূজা মেনে নিয়েছি, এমনকি উৎসাহ দিয়েছি; কিন্তু স্থায়ী নেতৃত্ব যে স্বৈরতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য সেকথা ভুলে গেছি।
আমাদের জনগণ কী ধরনের সমাজ সংগঠন করতে চায়, কোন ধরনের সরকার চায় তার রূপকল্প হচ্ছে আমাদের গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র; কিন্তু আজ অত্যন্ত হতাশা ও বেদনা ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আমাদের সেই শাসনতন্ত্রের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ধ্বংস প্রক্রিয়া দেখতে হচ্ছে। গণতান্ত্রিক সরকারের ভারসাম্যমূলক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা নিয়েই দাপটের সঙ্গে একের পর এক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পঙ্গু ও অকেজো করা হচ্ছে। ঘড়ির কাঁটাকে পেছনে ঘোরানো হচ্ছে, এমন ভারসাম্যহীন স্বৈরতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন এদেশের জনগণ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। বিচার বিভাগ যেহেতু আমাদের মৌলিক অধিকারের রক্ষক, তাই তার স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা হচ্ছে; তার অস্তিত্ব বিনাশ করা হচ্ছে। আমরা নির্বাচনের নামে এক অদ্ভুত সংসদ এবং আরও অদ্ভুত এক বিরোধী দল পেয়েছি। সরকারের সৃষ্ট এবং সরকারের অনুগত থাকার দলই এখন বিরোধী দল। আমাদের ঘাড়ে এমন এক নির্বাচনী ইঞ্জিনিয়ারিং কাঠামো চাপানো হয়েছে যার মাধ্যমে নির্বাচনী ফলাফল পূর্বনির্ধারিত থাকছে।
দেশটি যে বিপজ্জনক একদলীয় স্বৈরশাসনের দিকে ধাবিত হচ্ছে সেটা কেবল আমাদের কাছেই পরিষ্কার নয়, বাইরের দুনিয়ার কাছেও স্পষ্ট।
জাতীয় নির্বাচনে কে অংশ নেবে এবং কে অংশ নেবে না তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার বিরোধ হিসেবে বিষয়টিকে দেখার কোনো সুযোগ নেই। জাতীয় নির্বাচন হচ্ছে স্বাধীন জনগণকে স্বাধীনভাবে নিজেদের সরকার নির্বাচন করতে দেয়ার অধিকার। দেশটা আমাদের অথচ সরকার হবে অন্যদের, এ রকম পরিস্থিতির মধ্যে জীবন ধারণ করার চেয়ে অপমানজনক আর কিছুই থাকতে পারে না। তাই শাসনতন্ত্র নির্দেশিত জনগণের কাছে দায়বদ্ধ শাসন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে জনগণের দাবি হিসেবে অবাধ নির্বাচনের দাবি তোলা হচ্ছে।
সংসদীয় শাসনতন্ত্রের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের বিষয়টি সবার কাছে স্পষ্ট এবং সেভাবেই সর্বত্র সংরক্ষিত রয়েছে। বলা হয়েছে নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দিয়ে সংসদীয় আসনগুলোকে শূন্য ঘোষণা করতে হবে। আর সংসদ ভেঙে দেয়ার পর নির্বাচিত সরকার বলতে কিছু থাকে না, তাই যিনিই রাষ্ট্রপ্রধান থাকবেন, তিনি সংসদ ভেঙে দেয়ার ঘোষণা প্রদানকালে প্রধানমন্ত্রীকে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে বলবেন। বিরোধী দলের তার ওপর আস্থা থাকে বলেই সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনকালীন সরকারের দায়িত্ব পালনে কারও আপত্তি থাকে না।
ভোটাধিকার প্রয়োগ করে জনগণকে তাদের পছন্দমতো সরকার নির্বাচনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে আর একটি রাবার স্ট্যাম্প নির্বাচন অনুষ্ঠানের চেষ্টা করা হলে তা অবশ্যই মারাত্মক হিংসা ও নৈরাজ্য সৃষ্টিতে প্রণোদনা হিসেবে কাজ করবে। তখন অগণতান্ত্রিক শক্তির হাতে বন্দি নির্বাচনী ব্যবস্থাকে মুক্ত করার আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হবে। জনগণ বড় বেশি ক্ষুব্ধ।
স্বৈরশাসনের ফলে সৃষ্ট অব্যবস্থাপনার কথা বলে শেষ করা যাবে না। আমার সঙ্গে এ প্রশ্নে কেউ যদি দ্বিমত পোষণ করেন, তবে আমি তার সঙ্গে ঝগড়া করতে যাব না; কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি সরকার দ্রুত অচল হয়ে পড়ছে। চারদিকে আমি কেবল পুলিশকেই সক্রিয় দেখতে
পাচ্ছি। জাতি হিসেবে আমাদের প্রাণশক্তি ও যা কিছু ভালো এবং মহৎ গুণাবলি ছিল তা শ্বাসরোধী স্বৈরশাসন
নিঃশেষ করে দিচ্ছে।
ভয়ভীতি ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বসবাস করাকে স্বাধীনতা কিংবা সুশাসন বলা যাবে না। স্বাধীন দেশে অবাধ নির্বাচন হতে না দেয়ার অর্থ জনগণের স্বাধীনতার সঙ্গে নিকৃষ্টতম বিশ্বাসঘাতকতা করা। আজ মানবাধিকার লঙ্ঘন করার ব্যাপারটি কেবল আমাদের জন্যই গুরুতর উদ্বেগের বিষয় নয়, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোও এ ব্যাপারে উদ্বিগ্ন।
যে প্রেক্ষাপট এতক্ষণ ব্যাখ্যা করা হল তার আলোকে আমরা যদি একটি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত জনগণের সরকার পেতে চাই- যে সরকার হবে সৎ এবং স্বচ্ছ, তাহলে আপনাদের সামনে আপনাদের বিবেচনার জন্য আমি বিনীতভাবে তত্ত্বাবধায়ক বা নির্বাচনকালীন সরকারের একটি সংশোধিত রূপরেখা বা সূত্র উপস্থাপন করতে চাই, যার দায়িত্ব হবে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনকে অবাধ ও নিরপেক্ষ করা :
(ক) নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে শাসনতান্ত্রিক কাঠামো যৌথভাবে সব দল কর্তৃক স্বীকৃত হয়েছিল তাকে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে সেখানে কিছু প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে হবে।
(খ) নির্বাচনের আগে সংসদ অবশ্যই ভেঙে দিতে হবে, যেমনটি সংসদীয় ব্যবস্থায় সর্বত্র ভেঙে দেয়া হয়।
(গ) রাষ্ট্রপতি প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পরামর্শ করে তত্ত্বাবধায়ক বা নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করবেন। যদি কোনো কারণে ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব না হয় সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি অর্পিত ক্ষমতাবলে নির্দলীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক বা নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করবেন।
আমরা যদি দেশ ও জনগণের প্রতি দায়িত্ব পালনের বোধ থেকে তদ্রাচ্ছন্নতা ঝেড়ে ফেলে জেগে উঠি, তাহলে কোনো বিপদই অবশ্যম্ভাবী হতে পারবে না। ভালো লোকেরা দুর্বল এবং দুর্নীতিবাজরা ক্ষমতাবান, এ ভুল ধারণা থেকে দেশ অবশ্যই মুক্তি পাবে।
সাধারণ নির্বাচনকে দেখতে হবে সরকার তথা রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে জনগণের সার্বভৌম কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চ্যালেঞ্জ হিসেবে। মাইনাস জনগণ সরকারের জন্য মাইনাস জনগণ নির্বাচন অবশ্যই পরিত্যাগ করতে হবে।
গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব ও সাংবিধানিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা যে অবাধ নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছি তাকে অর্থবহ মুক্ত নির্বাচন করে তুলতে হবে।
অবাধ নির্বাচনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা শাসনতন্ত্রের অন্যতম মৌলিক কাঠামোর স্পষ্ট লঙ্ঘন করা। সংবিধান অমান্য করে ক্ষমতা দখল করা যে অসাংবিধানিক, চরম অপরাধ তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আমাদের স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে হলে, নিরাপদ করতে হলে সরকারি কর্মকর্তা, পুলিশ এবং সবাইকে দেশ ও জনগণের প্রতি উচ্চতর আনুগত্যবোধে অনুপ্রাণিত ও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। স্বাধীন জীবন উপভোগের জন্য নিরাপদ দেশ বিনির্মাণের দায়িত্ব অবশ্যই আমাদের সবাইকে নিতে হবে যাতে আমরা নিজেদের কাছে এবং সমগ্র জগতের সামনে প্রমাণ করতে পারি, আমরা আমাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার নেতৃত্বদানে অযোগ্য নই; স্বাধীনতা ভোগের দায়িত্ববোধও আমাদের আছে।
এ কেবল কথার কথা হলে হবে না, বাস্তবে এ কথার রূপ দিতে হবে।
সময়ের ডাকে সাড়া দেয়ার জন্য আমি শেকসপিয়ার থেকে বাণী ধার নিয়ে উচ্চারণ করতে চাই, ‘এটা সত্য যে আমরা মহাবিপদের মধ্যে আছি, আর সেজন্যই আমাদের অনেক বেশি সাহস দেখাতে হবে।’
২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত একটি গোলটেবিলে আয়োজিত বক্তৃতা
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন : আইনজীবী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন