আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ডাকনাম শৈশবে ছিল ‘দুখু মিঞা’। বাস্তবে পুরো জীবন তার কেটেছে অব্যাহত দুঃখের মাঝ দিয়ে। এমনকি, মৃত্যুর দীর্ঘ দিন পরেও সে দুঃখ তাকে ছাড়েনি। এবারো তা প্রমাণিত হয়েছে। মহামারী, দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধসহ নানা বিপর্যয় নিয়ে নজরুল লিখে গেছেন। বিশেষত মহামারীর সময়ে মানুষের বিপন্নতা তার রচনার একটা প্রধান দিক। তা ছাড়া, ঈদের ওপর নজরুলের রচিত গান, কবিতা, নাটক, প্রভৃৃতি সুপরিচিত। ঈদুল ফিতর আজো অসম্পূর্ণ নজরুল সঙ্গীত ‘ও মন, রমজানের-ই রোজার শেষে এল খুশির ঈদ’ ছাড়া। একজন লেখক বলেছেন, রমজানের বিষয়ে বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো- নজরুলের জনপ্রিয় কবিতা ‘কেন জাগাইলি তোরা।’ এতে রমজান মাস ও রোজাকে তিনি উপস্থাপন করেছেন বিপ্লবীভাবে। বলেছেন, “মাহে রমজান এসেছে যখন, আসিবে ‘শবে কদর’, নামিবে তাহার রহমত এই ধূলির ধরার পর।” নজরুল ভাবার্থে লিখেছেন, “এই উপবাসী আত্মা, এই যে উপবাসী জনগণ, চিরকাল রোজা রাখিবে না- আসে শুভ ‘এফতার’ ক্ষণ।”
দুঃখের বিষয়, এ বছর ‘শবে কদর’ কেটেছে ঘূর্ণিঝড় ‘আমফান’-এর তাণ্ডবের মধ্যে; আর ২৫ মে কবির ১২১তম জন্মদিন চাপা পড়েছে করোনাভীতি ও ঈদ আনন্দের মধ্যে।
অনেকেই মসজিদে না গিয়ে ঘরের কোণে ঈদের নামাজ পড়েছেন একই নিয়মে। এ প্রসঙ্গে বুখারি শরিফ ও ইবনে মাজাহ শরিফের হাদিসে উল্লেখ আছে। এবার ঈদুল ফিতরে উৎসবের বদলে ছিল উৎকণ্ঠা। সে উদ্বেগ ‘করোনায় কার না জানি কখন করুণ পরিণতি ঘটে’ তা নিয়ে। ঈদ মানেই কোলাকুলি। এবার করোনার মহামারী তাকে নিষিদ্ধ করে রেখেছিল। এমনকি, হাত মিলানো কিংবা শিশুদের স্নেহভরে চুমো দেয়া পর্যন্ত বারণ ছিল একই কারণে। ঈদগাহ ছাড়াই ঈদ কেটেছে। এক জায়গার ছবি দেখানো হয়েছে টিভি চ্যানেলে, যেখানে ঈদগাহে জামাত হয়েছে পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রেখেই। অথচ তখন ছবিটার নিচে লেখা ভেসে উঠেছে, ‘মসজিদে সামাজিক দূরত্ব বজায় ছিল; তবে ঈদগাহে তা বজায় রাখা হয়নি!’ বরঞ্চ, টিভির পর্দায় দেখা যায়, ঈদ জামাতে কারো কারো মাথায় টুপি নেই; অথচ মুখে মাস্ক আছে, খুলনার কয়রা এলাকায় হাঁটুপানিতে জোয়ার- দুর্গত মানুষ ঈদের নামাজ পড়েছে। এটা মূলত ক্ষমতাসীন দলের কোন্দলের কুফল।
বিশ্বসেরা ক্রিকেট টিম নিউজিল্যান্ডের ক্যাপ্টেন কেন উইলিয়ামসন বাংলাদেশের মানুষকে ‘ঈদ মোবারক’ বলে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। তার ভাষায়, এ দেশের আরেকটা জিনিস খুব ভালো লাগে। পরিচয়ের একদম শুরুতে ‘আসসালামু আলাইকুম’- এটা সত্যিই সুন্দর বিষয়; অসাধারণ।
তবে এবার করোনাকাণ্ডে অন্যান্য দেশের সাথে বাংলাদেশের মানুষও ঈদটা তেমন পালন করতে পারেনি। ঈদগাহ আর কোলাকুলি ছাড়া মুসলমানের শ্রেষ্ঠ উৎসব ঈদ অকল্পনীয়। কিন্তু এবার সামাজিক দূরত্বের বাধ্যবাধকতায় মসজিদে মসজিদে পরস্পর এক মিটার দূরত্বে দাঁড়িয়ে ঈদের জামাত সাঙ্গ করতে হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, কোলাকুলি ছিল নিষিদ্ধ। অপর দিকে সিদ্ধ বা অনুমোদিত ছিল হাত তুলে সালাম-সম্ভাষণ। অতএব, দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে হলো।
করোনার মহামারী একই সাথে আরো অনেক ঐতিহ্য-প্রথা-মূল্যবোধেরও মহামারী ডেকে এনেছে। সব সময় ঈদের কেনাকাটা নির্বিঘœ করতে প্রশাসন সাধ্যমতো সহায়তা দেয়। এবার প্রথমে উপদেশ দেয়া হলো, যতটা সম্ভব ঈদের মার্কেটিং না করার জন্য। অগত্যা যারা কেনাকাটায় যাবেন, তাদের সীমানা দেয়া হলো বাড়ি থেকে ২ কিলোমিটার। বাস্তবে এক দিকে কেনাকাটার ধুম, অন্য দিকে স্বাস্থ্যবিধির প্রতি বুড়ো আঙুল। সুতরাং কর্তৃপক্ষের কড়াকড়ি, যেমন ২২ মের পত্রিকার খবর, ঈদে কেনাকাটা করতে গেলে জরিমানা!
যতই সুন্দর নামে অভিহিত করা হোক না কেন, সাইক্লোন সাইক্লোনই, গ্রিক পুরাণের ‘সাইক্লপস’ বা একচোখা দৈত্য কথাটি থেকে এসেছে ‘সাইক্লোন’ শব্দটা। নার্গিস হোক আর আইলা-কাইলা যা-ই হোক, এর স্বভাবটাই ধ্বংসাত্মক। তাণ্ডবই ঝড়ের বৈশিষ্ট্য। এবার ১৯-২১ মের ‘আমফান’ ঘূর্ণিঝড়ও অভিন্ন চরিত্রের। এ নামকরণ নাকি বাংলাদেশসহ সংশ্লিষ্ট আটটি দেশের সর্বসম্মতিক্রমে করা হয়েছে। তবে আমাদের মিডিয়াগুলো-বিশেষত টিভি চ্যানেলগুলো কেন যে, অজস্রবার ভুল করে, ‘আম্পান’ ‘আম্পান’ বলে হয়রান হয়েছে, বুঝে আসে না। 'অসঢ়যধহ' শব্দটি বাংলায় লিখতে হয় ‘আম্ফান’। এটা শেখার জন্য মহাপণ্ডিত হতে হয় না।
২০ তারিখ রাতে টিভিতে দেখানো হচ্ছিল ঝড়ের ধ্বংসলীলার ছবি। বৃহত্তর খুলনা ও বরিশাল ছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বিভিন্ন স্থানের ছবিও দেখা গেল। সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট কিংবা পটুয়াখালী ও বরগুনার চেয়ে হাতিয়ার অবস্থা মোটেও ভালো
ছিল না ঝড়ের ছোবলে। একই রাতে ফেসবুকে এ দ্বীপের একাধিক চিত্রসহ আকুতি দেখা গেল বাঁচানোর জন্য। করুণাময় আল্লাহর সাহায্যও কামনা করা হয়েছে এতে। অথচ টিভিতে হাতিয়ার তখনো খবর নেই। বোঝা গেল, সেখানে টিভির সাংবাদিক না থাকায় অবস্থা জানা যায়নি। পরদিন কোনো কোনো টিভি চ্যানেলে হাতিয়ার উল্লেখ ছিল। অবশ্য হাতিয়ার চরনিজাম ও নিঝুমদ্বীপের খবর দেয়া হয়েছে নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলা থেকে।
মনে পড়ছিল, ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের মহাপ্রলয়ঙ্করী ঝড়ের কথা। সেই নজিরবিহীন সাইক্লোন-গোর্কির ২-৩ দিন পরে ঢাকার একটি দৈনিক পত্রিকায় হাতিয়ার খবর প্রথম জানা গেল। সেটা অনেকটা রবিঠাকুরের ‘কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল, সে মরে নাই’-এর মতো। পত্রিকার তখন হেডিং ছিল-‘হাতিয়ায় কিছু নেই।’ আমার এক আত্মীয়া সপরিবারে থাকতেন সেখানে। উপজেলা সদরে দোতলা ছিল না দু’একটার বেশি। তারা একটার ছাদে উঠে কয়েক দিন কাটিয়ে কোনোমতে রক্ষা পেয়েছিলেন সেবার।
ঝড়সহ যেকোনো দুর্যোগে সাথে সাথে ক্ষয়ক্ষতির পুরো খবর পাওয়া যায় না। যতই সময় যায়, বাড়তে থাকে হতাহত, নিখোঁজ, সম্পদের ক্ষতি, প্রভৃতি। এবারো তাই হয়েছে। তবে দৃষ্টিকটু লেগেছে, যখন ঘূর্ণিঝড়ে মৃতের সংখ্যা অন্তত ২৩ বলে জানা গেল, তখনো একজন প্রতিমন্ত্রীর উদ্ধৃতি দিয়ে একই টিভি চ্যানেলের পর্দায় একসাথে বলা হচ্ছিল, ‘মারা গেছেন ১২ জন’। মানুষ কোনটা বিশ্বাস করবে? বরং এভাবে প্রচার করা হলে প্রশাসন আস্থা হারায় জনগণের। এ ব্যাপারে মন্ত্রী ও মিডিয়া-উভয়ের সতর্কতা থাকা চাই।
যা হোক, আমাদের প্রাইভেট টিভি চ্যানেলগুলোর উদ্যোগে বড় বড় ঘটনার স্পট কভারেজ, অর্থাৎ সরাসরি সম্প্রচারের মান ও পরিমাণ বেড়ে চলা প্রশংসনীয়। আম্ফানের বেলায়ও হয়নি ব্যতিক্রম। এমনকি, একটি চ্যানেলের উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিনিধিকে (বগুড়াকেন্দ্রিক) দেখা গেছে, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সুদূর মংলা বন্দরের সচিত্র খবর দিতে। ২০ ও ২১ তারিখ সারা দিন টিভি প্রতিনিধিরা অক্লান্ত শ্রম দিয়েছেন করোনাঝুঁকি নিয়েই। অনেকে রাতে নিদ্রা ও বিশ্রামের সময় পাননি- তা চেহারাই বলে দিয়েছে। একটা টিভি চ্যানেলের চট্টগ্রাম প্রতিনিধি যেভাবে সংক্ষুব্ধ সাগরের উঁচু ঢেউয়ের পাশে দাঁড়িয়ে এবং উত্তাল গর্জনের মাঝে নিউজ দিয়েছেন, তা ছিল দেখার মতো এবং অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
অতীতের বেশ কিছু ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মতো এবারের ‘আম্ফান’কেও জানপ্রাণে ঠেকিয়েছে অমূল্য সুন্দরবন। এতে নিজের অপরিমেয় ক্ষয়ক্ষতি হলেও সে তার এই গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করা থেকে পিছিয়ে আসেনি। ‘আম্ফান’-এর মূল আঘাতটা পড়েছিল ভারত ও বাংলাদেশ সীমান্তের সুন্দরবনে। ওপারে ভারতের ২৪ পরগনা আর এপারে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলা। দিন যত যাবে, ততই বনের ক্ষতির পরিমাণ ও ধরন স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এ ব্যাপারে সরকার বন বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়ে কয়েকটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। দেশবাসী আশা করছে, নিজেদের ‘আখের গোছানো’র ভাবনা ত্যাগ করে সবাই দেশ ও জাতির ‘আখের’ নিয়েই কেবল ভাববেন এবং সে মোতাবেক রিপোর্ট তৈরি করবেন।
প্রসঙ্গক্রমে মনে পড়ছে ১৯৮৮ কি ’৮৯ সালের ২৯ নভেম্বর সংঘটিত ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের কথা। সে ভয়াল রজনীতে এই সুন্দরবন ঝড়ের তাণ্ডব রুখতে গিয়ে অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হয়েছিল। আমি তখনো একটি পত্রিকায় কাজ করি এবং ঝড়ঝঞ্ঝা বা আবহাওয়ার নিউজের দায়িত্বে ছিলাম বহু বছর। সে কারণে রাতভর থাকতে হয়েছিল অফিসেই। সকালে বাসায় ফেরার সময় দেখেছি, সাইক্লোনের তাণ্ডবে রাজধানীর ফার্মগেটে একটি বিশাল বৃক্ষ উপড়ে পড়ে আছে এবং তার মূলোৎপাটনের জায়গাটা হয়ে গেছে একটা ডোবার মতো।
এবার আম্ফানে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সংবাদের মধ্যে একটা রহস্যজনক ঘটনাও ঘটে গেছে। তা হলো রাজশাহীর মোহনপুরে মনোয়ারা বেগম রাতে ছোট মেয়েকে নিয়ে ঘুমিয়েছিলেন। ঝড়ের সময় তিনি নাকি সবার অগোচরে ঘর থেকে বেরিয়ে যান আম কুড়াতে। এদিকে মেয়ে জেগে মাকে দেখতে না পেয়ে কাঁদতে থাকে। এরপর দীর্ঘ সময়েও মনোয়ারা ফিরে আসেননি। তখন ঘরের লোকজন তাকে খুঁজতে বের হন। তারা দেখতে পান বাড়ির পাশে আমগাছের নিচে তিনি বসে আছেন। তবে একজন তার গায়ে হাত দিতেই তিনি লুটিয়ে পড়েন। সাধারণত বজ্রপাতের শিকার হলে মানুষের এমন অবস্থা হয়ে থাকে। কিন্তু খবরে এর কোনো উল্লেখ নেই। বরং ওসি বলেছেন, মনোয়ারার শরীরে আঘাতের চিহ্ন নেই। তার ওপর গাছ বা ডালা ভেঙে পড়ার প্রমাণও নেই। কিভাবে মারা গেলেন, নিশ্চিত হওয়া যায়নি।’
সম্প্রতি এক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব দুঃখ করে বলেছেন, ‘করোনাকালের অচিন্তনীয় মহাদুর্যোগেও আমাদের শিক্ষা হবে না। ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না- এটাই ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা।’ সত্যিই, এই অপ্রিয় বাস্তবতার পুনরাবৃত্তি পরিলক্ষিত হলো এই ঈদেও। এবার পবিত্র ঈদুল ফিতরের জামাত থেকে ফেরার পথে চট্টগ্রামের এক স্থানে এক ইউপি সদস্য গুলিতে নিহত হলেন। এ ঘটনায় আটক হয়েছেন ইউপি চেয়ারম্যানসহ দু’জন। এদিকে ঈদ জামাত মসজিদ না ঈদগাহে হবে, তা নিয়ে বিতণ্ডার পরিণামে সংঘর্ষ এবং আহত ও গ্রেফতার হওয়ার মতো অঘটন ঘটে গেছে বগুড়ার নন্দীগ্রামে। এর পাশাপাশি, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে ঈদের জামাতে ইমামতির সময় ইন্তেকাল করেছেন মাওলানা আইউব আলী। এই মর্মান্তিক ঘটনা ছাড়াও আরো দুঃসংবাদ রয়েছে। মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার নাকোলে ঈদের নামাজ নিয়ে সংঘর্ষে শতাধিক ঘরবাড়ি লুটপাট ও ভাঙচুর হয়েছে। আর ঈদের সকালে টিভি খুলতেই করোনায় মৃত্যু সংবাদ। যিনি এ মহামারীতে প্রাণ দিলেন, তিনি হলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একটি অঙ্গ সংগঠনের এক সময়ের নেতা এবং ঢাকার মোহাম্মদপুরের সাবেক এমপি আলহাজ মকবুল হোসেন। তিনি কয়েক বছর যাবত দৈনিক আল আমীন বের করেছিলেন। তার স্ত্রী ছিলেন মহিলা আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেত্রী। মকবুল হোসেনের প্রতিষ্ঠিত কলেজ আছে মোহাম্মদপুরে।
এবার কর্তৃপক্ষের কড়াকড়ি ছিল ঈদের জামাত যাতে খোলা জায়গায় না হয়, সে জন্য। এ কারণে জাতীয় ঈদগাহে নামাজ হয়নি। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে সকাল ৭টা থেকে ৫টি জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে। মুসল্লিরা একে অন্যের থেকে দূরে দূরে দাঁড়িয়েছেন। দেখা গেছে, এক ঘণ্টা আগেই লাইনে দাঁড়িয়ে জামাতের জন্য অপেক্ষমাণ অনেকে। মুনাজাতে আল্লাহর দরবারে মানুষের ক্রন্দনপূর্ণ আকুতি ও অশ্রুপাত ছিল উল্লেখযোগ্য। মসজিদে পারস্পরিক এক মিটার দূরত্ব তো বজায় ছিলই, দু’কাতারের মাঝে এক কাতার ফাঁকা রাখতেও দেখা গেছে। চলমান দুর্যোগের মাঝেও মুনাজাতের সময়ে মুসল্লিদের কেউ কেউ মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকা নিঃসন্দেহে বলা যায় ‘দৃষ্টিকটু’।
কিছু দিন আগে, বিগত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা বর্তমান ট্রাম্প প্রশাসনের কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন, ‘করোনাভাইরাসঘটিত মহামারী মোকাবেলা করতে গিয়ে তারা ভয়ানক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছেন। ওবামা এ ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন ঈযধড়ং শব্দটি। আমাদের বাংলাদেশেও এমন অবস্থা সৃষ্টি হতে যাচ্ছিল। এক দিকে লকডাউন, অন্য দিকে গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি খুলে দেয়া এবং এক দিকে হাজার হাজার শ্রমিকের গ্রামের বাড়িতে চলে যাওয়া ও অপর দিকে তাদের আবার শহরের দিকে ছুটে আসার মতো। প্রধানত এ কারণে অবস্থার চরম অবনতির শঙ্কা দেখা দিয়েছিল। শেষাবধি কোনোমতে পরিস্থিতি সামাল দিতে দিতে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ইমেজ আরো ক্ষুণœ হয়েছিল।
ওয়াকিবহাল মহলের মতে, স্ববিরোধী ও বিভ্রান্তিকর সিদ্ধান্ত আরো নেয়া হয়েছিল। যেমন, কাঁচা বাজার ভোর ৬টা থেকে বিকাল ৬টা পর্যন্ত প্রথমে এবং এর পরে দুপুর নাগাদ খোলা রাখার অনুমতি দেয়া হয়। তবে পাড়ার মুদি দোকানও বেলা ২টার পর বন্ধ করে দিতে হয়েছে। অপরদিকে, বড় বড় শপিংমল খোলা রাখার অনুমতি ছিল ৪টা পর্যন্ত। রোজার মাস শুরু হতেই জানিয়ে দেয়া হলো, ইফতারির হোটেল রেস্তোরাঁ খোলা রাখা যাবে; তবে সেখানে বসে খাওয়া চলবে না। থাকবে শুধু তা নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা। তখনো ফুটপাতে বসতে পারেনি গরিব হকার। নিশ্চয়ই মহামারী সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে এটা করা হয়েছিল। তবে লকডাউনে জীবিকার ক্ষতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি হকার শ্রেণীর গরিব মানুষের। এদিকে ইফতারির সময়, সন্ধ্যার আগে রাস্তাঘাটে মানুষের ভিড় বেড়ে গেল। মসজিদে মসজিদে আগে থেকেই অনেকের যাতায়াত ছিল, কর্তৃপক্ষের ‘সীমিত’ অনুমোদন তা বাড়িয়ে দেয় অনেকটা। সন্ধ্যা ৬টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত কারফিউ চলছিল। আবার ‘রাত ৮টার পর’ লোক চলাচলে নিষেধাজ্ঞা বহাল রইল। এ অবস্থায় অনেকে স্বাস্থ্যগত বাধ্যবাধকতার পরও হাঁটতে বাইরে যেতে পারেননি। অন্য দিকে অনেকে বিনা প্রয়োজনে ও নিছক তামাশা করে বেরিয়েছেন। পুলিশের হাতে ধরা খেলে বের হওয়ার অজুহাত দেখিয়েছেন খোঁড়া ও উদ্ভট।
পাদটীকা : লকডাউনকে শকডাউন করে শত শত মানুষ রোজার শেষ দিকে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছিল। কেউ ছুটছিল গ্রামের বাড়ির দিকে, কেউ যাচ্ছিল বাজারে আর কেউবা নেহায়েত হাওয়া খেতে বেরিয়েছে। তাদের সামলাতে গিয়ে পুলিশের ‘ফুলিশ’ (বোকা) হওয়ার উপক্রম!
তিন যুবক একটা মোটরসাইকেলে চরে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। ভাবটা জরুরি কাজের কিন্তু ভঙ্গিটা আয়েশি! বেরসিক পুলিশ ওদের থামিয়ে জেরা আরম্ভ করে : ‘কোথায় যাচ্ছ তোমরা, এখন যে লকডাউন তা জানো না?’ তাদের একজন জবাব দিলো : ‘ওস্তাদ, আমরা তো লকডাউন দেখতেই বের হয়েছি।’
উৎসঃ নয়া দিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন