সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা। মঙ্গলবার রাতে উপাচার্যের বাসার সামনে এই কুশপুত্তলিকাটি রেখেছেন তাঁরা।
সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা। মঙ্গলবার রাতে উপাচার্যের বাসার সামনে এই কুশপুত্তলিকাটি রেখেছেন তাঁরা।ছবি: আনিস মাহমুদ
বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রীদের নিয়মিতভাবে মার খেতে হয়। কয়েক দিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে কাওয়ালি গানের অনুষ্ঠান করতে গিয়ে ছাত্রলীগের মার খেল কয়েকজন শিক্ষার্থী। এখন সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) পুলিশ-ছাত্রলীগের যৌথ ‘প্রযোজনায়’ উপাচার্যের ‘পরিচালনায়’ শিক্ষার্থী পেটানোর ‘উৎসব’ হয়ে গেল।
সারা বছরেই দেশের বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ছেলেমেয়েরা মার খায়। গান করতে গিয়েও খায়, আন্দোলন করতে গিয়েও খায়। ক্যাম্পাসের বাইরে রাজপথেও মার খাওয়ার উদাহরণগুলো এখনো তাজা। বাংলাদেশের তরুণদের মতো মার খাওয়া প্রজন্ম খুব কমই আছে।
বাংলাদেশের উপাচার্যদের মতো এমন স্বৈরাচারী ও দুর্নীতিগ্রস্ত উপাচার্যও কম আছে। ২০২০ সালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ২১ জন উপাচার্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত করেছিল। তার ভিত্তিতে রংপুরের রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সেসময়ের উপাচার্য নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এম. আবদুস সোবহান কেবল পদ হারিয়েছেন। শাস্তির মধ্যে এতটুকু পেয়েছেন যে, সোবহান সাহেবকে রাতের অন্ধকারে ক্যাম্পাস থেকে পালিয়ে আসতে হয়েছিল। বাকিদের কিছু হয়েছে বলে জানা নেই। ইউজিসির তদন্ত প্রতিবেদনও কোনো সরকারি দেরাজে গুপ্ত অবস্থায় শীতঘুমে রয়েছে। অনেক উপাচার্যই তবিয়ত বহাল রেখেই চালিয়ে যাচ্ছেন।
উপাচার্যদের দুর্নীতি, নৈতিক স্খলন, অনিয়ম, স্বৈরাচারী আচরণ এবং অজস্র অযোগ্য ব্যক্তিকে শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে গেলেও, শাস্তি হয় না। দুর্নীতির ক্ষতি নাহয় পোষানো গেল, কিন্তু যে সব অযোগ্যরা শিক্ষকের আসনে বসে পড়লেন, বছরের পর বছর তাঁরা শিক্ষার্থীদের ঠকিয়ে যাবেন, প্রশাসনের সঙ্গে মিলে শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অপকর্ম চালিয়ে যাবেন। এটা যে কত বড় ক্ষতি, তা কি আমাদের মাননীয় আচার্য রাষ্ট্রপতি মহোদয় উপলব্ধি করেন?
হলগুলোতে আগে পেটানোর সময় বলা হতো, ‘মাইর হবে কিন্তু সাউন্ড হবে না’। অর্থাৎ, মার খেয়েও আহা উহু করতে পারবে না, কাউকে বলতে পারবে না। কিন্তু শাবিপ্রবিতে দেখা যাচ্ছে, সাউন্ড গ্রেনেড সহযোগে মার দেওয়া হচ্ছে। সবুজ ক্যাম্পাসে গুলিও বেশ শব্দ করেই ফাটছে। কিন্তু সেই পুলিশ এমন পুলিশ যে, বেছে বেছে প্রতিবাদকারীদেরই মারে, অন্যায়কারীদের কিচ্ছুটি বলে না। ফুল তো নিলই না উল্টো মামলা করে দিল। মামলা তো তাঁদের করতেই হবে। কারণ, এত এত শটগানের গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড, লাঠিপেটার কারণ দেখাতে হবে তো? বললেই হবে না যে, আমরা উপাচার্যকে অবরোধমুক্ত করার জন্য তাঁর চাহিদামাফিক ইচ্ছামতো বলপ্রয়োগ করেছি। আইনের ধোপে এমন কারণ মোটেই টিকবে না। তাই সিলেটের পুলিশকর্তাকে বলতে হয়েছে, ‘সে দিন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশের অস্ত্র-গুলি গেছে, পুলিশ সদস্যরা আহত হয়েছেন, এগুলো দেখাতেই মামলাটি করা হয়েছে। তবে মামলার কারও নাম যায়নি’। নাম বসিয়ে দেওয়া যদিও ওয়ান-টুয়ের ব্যাপার। কিন্তু কী এমন পরিস্থিতি হয়েছিল যে, পুলিশকে ২১টি সাউন্ড গ্রেনেড ও ৩১টি শটগানের গুলি ছুড়তে হয়েছিল?
পরিস্থিতি তো এটাই যে, করোনাকালীন যে কয়মাস বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ছিল, সেই কয়মাসের কক্ষভাড়া শিক্ষার্থীরা দিতে চায়নি। হলগুলো আবার ক্যাম্পাসেও নয়, বাইরের ব্যক্তিমালিকানাধীন ভবন হওয়ায় সেসবের ভাড়াও ছিল অনেক বেশি। আপনি হলে জায়গা দিতে পারবেন না বলে বাণিজ্যিকভাবে ভবন ভাড়া নেবেন এবং সেই ভবন কয়ে কমাস ব্যবহৃত না হলেও তার ভাড়া ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকদের পকেট থেকে কাটবেন, এটা কেমন নিয়ম? ছাত্রী হলের প্রভোস্ট মেয়েদের সঙ্গে অসদাচরণ করবেন, তার প্রতিবাদ হলে ছাত্রলীগ হামলা চালাবে। এসবের বিচার চাইতেই শিক্ষার্থীরা উপাচার্য মহাশয়ের কাছে গিয়েছিল। তিনি যদি বিচারের নিশ্চিত আশ্বাস দিতেন, মেনে নেওয়ার মতো দাবিগুলি মেনে নিতেন, তাহলে আজ উপাচার্যের কুশ পুত্তলিকাও পুড়ত না, আহত শিক্ষার্থীদের হাসপাতালে শুয়ে কাতরাতে হতো না, দেশজুড়ে নিন্দাপ্রবাহও বইতো না।
ছাত্র পিটিয়ে মানুষ করা যেই দেশের রীতি, সেই দেশে উপাচার্যদের পেটোয়া সর্দার বলাই ভালো। তাঁরা ক্যাম্পাসে যা চালান তার সঙ্গে শিক্ষার সম্পর্ক নেই, তা একরকম জমিদারি। জমিদার বদলালেই জমিদারতন্ত্র চলে যাবে না। দেখা যাবে, উপাচার্যদের ঘিরে, রেজিস্ট্রার, ট্রেজারার, প্রক্টরসহ একদল প্রভাবশালী শিক্ষকনেতা থাকেন। কূটক্যাচালে পারদর্শী এইসব শিক্ষকেরা উপাচার্যদের ঢাল বানিয়ে নিজেদের হাত কিংবা পকেট শক্তিশালী করেন। দোষ হয় কেবল উপাচার্যের, কিন্তু স্বৈরতন্ত্রের কাঠামোটা থেকেই যায়।
হাল আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বার্থের সংঘাত আরও তীব্র হয়েছে উন্নয়নের কারণে। যেখানেই শত শত কোটি টাকার প্রকল্প গেছে, সেখানেই ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে কোন্দল দানা বাঁধছে। আর এসবের বলি হচ্ছে শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের জীবন। এর বিরুদ্ধে কথা বলা যাবে না? উচ্চশিক্ষার ধ্বংস সয়ে যেতে হবে? যেখানে গবেষণায় টাকা পাওয়া যায় না, শিক্ষার্থীদের বিশ্বমানের গ্রন্থাগার ও গবেষণাগার দেওয়া যায় না, সেখানে শত-হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন চলে কিসের স্বার্থে?
ওয়াকিবহাল ব্যক্তিমাত্রই জানেন, যতটা ফাঁস হয় তা আদতে হিমশৈলের চূড়ামাত্র—তলায় আরও অনেক কিছু আছে; আছে আরও আরও উপাচার্য ও তাঁদের সাঙ্গপাঙ্গদের নাম। এসবের বিরুদ্ধে কথা বলায় উপাচার্যরা কলমের খোচা দিয়ে প্রতিবাদী ও নিষ্ঠাবান শিক্ষকদের চাকরি খেয়ে দেন। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন তরুণ শিক্ষকের চাকরি এভাবে রদ করা অবস্থায় ঝুলছে।
এসবের বিরুদ্ধে দেশের অগ্রণী নাগরিক, শিক্ষক, শিক্ষাবিদ ও চিন্তকেরা কেন কথা বলবেন না? অভিভাবকসহ স্থানীয় নাগরিকদেরও সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সন্ত্রাস চলে, প্রশাসনিক স্বৈরতন্ত্র চলে, জুলুম চলে তার শিকার কেবল সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীরা নয়। এর শিকার সমগ্র দেশ। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি ঠিকমতো না চলে, তাহলে দেশ চালাবার মেধাশক্তি কোথা থেকে আসবে? বিশ্ববিদ্যালয়ে যে অন্যায় টিকে যায়, তা সারা দেশেই ছড়ায়। সিলেটের শাবিপ্রবির শিক্ষার্থীদের আন্দোলন তাই একটি ক্যাম্পাসের বিষয় না, তা জাতীয় বিষয়। জাতির উচিত তার সন্তানদের পাশে দাঁড়ানো।
ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক।
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন