এ গল্প জীবনের, কারণ মৃত্যুর গল্পগুলো বলার জন্য কেউ বেঁচে নেই। জীবন পুড়ে গেছে কারখানায়। পোড়া লাশগুলো পাশাপাশি ভাইবোনের মতো ঘুমাচ্ছে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে। কোনো ডিএনএ পরীক্ষাতেও তাদের মৃত্যুর আগের মুহূর্তগুলো জানা যাবে না।
কে কার বোন, কে কার কন্যা, কে কার পুত্র। ডিএনএ পরীক্ষার আগে সেটা বোঝার উপায়ও নেই। তাহলে কাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদবে স্বজন, কবর দেবে কার? হাতে একটি কিশোরীর ছবি নিয়ে এসেছিলেন রাবেয়া আক্তার। পুলিশ বলছিল, ভিড় করবেন না। তাঁরা তাঁদের ননদের বাচ্চার লাশ চান। কিন্তু কোন সেই জাদুকর, যিনি জীবন্ত মানুষের ছবি দেখে মিলিয়ে দেবেন পুড়ে কালো অঙ্গার হয়ে যাওয়া কোনো মুখ? ফারজানা নাম তার, বয়স ১৫ গিয়ে ১৬–তে পড়েছে। রাতের পালায় তার বোন কাজ করে বাড়ি ফিরেছে, ছোট ফারজানা ফেরেনি। তার ফুফু এখন সব জায়গা খুঁজে আবার ফিরে এসেছেন কারখানার সামনের রাস্তায়। বলছেন, ‘এই আমার ভাগনি, এই যে ছবি, দ্যাখেন দ্যাখেন?’
মনে পড়ে আট বছর আগে রানা প্লাজার সামনে এ রকমই ছবি হাতে কান্নারত এক বৃদ্ধ বাবার কথা, ‘মোর ছাওয়ার নাম জব্বার, সব্বার খুব চেনা। ফুটবল খেলাইত ভালো, পান্তা খাইত খুব।’ রানা প্লাজার থেঁতলে যাওয়া দেহ কিংবা তাজরীন বা হাসেমের পোড়া ধ্বংসাবশেষ থেকে কি বোঝা যায় যে এই মেয়েটি খুব আদুরে ছিল বাপের, এই মেয়েটি খুব সিনেমা দেখতে চাইত আর কারও বিয়ের সময় সিনেমার গান গাইত! কিংবা এই ছেলেটি খুব রাগী হলেও মায়ের ডাকে শান্ত হয়ে যেত! মর্গে লাশের ব্যাগের মধ্যে পড়ে থাকা পোড়া শরীরগুলো থেকে বোঝার উপায় নেই এত গল্প, এত স্মৃতি রেখে গেছে তারা!
রীমার গল্পটা জানেন শুধু আশরাফুল
রীমা আক্তারের গল্পটা বলার জন্য বেঁচে ছিলেন আশরাফুল। দুজনে একসঙ্গে পড়েছেন নরসিংদীর পলিটেকনিকে। তারপর এই কারখানায় একসঙ্গে ইন্টার্নও করেছেন। একসঙ্গে চাকরিও হয় দুজনের। একটা অর্ধসমাপ্ত গল্পের বেদনা আশরাফুলের চোখে–মুখে। ভুলতার ইউএস–বাংলা হাসপাতালে শুয়ে তিনি বলে যান। ও অনেক শান্ত মেয়ে ছিল। আগুন লাগার আগের দিন বলছিল, ‘আমার লাইগা লাচ্ছি আইনো। ও লাচ্ছি খাইতে পছন্দ করত, আমার সেকশনে লাচ্ছি বানানো হইত। আমি নিয়া যাইতাম। ওর সেকশনে হইত লিচি জুস। ও আমারে সেইটা খাওয়াইত। ওর তো ওই দিন ওইখানে থাকার কথা ছিল না। কিছুদিন আগে রীমাকে বদলি করা হয় অন্য ভবনে। ঠিক আগুন লাগার আগের দিন নিয়ে আসা হয় আমাগো বিল্ডিংয়ে। রীমার অনেক স্বপ্ন ছিল। ডিপ্লোমা তো পাস করছেই, এখন বিএসসির পড়ালেখা করত অনলাইনে।’
আমি আশরাফুলকে বলতে পারিনি, রীমার পোড়া কয়লার মতো দেহের একটা ছবি আছে আমার কাছে। ডিএনএ টেস্ট ছাড়া নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই, তবে তাঁর আরেক সহপাঠী বলেছেন, ‘এটাই রীমা, এ রকমই লম্বা ছিল সে।’
রীমা ও সোমা দুই বোন কাজ করতো হাশেম বেভারেজে। নাদিয়াকে ওপর থেকে পড়ে যেতে দেখে আয়েষার মনে হয়েছিল, ‘আমিও মইরা যাই না কেন?
রীমা ও সোমা দুই বোন কাজ করতো হাশেম বেভারেজে। নাদিয়াকে ওপর থেকে পড়ে যেতে দেখে আয়েষার মনে হয়েছিল, ‘আমিও মইরা যাই না কেন?ছবি: প্রথম আলো
পাড়াগাঁর রুমা-পর্ণা-সুবর্ণাদের মুখ
রুমা নামের মেয়েটির চারটি চাচাতো বোন—পর্ণা, সুবর্ণা, হালিমা ও বীথি। রুমার বয়স ১৫। ওর বোনেরাও কেউ ১৪, কেউবা ১৫-১৬। ময়মনসিংহের তারাকান্দার রাজদারিক বিদ্যালয়ে পড়ত। করোনায় স্কুল বন্ধ, বাবাদেরও খুব অভাব। তাই আত্মীয়ের হাত ধরে তারা একে একে নাম লেখায় সজীব গ্রুপ অব কোম্পানির হাসেম ফুডসে।
বলা হয়, বাংলাদেশের মেয়েদের হাতের আঙুল খুব কোমল। সুই-সুতার কাজের জন্য একদম উপযোগী। এ জন্যই এই মেয়েরা খুব দ্রুত বিনা প্রশিক্ষণে পোশাক কারখানার কাজ শিখে নিতে পারে। হাসেম ফুডসে ওদের কাজ ছিল কাগজের মোড়ক তৈরি, জুসের প্যাকেটে স্ট্র ঢোকানো, লাচ্ছি বা চকলেট বানানো। কিশোরীর হাতের যত্ন যখন অল্প পয়সায় কেনা যায়, যখন সরকার তাদের খরচযোগ্য মনে করে, তখন মালিকেরা এ সুবিধা নেবেন না কেন?
বেতন-বোনাস নিয়ে দুই মাস বয়সী সন্তানকে দেখতে যাবার কথা ছিল মোহাম্মদ আলীর।ছবি: প্রথম আলো
নবজাতকের মুখটাও দেখতে পারেননি বাবা
কিংবা বলা যায় মোহাম্মদ আলীর কথা। আগুনে পুড়ে মরা যেন তাঁর নিয়তি। গত মাসে একবার আগুন লাগে হাসেম ফুডসে। সেই আগুনে যে তিনজনের শরীরের আংশিক পুড়ে যায়, তাঁদের মধ্যে আলীও ছিলেন। দুই মাস আগে তাঁর সন্তান জন্মালেও এখনো সামনাসামনি দেখা হয়নি, এখনো ছুঁয়ে দেখেননি বুকের ধন। পাবনায় গ্রামের বাড়িতে থাকা বউ-বাচ্চাকে দেখতেন ইমোতে। চলতি মাসের বেতন, ঈদের বোনাস আর তিন মাসের ওভারটাইমের বকেয়া হাতে নিয়ে ঈদ করতে যাওয়ার কথা ছিল। মোহাম্মদ আলী ভাড়া থাকতেন কারখানার পাশের ৫ নম্বর ক্যানেলের কাজল মিয়ার বাড়ির নিচতলার এক ঘরে। গিয়ে দেখি তালাবদ্ধ। চোখে পানি নিয়ে তাঁর কথা বলছিলেন কাজল মিয়ার স্ত্রী বিউটি আক্তার। ভেজা গলায় বলেন, ‘আমারে কাকি ডাকত, আমি ডাকতাম কাকা। ওই দিন আগুন লাগার কথা শুনে তারে ফোন দিই, বলি, কাকা আপনি কি ঠিকমতো আছেন? আপনি বের হন। সে বলে, “কাকি, ধোঁয়ার জন্য কিছু দেখি না।” শেষবার ফোন দিলে বলে, “কাকি নিশ্বাস নিতে পারি না, অক্সিজেন পাঠান।” তারপর কয়শ বার যে ফোন দিছি, আর পাই নাই। পুরা ফ্যামিলি ওর ওপর চলে। ওর মা মারা গেছে দুই মাস আগে, এখন ও চলে গেল। আহা রে, বাচ্চার মুখটাও দেখতে পারে নাই।’
বিউটি আক্তার রাগ নিয়ে বললেন, ‘এই ফ্যাক্টরিতে কয়েক দিন পরে পরেই আগুন লাগে। মালিক কী করে, সরকার কী করে?’ রুমা-রোজিনা-নাদিয়া সবাই বলেছে, গত মাসেও একবার আগুন লেগেছিল। আমরাও বলি, কেবলই মালিকের দোষ? সরকার আছে তো আমাদের, কারখানা পরিদর্শক আছে, শিল্প মন্ত্রণালয় আছে, পুলিশ-র্যাব কত কিছু আছে।
বেওয়ারিশ জীবন
রানা প্লাজা ধসের পর একটা বৃদ্ধ মানুষকে পাই। বেওয়ারিশ লাশ সন্তানস্নেহে কবর দিতেন। বাংলাদেশের কারখানাগুলোর শিশুশ্রমিকেরা, খরচযোগ্য কিশোরীরা, পরিবারের দিন ফেরাতে যুদ্ধ করা ইয়াসিন কিংবা সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখা রীমা আক্তাররাও কি বেওয়ারিশ? জীবিতকালের মতোই মৃতকালেও তাদের দায়িত্ব এই দেশ নেবে না? দাবি করবে না বিচার? বলবে না, ‘আর না, আর কখনোই নয়!’’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন