ফেসবুকে ভোটতরঙ্গ: সকালে আশা, দুপুরে রাগ, বিকেলে হতাশা
03 February 2020, Monday
ফেসবুকে ভোটতরঙ্গ: সকালে আশা, দুপুরে রাগ, বিকেলে হতাশা
সিটি নির্বাচন একঘেয়েমির ঢাকাই জীবনে কিছুটা উত্তেজনা, কিছু রস-তামাশা আর একরাশ হতাশা নিয়ে এসেছে। নাটকীয় ব্যাপারস্যাপার তো ছিলই। তবে অন্য সময়ে যাঁরা ভোটের সময় ভাষণ দেন, এবার মনে হয় তাঁরা কমই কথা বলেছেন। অন্য সময় তাঁদের কথা নিয়ে মেতে থাকার খোরাক থাকত। এবারে সেটা কোনো কারণে কম। তাই ফেসবুক খুব একটা জমেছে বলে মনে হয় না। ততটা সিরিয়াস মনে হয় ছিল না ভোটারও। ফেসবুকে আর ভোটকেন্দ্রে মানুষ কম, কথাও কম। সেটাই স্বাভাবিক। নির্বাচন বিষয়টা বাংলাদেশে গুরুত্ব হারানোর লক্ষণ এই নিরাসক্তি। ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার একটা কারণ হয়তো সেটাও।
ফেসবুকের ‘সময়’ নিজের ছন্দে গড়ায়। ইতিমধ্যে কবিরা আবার কবিতা পোস্ট করা শুরু করেছেন, বইমেলার আলোচনা জায়গা করে নিচ্ছে।
অনেকগুলো মজার ঘটনাও ঘটেছে। ফেসবুকে আলোচিত ‘ডেইজি আপা’ হেরে যাওয়ায় অনেক কপট দুঃখের পোস্ট দিয়েছেন। নির্বাচনী সংগীত নামে গানের জগতে যে নতুন ধারা ও বাজার হয়েছে তাতে ‘ডেইজি আপা’র নির্বাচনী সংগীত অনলাইন জগতে প্রসিদ্ধি পায়। জীবনে প্রথম ইভিএমে ভোট দেওয়া যাবে ভেবে উৎসাহী কিছু বালকের বিফলতাও নজরে পড়েছে। অনেক নির্বাচনীয় ভিডিও শেয়ার হয়েছে, যেগুলোর কোনটা কোন নির্বাচনের তা এক দেখায় বোঝাও যায় না।
ফেসবুকে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো, ইভিএম রাখা গোপন স্থানে ভোট দেওয়ার সময় সহযোগীদের আবির্ভাব। সেই ঘটনার উল্লেখ করে শরিফুজ্জামান নামের একজন লিখেছেন, ‘ভোটারদের বুথের ভেতর প্রতীক খুঁজে ভোট দিতে আওয়ামী লীগ কর্মীরা যে সহযোগিতা করেছে, জাতি সেই সহযোগিতার কথা কখনো ভুলবে না।’ আবু হানিফ অনুরূপ অভিজ্ঞতার কথা লিখে জানিয়েছেন, ‘যাঁরা কষ্ট করে কেন্দ্রে গিয়েছিলেন ভোট দিতে, তাঁদের ভোট দেওয়ার জন্য কষ্ট করতে হয়নি। বুথে থাকা সহৃদয়বান ব্যক্তিরা তঁাদের ভোট দিয়ে দিয়েছেন।’
গোলাম রাব্বির অভিজ্ঞতাও একই রকম। ‘ভেবেছিলাম, আজ বিএনপিকে ভোট দিব। বলতে পারেন, শখ করে। গেলাম ভোটকেন্দ্রে। আওয়ামী লীগ ছাড়া কারও এজেন্ট দেখতে পাইনি। গেলাম কক্ষে। দেখলাম যারা ইভিএম এ ভোট দিচ্ছে, পাশে ৩ জন ছেলে তাকিয়ে আছে...।’ পরিশেষে গোলাম রাব্বি নিজে আঙুলে ছাপ দিয়ে ইভিএম মেশিন চালু করলেও নিজের ভোটটা নিজে দিতে পারেননি বলে জানিয়েছেন তাঁর ফেসবুকের দেয়ালে।
সকালে অনেককেই দেখা গেছে, সিটি নির্বাচনে উৎসাহ দেখাচ্ছেন। ভোট দিতে যাবেন বলছেন। দুপুরের পর থেকেই এ ধরনের পোস্ট কমে যেতে থাকে। আসতে থাকে নির্বাচনে ভোট গ্রহণ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের অনিয়মের অভিযোগের বয়ান। আসতে থাকে অনিয়মের প্রমাণমূলক খবর, ছবি ও ভিডিও শেয়ার। প্রচুর হাস্যরস হয়েছে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের আঙুলের ছাপ না মেলার ঘটনায়। অল্প কয়েকজনকে পাওয়া গেছে, যাঁরা ইভিএমের স্ক্রিনের ছবিসহ বলছেন যে ভোট দিতে গিয়ে ওই মেশিনে দেখেন, তাঁদের ভোট দেওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু কীভাবে সেটা করা সম্ভব, তার কোনো ব্যাখ্যা মেলেনি।
কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন, ভোট দিতে গিয়ে একটি দলের কর্মীদের সাজানো লাইনের পেছনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার কথা। সেই লাইন এমনই লাইন যে নড়াচড়া করে না বা এগোয় না। নির্বাচন যে উৎসবের বিষয়, সেটা মনে করিয়ে একজন লিখেছেন, ‘জনজীবনে বিনোদন কমে যাচ্ছে, মাঝেমধ্যে নির্বাচন দেওয়া দরকার। জনস্বার্থে—বাংলাদেশ টেলিভিশন’। সত্যিই অনেককে ফাঁকা রাস্তায় ফুরফুরে আমেজে রিকশা ভ্রমণ করার ছবি ফেসবুকে পোস্ট করতে দেখা যাচ্ছে। উত্তরার রাস্তায় একজন শিশুকন্যা নিয়ে অবাধে সাইকেল চালাতে পারার ভিডিও শেয়ার করেছেন। এক দম্পতি শীতের রোদে রিকশায় বেড়ানোর ছবি দিয়ে লিখেছেন ‘হ্যাপি ইলেকশন ডে’। একজন আফসোস করেছেন, বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের—উভয়েই এই দিনে হাসপাতালে ভর্তি আছেন!
নির্বাচনে দাঁড়িয়েও ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনা কিংবা পোলিং এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে বিএনপির ব্যর্থতাকে দুষেছেন কেউ কেউ। যদি নিজেরা মাঠে থাকতে না-ই পারে, তাহলে ভোটারদের কেন ভোটকেন্দ্রে যেতে উৎসাহ দেওয়া—বলেছেন কেউ কেউ। একজনের সরস মন্তব্য, ‘গণতন্ত্র রক্ষায় বর্তমান সরকারের অধীনে পরবর্তী সকল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে বিএনপি।’ একজন তো খেলার প্রসঙ্গ টেনে আরও কড়া ও রসিক মন্তব্য পোস্ট করেছেন, ‘আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জিতবে—এই স্বপ্ন আমি এখনো দেখি। কারণ, এখনো পৃথিবীতে কিছু...বিশ্বাস করে আ.লীগ সুষ্ঠু নির্বাচন দেবে এবং সেই নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হবে। এদের এই অলৌকিক আশাবাদ আমাকে ভরসা দেয়, আর্জেন্টিনার প্রতি হারানো বিশ্বাস ফিরিয়ে আনে।’
সকালে উৎসাহ, দুপুরে রাগ আর বিকেলে হতাশা—এই ছিল ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন নিয়ে ফেসবুক মেজাজের চিত্র ও চরিত্র। তবে ভোটের ফল যেহেতু এখনো প্রকাশ করা হয়নি, সেহেতু কোনো উল্লাসও চোখে পড়েনি। বিস্ময়কর হলো, দলমত-নির্বিশেষে অধিকাংশ ফেসবুকারই সিটি নির্বাচনকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে বলে মনে হলো না।
ফারুক ওয়াসিফ: প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন