শতবর্ষী আমগাছটি কাটার আগে ও কাটার সময়।
খবরটা পড়ে মনের অজান্তেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, ‘আহা রে!’ যতবার পদ্মা পেরিয়ে দক্ষিণের দিকে গেছি, পারলে থেমেছি তার কাছে। শতবর্ষ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে—বিরাট তার বিস্তার, গভীর তার শিকড়, অঢেল তার ছায়া। কত মানুষ এখানে ছোটবেলায় এসেছেন। তারপর বড় হয়ে সন্তানকেও দেখিয়ে নিয়ে গেছেন। হয়তো গল্প করেছে, ‘দ্যাখো, আমার ছোটবেলায়ও একে ছুঁয়েছি, আজ তুমিও চড়ছ এর গায়ে, হয়তো তোমার সন্তানও এসে পাবে একে।’ কিন্তু আমাদের দেশে শতবর্ষ কিছুই বাঁচে না যেন। না মানুষ, না প্রতিষ্ঠান, না আদর্শ, না স্বপ্ন। এমনকি একটা শতবর্ষী গাছকেও কেটে ফেলতে পারি আমরা, কেটে ফেলতে দিই আমরা, উদাসীন বসে থাকি আমরা।
ঢাকা থেকে যাওয়ার সময় গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী উপজেলার হিরন্যকানদি গ্রাম। গ্রামটি ঢাকা-মাওয়া-খুলনা মহাসড়কের বাম পাশে পড়বে। আরেকটু এগোলে ডান দিকে চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের বাড়ি। তার আগে উঁচু মহাসড়ক থেকে নেমে ১০০ গজ এগোলেই পড়বে বিশাল এক আমগাছ। এক শ শতকেরও বড় জায়গা নিয়ে ছড়ানো তার ডালপালা। গাছটির মগডাল অনেক উঁচুতে। প্রকাণ্ড তার গুঁড়ি। সবচেয়ে মনোহর হলো চতুর্দিকে ছড়ানো মাটিঘেঁষা ডাল। একেকটি ডালই তালগাছের গুঁড়ির মতো মোটা। মাটিঘেঁষা সব কটি ডাল যেখানে মিলেছে, প্রায় ১৫ ফুট উঁচুতে সেই জায়গাটা একটা মাচার মতো, দিব্যি দুই-তিনজন বসে থাকা যায়।
এসব কিছুই আর থাকবে না? শতবর্ষের সঞ্চয়কে নিমেষেই নস্যাৎ করে দেওয়া যায়?
গত অক্টোবর মাসের এক দুপুরে শেষবার সেখানে যাই। তিন দিকে গ্রামীণ জঙ্গল। আরেক পাশে ধানখেত। জঙ্গল থেকে ভেসে আসছে কুড়া পাখির ডাক। পাখি একজনা নয়, তিনজনা। তাদের একজন উড়ে এসে বসল আমগাছটার ওপরের দিকের ডালে। নিচে চড়ে বেড়াচ্ছে পাড়াবেড়ানি মুরগি-মহল। কী অদ্ভুত নির্জনতা।
শতবর্ষী এই আমগাছ আগে হয়তো একজনের মালিকানার জমিতেই ছিল। সেই একজনার মালিকানার জমিতে গাছটি বড় হয়েছে। সম্ভবত তার চেয়েও বড় হয়েছে পরিবার। পরিবার বড় হলে ভাগ হয়, এটাই এ যুগের রীতি। কাজেই জমির মালিকানাও ভাগ হয়েছে। ভাগের পর থেকেই গাছটি কাটার একাধিক চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু লোকবিশ্বাস, স্বপ্নে নিষেধ শুনে এবং যে প্রথম কুড়াল চালিয়েছিল তার রোগভোগ দেখে গাছ কাটা বন্ধ হয়। কিন্তু এখন দিনকাল বদলেছে।
পদ্মা সেতু হচ্ছে। সংলগ্ন মহাসড়ক আরও প্রশস্ত হবে। গ্রামটির পেছন দিয়ে চলে গেছে পদ্মাসেতুর সঙ্গে মোংলা বন্দরের সংযোগকারী রেললাইন। শতবর্ষী আমগাছের প্রাঙ্গণ ঘেঁষেই চীনা ঠিকাদারি কোম্পানির বিরাট ক্যাম্প। উন্নয়ন হবে আর জমির দাম বাড়বে না, তা হয় না। জমির দাম যতই বাড়বে ওই জমির শরিকের কোন্দলও ততই বাড়ার কথা। সেই কোন্দল মেটানোর সহজ পথ হলো, জমি বেচো, টাকা ভাগ করো। যে আমগাছ ফল দেয় না, টাকা দেয় না, তাকে বাঁচিয়ে কী লাভ? শতবর্ষী বয়সের কী আর কোনো বাজারমূল্য আছে? বরং গাছ কেটে কাঠ হলে সেটা বেচা যায়। উন্নয়নের বন্ধুদের কাছেই বৃক্ষ মানে প্রাণ নয়, স্মৃতি নয়, বৃক্ষ মানেই কাঠ। আর জমি মানেই টাকা। বিটিভি যুগের একটি জনপ্রিয় নাটকের সংলাপ এখনো মনে আছে, ‘টাকাই মাটি, মাটিই টাকা’। শতবর্ষী মহিরুহের চাইতে ওই মাটির মূল্য তাই বেশি।
সবই না হয় হলো। কিন্তু ফরিদপুরের জেলা প্রশাসনসহ কেউ কি ছিল না জায়গাটিকে যথাযথ ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে রক্ষা করে? উপায় ছিল, আইন ছিল কিন্তু রক্ষক পাওয়া গেল না। বাংলাদেশ পর্যটন সংরক্ষিত এলাকা ও বিশেষ পর্যটন অঞ্চল আইন, ২০১০–এ বলা আছে, ‘বাংলাদেশ পর্যটন আইনের ৪। (১) পর্যটন শিল্প রহিয়াছে অথবা পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনা রহিয়াছে এমন কোন এলাকাকে চিহ্নিতকরণ ও সংরক্ষণ করা প্রয়োজন হইলে সরকার, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, উক্ত এলাকাকে পর্যটন সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করিতে পারিবে। (২) এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে সরকার, বিধি দ্বারা, পর্যটন সংরক্ষিত এলাকায় যে কোন ধরণের কার্যক্রমে বিধি-নিষেধ আরোপ করিতে পারিবে।’
জায়গাটি স্থানীয়ভাবেই নয়, জাতীয়ভাবেই পরিচিত ছিল। গণমাধ্যমে এর সুখ্যাতি বারবারই করা হয়েছিল। সরকার ওই জায়গার কাছের মহাসড়কে বড় করে স্থানটির দিকনির্দেশিকাও বসিয়ে রেখেছিল। স্থানটি রক্ষায় আইনও ছিল। এটি প্রাকৃতিক ও সাংষ্কৃতিক ঐতিহ্যের কেন্দ্র হিসেবে প্রসিদ্ধও ছিল। পর্যটন আইনের সকল শর্ত পূরণ করেই জায়গাটি সরকার তথা ফরিদপুরের জেলাপ্রশাসন উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে জায়গাটি অধিগ্রহণ করতে পারতো। কিন্তু সকলই গরল ভেল। গাছটি কাটাই বহাল আছে।
আমগাছটি দেখতে প্রতিদিন অনেকেই আসত। শিশুদের নিয়ে আসতেন বড়রা। সেই সব শিশুর চোখের বিস্ময়, মুগ্ধতার চাইতে সুন্দর আর কী হতে পারে? ভয়ে ভয়ে তারা গাছটির নিচু ডালে উঠত, বসে ছবি তুলত। তাদের মনে স্মৃতি তৈরি হতো, গল্প তৈরি হতো, সেই গল্প তারা কতজনকে করত, কতজনকে সেই গাছে ওঠার ছবি দেখিয়ে বাহাদুরি ভাব নিত—সেসব কিছুই আর থাকবে না। থাকবে শুধু ভবন, সড়ক, সেতু আর ব্যবসায়ী মন।
এভাবে এগিয়ে যেতে যেতে, উন্নয়নের উঁচু তলায় উঠতে উঠতে দরকারের সময় পায়ের তলায় মাটি পাব তো?
ফারুক ওয়াসিফ: প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ও লেখক।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন