অপেক্ষা

লিখেছেন লিখেছেন আরিফা জাহান ১৭ মে, ২০১৭, ০৮:৪৩:৩২ রাত

চুপচাপ বিষণ্ণ ক্লান্ত এক বিকেলে আমি লাইব্রেরি থেকে ফিরছিলাম কারাতাই এলাকার রেললাইনের পাশ ঘেঁসে নীরব রাস্তাটা ধরে ।

অনেক সুনসান, শেষ বিকেলের ক্লান্ত রোদ যেন নিজেকে এলিয়ে দিয়েছে গাছের সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে ।

সারাদিন শেষে ক্লান্ত আমিও ডরম এর দিকে হাঁটছিলাম ধীর গতিতে।

পেছনে কারো পায়ের আওয়াজ পেয়ে তাকিয়ে প্রথমে থমকে যাই!

আপাদমস্তক লাল ! পোশাক- মুখে লাল রং, হাতে লাল লাঠি ,গলায় শিকলের মত অদ্ভত মালা, কানে লাল দুল !

ভয় পেয়ে যাই ।

এই নির্জন রাস্তায় এই লাল চিজ এলো কোত্থেকে !

ভয় পেলেও আমি আমার গতিতে হাঁটতে থাকি ।

খেয়াল করি সে আপনমনে হেঁটে যাচ্ছে । কোন দিকে তার খেয়াল নেই ।

হাতের লাঠিটায় রাস্তায় ঠক ঠক শব্দ তুলে সে এগিয়ে যাচ্ছে ।

তার হাঁটায় কেমন যেন একটা নিরীহ ভাব থাকলেও তার এই অদ্ভত সাজ আর কুঁচকানো ভ্রূ দেখে আমার হাত পা কেমন জানি শিরশির করে উঠে ।

মনে হয় ভয়ঙ্কর এক তান্ত্রিক ! যার সঙ্গে আঁতাত আছে বিভিন্ন অশরীরী কোন আত্মাদের !

এটা নিছকই উনাকে দেখে আমার উদ্ভট চিন্তা বিলাসী ভাবনা ছাড়া কিছুই না ।

পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় তার লাল রঙের ফাঁক দিয়ে তাকে দেখে আন্দাজ করি মধ্যবয়স্ক একজন মহিলা ।

এরপর প্রায়ই আমি তাকে দেখেছি এবং দেখি ।

পার্কে, বাসস্টপেজে, এমনকি আমাদের ইউনিভারসিটি এলাকায়ও ।

একি ড্রেসে, একি সাজে, একি ভঙ্গিতে !

পরিচিতদের জিজ্ঞেস করি এই লালবানুর কাহিনী কি ?

একেকজন একেকরকম বলে ।

কেউ অনুমান করে বলে আবার কেউ তার সম্পর্কে শোনা কাহিনী বলে ।

আজ লোকাল বাসে করে ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে উনাকে দেখি ।

মনে মনে ঠিক করি আজ যেম্নেই হোক উনার সাথে দুইটা কথা হলেও বলব ।

বাস থেকে নেমে উনার পিছু পিছু হাঁটি । তারপর সাহস সঞ্চয় করে উনার পাশাপাশি যাই এবং যথাসম্ভব হাসিমুখে আন্তরিক ভঙ্গিতে কথা বলার চেষ্টা করি ।

''' মেরহাবা !

উনি হেঁটেই যাচ্ছেন । আমি আবার গলা খাঁকারি দিয়ে বলি '' মেরহাবা !

উনি উনার চিরায়িত কোঁচকানো ভ্রূ নিয়ে আমার দিয়ে তাকায় । ভিতরে ভিতরে ঘাবড়ে গেলেও হাসিমুখ করে উনাকে বলি ''কেমন আছেন?

উনি সামনের দিকে তাকিয়ে বলে '' ভালো '' খুব স্বাভাবিক গলা । অন্যান্য সাধারন দশটা টার্কিশ মধ্যেবয়স্ক মহিলাদের মতই ।

''আপনার সাথে একটু কথা বলতে পারি ?

উনি বলে '' কি কথা ?

'' মানে আপনাকে আমি অনেকদিন ধরেই দেখছি । আপনি কি কোনিয়াতেই থাকেন ?

'' আর কোথায় থাকবো ? তুমি কে ?

'' আমি আরিফা , বাংলাদেশ থেকে এসেছি , এখানে পড়ি । আমিও কোনিয়াতেই থাকি ।

উনি বলে ''ও

উনি আর কোন কথা বলে হাঁটতে থাকে পাশাপাশি আমিও ।

'' আমি আপনাকে প্রায়ই দেখি এবং সব সময় দেখি আপনি সব কিছুই লাল ব্যাবহার করেন । কেন ?

উনি আমার দিকে তাকিয়ে হেসে দেয় । এই প্রথম আমি উনার মাঝে একজন স্বাভাবিক মানুষের ছায়া দেখি ।

উনি নিষ্প্রাণ গলায় উত্তর দেয় '' আমার ভাল লাগে

আমি জিজ্ঞ্রস করি '' নাম কি আপনার ?

উনার উত্তর '' সুলতান উজযান ।

কোন কারন ছাড়াই কেন জানি উনার প্রতি খুব মায়া লাগে । আমি জিজ্ঞেস করি '' চা খাবেন ?

''কেন ?

আমি বলি '' আপনাকে খাওয়াতে ইচ্ছে করছে ।

উনি আবার হেসে বলে ''খাওয়া যায় ।

আমি পাশের দোকান থেকে চা না নিয়ে কফি আর সাথে চকলেট কিনি , উনি পাশে দাঁড়িয়ে থাকে ।

উনি চকলেট নেননি শুধু কফি ।

( আমি মনে মনে হাসি এই ভেবে যে, আমাদের দেশে এইভাবে যেচে কাউকে কিছু খাওয়াতে গেলে পাব্লিক আমারে অজ্ঞান পার্টির সদস্য বানায়া পিটাইয়া অজ্ঞান করত এতক্ষনে । উনি কত সহজমনে আমাকে বিশ্বাস করেছে । সত্যিই ভীষণ মায়া হয় )

ছবি তোলার জন্য ব্যাগ থেকে ফোন বের করে দেখি চার্জ শেষ !

উনাকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হচ্ছিল । কিন্তু উনার দেখি কোন কিছুতেই কোন আগ্রহ নেই ।

উনার সাথে বেশি কথা জমানো যায়নি ।

আমি ফিরে আসি ।

রুমমেটের সাথে ওর গল্প করি । রুমমেট জানায় এই মহিলা ২৫ বছর ধরে নাকি এইরকম গেটআপে থাকে।

ওর সম্পর্কে শোনা অনেক কাহিনীও শুনায় এবং বলে যে ওর সম্পর্কে তুমি নেটেও অনেক তথ্য পাবে ।

সত্যি সত্যি নেটে সার্চ দেয়ার পর অনেক কিছুই জানতে পারি এই রহস্যময় ''লালবানু '' সম্পর্কে ।

দীর্ঘ সময় ধরে ওর এই অদ্ভত বেশ আর একাকী থাকার পেছনে যে সত্য গল্পটা পাই তাতে সত্যিই আমার চোখে জল আসে !

১২ বছর বয়সের এক দুরন্ত ফুটফুটে কিশোরি ছিল এই সুলতান উযজান । তখন তাকে পাগলের মত একজন ভালবেসেছিল এবং সেই প্রেমিকের সাথেই তার বাগদান হয় । এরপর সতের বছর বয়সে তার বিয়ে হয় ভালোবাসার মানুষটার সাথে । শুরু হয় তাদের সুখের সংসার । দীর্ঘ বিশ বছরের সংসারে কোন সন্তান না হওয়ায় তার ভালোবাসার মানুষটি তাকে ফেলে চলে যায় এবং অন্য একজনের সাথে ঘর বাঁধে !

এই ঘটনায় প্রচণ্ড মানসিক আঘাতে ভেঙ্গে পায় সুলাতান উযজান! প্রিয়তমের চলে যাওয়া মেনে নিতে না পেরে অসুস্থ থাকে দীর্ঘদিন । এরপরও সে তাকে রেখে চলে যাওয়া মানুষটা সম্পর্কে কোনদিন নেতিবাচক কথা বলেনি । এমনকি আজো সে বলে ' তার একটা বেবি হলে তার স্বামী চলে যেত না "

কি নিস্পাপ আর সরল স্বীকারোক্তী !

তার ভালবাসার মানুষটা তাকে ছেড়ে চলে গেলেও সে তার ভালবাসাকে অশ্রদ্ধা করেনা এখনো !

তার স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পর থেকেই সে এই অদ্ভত সাজ শুরু করে । সব লাল ।

এবং তার এই কাপড় সে নিজেই সেলাই করে ।

সুলতান উজযান তার ভাইয়ের পাশের বাড়িতে থাকে । সে তার বাড়িটা সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে ।

সে তার বাড়িটাকে ভীষণ ভালবাসলেও সে দিনের বেলা কখনোই বাড়িতে থাকে না ।

ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে প্রতিদিন এই লাল পোশাক, লাল মেকআপ আর লাল অলংকার পরে বেরিয়ে পরে ফেরে সেই সন্ধ্যায় ।

তাকে কনিয়ার বিভিন্ন পার্কে, মার্কেটে, এমনকি কয়েকবার উনাকে আমি বড় বড় মসজিদের পাশেও দেখেছি ।

অপরিচিতরা তাঁকে দেখে ভয় পায় কিন্ত

যারা তাকে চিনে জানে তারা সবাই তাকে ভালবাসে ।



হঠাৎ আমার মনে পড়ল অনেক বছর আগে দেখা একটা বিখ্যাত মুভি '' টাইটানিকে'' এর নায়ক জ্যাক ( লিওনারদ দিক্যাপ্রিও ) এর ছবি আঁকার কথা । যে বিভিন্ন ধরনের চরিত্রের ছবি আঁকত । তার মধ্যে সে একটা ছবি এঁকেছিল এরকম যে '' এক মহিলা তার জমানো সব অলংকার পরে সেজেগুজে প্রতি সন্ধ্যায় তার প্রিয়জনের অপেক্ষা করত । কিন্ত তার সেই প্রিয় মানুষটা কোনদিন ফিরে আসেনি !

সেটা ছিল তার নিস্ফল প্রতীক্ষা !











বিষয়: বিবিধ

১৯৬৭ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

383015
১৮ মে ২০১৭ রাত ০৩:১৪
আব্দুল মান্নান মুন্সী লিখেছেন : ভালোবাসার মানুষরাও একটা সময় এসে স্বার্থপর হয়,যা সহ্য় করা অনেকের ক্ষেত্রেই সম্ভব হয়ে উঠেনা,মানুষের কষ্টগুলি যখন দেখি নিজের না বলা কষ্টগুলো গৌন মনে হয়,ভালোই হলো আপনাকে পেয়ে পড়া যাবে আপনাকে। Rose Rose অনেক ধন্যবাদ।
১৮ মে ২০১৭ রাত ০৮:০৮
316381
আরিফা জাহান লিখেছেন : আপনাকেও ধন্যবাদ কষ্ট করে পড়ার জন্য ।
383020
১৮ মে ২০১৭ দুপুর ০৩:১৪
আবু জারীর লিখেছেন : স্বন্তান না হওয়ায় আমার এক বন্ধুর মা তার বাবাকে দ্বিতীয় বিবাহ করিয়েছিল। কিন্তু আল্লাহর কি কুদরত যে তার দ্বিতীয় মায়ের সান্তান হওয়ার আগেই সে তার মায়ের কোল জুড়ে দুনিয়ায় এসেছিল।
১৮ মে ২০১৭ রাত ০৮:১০
316382
আরিফা জাহান লিখেছেন : হুম !আসলে এসব ব্যাপারে ভাগ্যের সবটাই আল্লাহর হাতে ।
385077
০৫ এপ্রিল ২০১৮ সকাল ১১:১২
ঘুম ভাঙাতে চাই লিখেছেন : কদিন ধরে মন খুব খারাপ। সিরিয়া, ফিলিস্তিন সবশেষ আফগানিস্তানের নিউজ দেখলাম। যাওয়ার সময় যেমন বাংলাদেশ রেখে গিয়েছিলেন সেটা বদলে গেছে। হত্যা, ধর্ষণ কেমন জানি দমবন্ধ করা একটা সময়। আপনার গল্পটা কষ্টের হলেও সুন্দর, ভিন্ন কিছুর গল্প। সব মানুষের হয়ত এমন কিছু গল্প থাকে। হিউম্যান বডির নানান জিনিস বুঝার জন্য ডেড বডি কেটে দেখতে হয় আমাদের তখন খুব খারাপ লাগে এই ডেড বডিটাও একটা সময় আমার মত জীবন্ত ছিল, তারও কিছু গল্প ছিল। আসলেই মানুষের জীবন অদ্ভুত।
১৪ এপ্রিল ২০১৮ বিকাল ০৫:৪৫
317561
আরিফা জাহান লিখেছেন : পৃথিবীতে বিচিত্র মানুষের ভিড়ে জীবনের গল্পগুলোও অনেক অদ্ভুত ।
মনকে শক্ত রাখুন ।
ধন্যবাদ ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File