হাসান ফেরদৌসি - ২
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ০৩ অক্টোবর, ২০১৭, ০৫:২১:২৩ বিকাল
৩
শ্রাবণ মাস। প্রতিবছর শ্রাবণ মাসে লম্বা খরা হয় তখন মাছ ধরার ধুম পড়ে যায়। খরার প্রথম পর্যায়ে মাঠের উর্ধ্বাংশের ক্ষেতগুলি শুকাতে থাকে আর মাছ মারা পড়তে থাকে। ধীরে ধীরে মাঠের নিন্মাংশ পর্যন্ত শুকিয়ে যায় আর প্রচুর মাছ মারা পড়ে। ফেরদৌসিদের বাড়ির দক্ষিণের মাঠটি ক্রমশ দক্ষিণ দিকে ঢালু হয়ে পার্শ্বস্ত খালে গিয়ে মিশেছে। খরা শুরু হয়েছে আর পাড়ার ছেলেরা দল বেধে মাছ ধরতে নেমেছে। দুপুর বেলা হাসানও মাছের লোভে মাঠে নামল। তার অভিজ্ঞতা আছে খরার সময় মাছ এসে গাছ বা কোন কিছুর ছায়ায় আশ্রয় নেয়। মাঠের প্রায় মাঝামাঝিতে একটা বড় আম গাছ আছে, সে ঐদিকে চলল। গিয়ে দেখে তো তার মাথা ঘুরিয়ে গেল, গাছের দু’পাশের ক্ষেতে যতটুকু ছায়া পড়েছে ততটুকুতে আর মাটি দেখা যায় না, শুধু মাছ আর মাছ, ইঞ্চি দুয়েক পানির মধ্যে কিলবিল করছে। ছেলেরা সব মাঠের উজান দিকে মাছ ধরছে, এদিকে এখনো কেউ আসেনি।
মধ্যাহ্ন সুর্য অগ্নি বর্ষণ করছে, পৃথিবী গ্যাস চুল্লির ন্যায় তাতিয়ে উঠেছে, পানি উত্তপ্ত কড়াইয়ের তেলের মত গরম। হাসান মাছ দেখে সম্বিত হারিয়ে ফেলল। সে শশব্যস্ত হয়ে ক্ষেতে নেমে পড়ল আর মনে হল যেন পা পোড়ে যাচ্ছে কিন্তু সে দিকে খেয়াল করার মত মানসিক অবস্থা তার ছিল না। সে দ্রুত ক্ষেতের কাদা তুলে তুলে ছায়ার পাশ দিয়ে অর্ধ চন্দ্রাকারে আল বাধল বা বেষ্টনী দিয়ে মাছ আটকাল। একটা শেষ করে অপর পার্শ্বের ক্ষেতে গিয়ে একইভাবে বেষ্টনী দিল। তারপর পাত্র আনার জন্য বাড়িতে যেতে চাইল কিন্তু সাহস পেল না, অন্য ছেলেরা যদি এসে দখল করে নেয়। কাজেই সে অগ্রসর হয়ে ফেরদৌসিকে ডাকতে লাগল কিন্তু সে শুনে না। গলা ছেড়ে চিৎকার করে ডাকতে লাগল, অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পর বেরিয়ে এল। তখন হাসান বলল, একটা বাটি আর একটা বালতি নিয়ে আয়।
ফেরদৌসি দৌড়ে গিয়ে সেগুলি নিয়ে হাজির হল। গাছ তলায় এসেই সে লাফিয়ে উঠল, মাছ ধরার জন্য হুমড়ি খেয়ে ক্ষেতে পড়ল কিন্তু পানির জন্য একটাও ধরতে পারল না। হাসান তাড়া দিল, আরে মাছ তো লাফিয়ে চলে যাচ্ছে, তুই আলে দাড়া আগে পানি সেচ দিয়ে নেই। হাসান পানি সেচতে লাগল। ফেরদৌসি মাছ দেখে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, বারবার নেমে পড়ে কিন্তু ধরতে পারে না। হাসান বলল, তুই মাছ ধরতে পারবি না, সেচ দে আমি ধরি। হাসান মাছ ধরা শুরু করল। পুঁটি, গুতি, চিকরা, কৈ, টাকি কিছু কিছু শিং মাগুরও আছে। শীঘ্রই বালতি ভরে গেল। সে ফেরদৌসিকে বলল, তুই লক্ষ্য রাখিস কোন ছেলে যেন এদিকে না আসতে পারে, আমি দৌড়ে গিয়ে এগুলি রেখে আসি। এভাবে এক পাশের ক্ষেতে মাঝারি বালতি দিয়ে তিন বালতি মাছ ধরল। তারপর গেল অপর পাশের ক্ষেতে। পানি সেচ দিয়ে মাছ ধরা শেষ করতে সন্ধ্যা গড়িয়ে গেল। এ ক্ষেতেও তিন চার বালতি মাছ পাওয়া গেল। রাত্রে তারা কাদায় লুটোপুটি হয়ে বাড়িতে ফিরল।
মাছে বাড়ি ভর্তি, জেতা মাছ জিইয়ে রাখা হল। বাকি মাছ কেটে শুটকি দেয়ার ব্যবস্থা করা হল। ফেরদৌসির বোনেরা সবাই মিলে অনেক রাত পর্যন্ত মাছ কুটল। পরদিন সকালে হাসান আবার মাঠে নামল কিন্তু তখনো পানি গরম হয়নি, মাছেরও দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়নি। দুপুরে আবার গেল কিন্তু আজ আর কোন গাছের ছায়া নাই। অগ্নিবৎ উত্তপ্ত পানির দহন থেকে বাচতে মাছগুলি একটু শীতল আশ্রয় বা ছায়ার আশায় ক্ষেতের আলের পাশে এসে ভিড় জমায়। কিছু আলের পাশে ঘাসের নিচে এসে লুকায়। কিছু গরম পানি থেকে গড়িয়ে উঠে শুকনা স্থানে ঘাসের নিচে লুকায়। আর এই সুযোগে সবাই মাছ ধরে। হাসানও এভাবে ঘোরে ঘোরে মাছ ধরতে লাগল। ফেরদৌসিও স্কুল থেকে এসে তার পিছু নিল। কিন্তু এ পদ্ধতিতে বেশি মাছ ধরা যায় না। এভাবে কয়েকদিন পর্যন্ত মাছ ধরা চলল। ফেরদৌসিদের কামলা ছেলেটাও কাজের ফাকে ফাকে কিছু কিছু মাছ মারে।
হাসান বেশি মাছ ধরার কৌশল সম্পর্কে চিন্তা করছে, হঠাৎ তার একটি পুর্ব অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ল। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই মাঠে নামল। প্রচণ্ড খরায় মাঠের উজান দিক শুকিয়ে গেছে, ভাটির ক্ষেত গুলিতে পানি আছে। সে খোঁজে খোঁজে একটা ক্ষেত আবিস্কার করল। এটা দক্ষিন দিকে ঢালু। সে ক্ষেতের দক্ষিণ পশ্চিম কোনটা কাদা তুলে আল বেধে ছোট্ট একটা মান্দারের আকৃতি দিল। তারপর বাড়িতে গিয়ে ফেরদৌসিকে নিয়ে কিছু কলা পাতা, গাছের ছোট ছোট ডাল এনে কৃত্রিম মান্দারটায় ছায়ার ব্যবস্থা করল এবং চার পাঁচটা মুখ করে দিল। সকালে খাওয়ার পর গিয়ে দেখল কোন মাছ আসেনি। সে বাড়িতে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। দুপুরে খাওয়ার পর আবার গেল। দেখে তো তার চক্ষু চড়ক গাছ। আশ পাশের ক্ষেতের সব মাছ মান্দারের ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছে। সে দৌড়ে বাড়িতে গিয়ে ডিশ বালতি ও ফেরদৌসিকে নিয়ে আসল। তারপর মান্দারের মুখ বেধে পানি সেচ দিয়ে মাছ ধরা শুরু করল। রাত অবধি মাছ ধরল, এদিনও ছয়- সাত বালতি মাছ ধরল।
দুটি বালক বালিকা সারা দিন মাঠে মাঠে ঘোরে আর মাছ ধরে। এভাবে তারা পরস্পর ঘনিষ্ঠ হতে থাকে, একে অন্যের মাঝে বিলীন হতে থাকে কিন্তু তাই বলে তাদের মধ্যে ঝগড়ার কমতি নাই। কাইজ্যা করে হাসান গাল ফুলিয়ে থাকলে ফেরদৌসি রসালো কণ্ঠে ডাকে ‘ভাইয়্যা’ তখন হাসানের গাল চুপসে যায়। আর ফেরদৌসি গাল ফুলিয়ে থাকলে হাসান ডাকে ‘আপুমনি’ তখন তার ঠোঁট ফাক হয়ে দাঁত ঝিলিক দিয়ে উঠে।
এত মাছ তো খাওয়া যায় না, সবাই শুটকি দেয়। প্রত্যেক বাড়িতে যেন শুটকির আড়ত বসেছে। মাছের গন্ধে কারো বাড়িতে যাওয়া যায় না। প্রচণ্ড খরা ও মাছের দুর্গন্ধে সর্দি- জ্বর, উদরাময় ইত্যাদি রোগ দেখা দিয়েছে। এদিকে মাদরাসার হুজুররা মাস্টারের কাছে বিচার দিয়েছে, হাসান মাদরাসায় যায় না, সারাদিন মাঠে মাঠে ঘোরে আর মাছ ধরে। তিনি বাড়িতে এসে হাসানকে খুব ধমকালেন আর ফেরদৌসিকে বললেন ‘রোদে রোদে গিয়ে মাছ মারিস অসুখ করলে বুঝতে পারবি। স্ত্রীর কাছে কৈফিয়ত চাইলেন, ওরা রোদে রোদে ঘোরে কেন, হাসান মাদরাসায় যায় না কেন। অগত্যা তাদের মাছ মারা বন্ধ হল, তবে কামলা ছেলেটা কিছু কিছু মাছ মারতে লাগল। কিন্তু ফেরদৌসির মন তো মানে না, সে প্রতিদিন স্কুল থেকে এসে হাসানকে ফুসলায়, ভাইয়্যা চল না মাছ ধরতে যাই। হাসান বুঝায় ‘আরে পাগলি মাছ মারা গেলে আব্বা মারবে। এদিকে হাসানেরও মাছ ধরার নেশা ধরে গেছে। অবশেষে তিনদিন পর বালতিটা নিয়ে তারা গোপনে বেরিয়ে পড়ল।
দীর্ঘ খরায় মাঠ শুকিয়ে খা খা করছে। একদম ভাটিতে খাল পারের কয়েকটা ক্ষেতে পানি আছে, তারা সেদিকেই চলল। কিছুদুর থেকে দেখা গেল খাল পারের ক্ষেতগুলি যেন কেউ টুকরা টুকরা রুপা দিয়ে ঢেকে দিয়েছে। প্রত্যেকটা ক্ষেত যেন শ্বেতপদ্মের বাগান, অপুর্ব সুন্দর দেখাচ্ছে। আসলে পুঁটিমাছ মরে একাকার হয়ে পানির উপর ভেসে আছে। তাতে সুর্য কিরণ প্রতিফলিত হয়ে রুপালি আভা ছড়াচ্ছে। কিছু মাছ কয়েক দিন আগেই মরে পচে গলে গেছে। কিছু আধা পচা, কিছু টাটকা সদ্য মরেছে, কিছু মরতেছে, সর্বত্র যেন মাছের মহাশ্মশান। কাছে গিয়ে ফেরদৌসি ক্ষেতের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল, মাছ দেখে তার আর হুস নাই। সে পচা, আধা পচা মাছ কুড়িয়ে বালতিতে রাখতে লাগল। হাসান সেগুলি ফেলে দিয়ে ধমক দিল, ‘আরে বোকা এসব মাছ খাওয়া যাবে না, যেগুলি এখনো জেতা দৌড়াদৌড়ি করতেছে সেগুলি ধর। কিন্তু কে শুনে কার কথা, ফেরদৌসি মরা মাছ কুড়িয়ে কুড়িয়ে জামার কোচায় রাখতে লাগল। হাসান জোর করে সেগুলি ফেলে দিয়ে বলল ‘জেতা মাছ ধর। ফেলে দেয়ার কারণে সে রাগে গাল ফুলিয়ে ভুত হয়ে থাকল।
এ ক্ষেতগুলি একদম ভাটিতে এবং খালের পাড়ে, এগুলিতে ভাল ভাল মাছ থাকে। কৈ শিং মাগুর শৌল টাকি ইত্যাদি জাতের মাছ জলাগ্নিতে সিদ্ধ হয়ে কাতরাচ্ছে, উল্টে বুক ভাসিয়ে আছে, কিলবিল করে মন্থর গতিতে যাচ্ছে, আলের কিনারে কিনারে ভিড় জমিয়েছে। অল্পক্ষণেই তারা মাছ ধরে বালতি ভরে ফেলল। হাসান বলল, ফেরদৌসি চল তাড়াতাড়ি বাড়িতে যাই গা, আব্বা এসে আমাদের কে না পেলে মারবে। তারা রওয়ানা হল কিন্তু ফেরদৌসি জেদ ধরল সে মাছ নিয়ে যাবে, অথচ মাছ ভর্তি বালতি সে ঠিকমত তুলতেই পারে না। তাকে বালতি না দিলে যাবে না, দাঁড়িয়ে থাকে। অগত্যা হাসান তাকেই দিল। সে গায়ের জোরে বালতি তুলে দুতিন কদম যেতেই আলে পা পিছলে পড়ে গেল। পড়ে গিয়েই ভ্যা ভ্যা করে কান্না জুরে দিল আর বালতি পানিতে পড়ে মাছ চলে যেতে লাগল।
তা দেখে হাসানের রাগ উঠে গেল, সে ক্ষ্যাপা গলায় বলল, এই ভেটকি আগেই তো বলেছিলাম তুই নিতে পারবি না, এখন তো মাছগুলি ছেড়ে দিলি, আবার ছাগলের মত ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছিস। ভেটকি ডাকলে ফেরদৌসি খুব রেগে যায়। রাগের চোটে সে হাসানের দিকে কাদা ছুড়তে লাগল। ‘ভেটকি মুখি অন্যায় করলি তুই এখন আমাকে কাদা দিচ্ছিস’ বলে হাসানও কাদা দিতে লাগল। শুরু হল দু’জনে কাদা ছোড়াছোড়ি। একবার হাসান দু’হাতে একদলা প্যাক নিয়ে ছোড়ে মারল। আর তা ফেরদৌসির মাথায় পড়ে সমস্ত মাথা ও মুখ মণ্ডল ঢেকে গেল। এবার সে জোরে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির দিকে ছুটল। হাসান দৌড়ে গিয়ে তার হাত ধরে বলল, চোখে তো কিছুই দেখবি না, আয় কাদা ধুয়ে দেই কিন্তু সে ঝটকা মেরে হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে যেতে লাগল। হাসান জোর করে ধরে মাথা ও মুখের প্যাক কিছুটা মুছে দিল। তারপর বালতির কাছে এসে দেখল জেতা মাছ গুলি চলে গেছে। সে অবশিষ্ট মাছ তুলে আরো কিছু মাছ ধরে বালতি ভরে বাড়ির দিকে রওয়ানা করল। বাড়িতে পৌছতেই মা বললেন, এই শয়তান ওকে কাদা দিছিস কেন? হাসান রাগতস্বরে বলল ‘আমি দিছি, ওই তো আগে দিছে। তখন মা দু’জনকেই ধমক দিলেন। তারপর উভয়কেই টিউবওয়েল চেপে সাবান দিয়ে ডলে মলে গোসল করিয়ে দিলেন।
ফেরদৌসি ছিল ভয়ঙ্কর জেদি, প্যাক দেয়ার ঘটনাটা সে ভুলতে পারল না। তার জেদ জাগল যেভাবেই হউক হাসানকে জব্দ করবে। সে পরিকল্পনা করতে লাগল, তার মাথায় একটা বুদ্ধি এল। বাড়ির পশ্চিমে তাদের একটা পতিত ভিটা আছে। সেখানে বিভিন্ন জাতের ফল ফলাদির গাছ। হাসান দুপুরে রান্না ঘরে খেতে বসেছে। ফেরদৌসি হাসতে হাসতে গিয়ে রসালো কণ্ঠে ডাকল, হাসান ভাইয়্যা, ভিটার পেয়ারাগুলি উত্তর পাড়ার ছেলেরা পেরে নিয়ে যাচ্ছে। চল আমরা পেরে নিয়ে আসি গিয়ে। অনেক বড় বড় পাকা পাকা পেয়ারা আছে। পেয়ারার কথা শুনে হাসানের লোভ জেগে গেল। জঙ্গলের গাছ সাধারণত উচু হয়। সে বলল, কিন্তু এত উচু গাছে উঠব কেমনে? - কেন মই নিয়ে যাব। হাসান খাওয়া শেষ করে গোয়াল থেকে মই নিয়ে রওয়ানা হল। ফেরদৌসি পেয়ারা আনার জন্য একটা ব্যাগ নিয়ে হাসানের পিছু পিছু যাচ্ছে আর মনে মনে বলছে, হারামজাদা হনুমান আজ তোকে সাইজ করব। হাসান যেমন রাগের সময় ফেরদৌসিকে ভটকি ডাকত তদ্রুপ সেও রাগের সময় হাসানকে হনুমান ডাকত। আসলে হাসানের একটা ডাক নাম ছিল, এই নামের সাথে একটা অতিরিক্ত অক্ষর যুক্ত করে সে হনুমান শব্দটি আবিস্কার করেছে।
হাসান গাছে উঠে কোটা (বাঁশ) দিয়ে গুতিয়ে বাড়ি দিয়ে পেয়ারা পাড়ে আর ফেরদৌসি কুড়িয়ে কুড়িয়ে ব্যাগে ভরে। তারপর যখন দেখল পেয়ারা পাড়া প্রায় শেষ, পাকা পেয়ারা আর নাই তখন সে গাছের গোড়া থেকে মইটা টেনে দূরে নিয়ে যেতে লাগল। হাসান দেখে বলল, ঐ ভটকি মই কোথায় নিচ্ছিস? ফেরদৌসি ফণিনীর মত ফনা তুলল, ঐ হারামজাদা হনুমান, মনে নাই তুই আমার মাথায় প্যাক দিছিলি, আজ বুঝাব মজা। মই দূরে ফেলে আমি চলে যাব, তুই গাছ থেকে নামতে পারবি না। আর তখন হামদু ভুত আর মামদু ভুত এসে তোর ঘাড় মটকে রক্ত খাবে। সবাই জানে এই জঙ্গলে দুইটা ভুত থাকে, একাকি কোন পোলাপান পেলে ঘাড় মটকে রক্ত খায়। আমাকে কাদা দেয়ার মজাটা আজ তোকে টের পাওয়াব। তারপর সত্যি সত্যিই সে মই দূরে ফেলে ব্যাগ নিয়ে চলে যেতে লাগল।
ভুতের কথা শুনে হাসানের মুতে দেয়ার উপক্রম হল, তার শরীর ঘামছে। সে আর্তনাদ শুরু করল ‘ফেরদৌসি আপা না আপা না, আমায় একা ফেলে যাস না, আমার খুব ভয় করছে। এই যে আমি কানে ধরছি আর কোন দিন তোকে কাদা দিব না। তোকে প্রত্যেক দিন দশটা করে লজেন্স কিনে দিব, ফুল তুলে দিব, ভেট এনে দিব, মাছ মারতে নিয়ে যাব। আপুমনি আপুমনি, মইটা দিয়ে যাও, আমার ভয় লাগছে। কিন্তু হাসানের আর্তনাদ শুনে সে মনের আনন্দে হাসছে আর দস্তুর মত হেঁটে যাচ্ছে। হাসান বুঝল, এই বিচ্ছুটাকে অনুনয় করে লাভ হবে না, সে ক্ষনেক চিন্তা করল, হঠাৎ তার এলাকার দুষ্ট পোলাপানের একটা খেলার কথা মনে পড়ল। সে দুষ্টের মত হাসল, রাখ ভেটকি তোকে সাইজ করব। তারপর সে উচ্চস্বরে ডাকতে লাগল, ফেরদৌসি ফেরদৌসি আরে বোকা তুই তো আসল পেয়ারাগুলিই ফেলে চলে যাচ্ছিস। আরে পাগলি দেখে যা, দেখে যা ঐ যে উত্তরের ডালের পেয়ারা গুলি কত বড় বড় আর পাকা।
ফেরদৌসি দুর থেকে চেঁচাল, সত্যি কইতাছস? – আরে হ হ তুই নিজেই দেখে যা। ফেরদৌসি পাকা পেয়ারার লোভ সামলাতে পারল না। সে স্থির করল, পাকা পেয়ারা গুলি নিয়ে চলে যাবে কিন্তু মই দিবে না। ফিরে এসে গাছ তলায় দাঁড়িয়ে চেঁচাল ‘কইরে পাকা শবরি (পেয়ারা)? হাসান বলল, আরে বোকা এতদুর থেকে দেখতে পাবি না এখানে এসে দাড়া’ বলে গাছ থেকে আঙ্গুলি নির্দেশে ঠিক তার নীচে একটা স্থান দেখিয়ে দিল। তারপর দীর্ঘ বিস্তৃত পত্রাচ্ছাদিত উত্তর মুখি ডালটার দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ঐ যে দেখ কত বড় বড় পাকা শবরি। ফেরদৌসি নির্দেশিত স্থানে দাঁড়িয়ে খুজতে খুজতে বলল, কইরে ভাল শরবী তো দেখি না। হাসান বলল, পাতার আড়ালে ভাল করে চেয়ে দেখ। ফেরদৌসি এবার চোখের পুত্তুলি বের করে পত্রাভ্যন্তর পর্যন্ত দৃষ্টি গেথে দিল। আর তখনি তার মাথায় তরল কিছুর পতন অনুভব করল। মাথায় হাত দিয়ে বুঝল পানি। উপরে তাকাল, হাসান মুত্র বিসর্জন করছে। আর ততক্ষনে মহা অশুচি দুর্গন্ধ মুত্র তার মাথা ও নাক মুখ বেয়ে অর্ধেক শরির ভিজে গেছে। সে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে উঠল। তারপর চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির দিকে ছুটল। ভুতের ভয়ে হাসান গাছে বসে বসে কাঁপতে লাগল আর অবতরনের উপায় খুজতে লাগল। হঠাৎ দেখল গাছের নিম্নাংশের একটা ডাল মাটির দিকে ঝুকে আছে। সে তাড়াতাড়ি গাছ বেয়ে নেমে ডালের অগ্রভাগ ধরে ঝুলে পড়ল। আর ডালটা নেতিয়ে গিয়ে তার পা মাটি স্পর্শ করল। এরপর তাড়াতাড়ি মই ও ব্যাগ নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে হামদু ও মামদু ভুতের কবল থেকে মুক্তি পেল।
ফেরদৌসি কলপাড়ে বসে বসে কাঁদছে, মা সাবান আনতে ঘরে গেছে। হাসান পেয়ারার ব্যাগটা রান্না ঘরে উবু হয়ে রাখতে গেল অমনি পেছন থেকে মা খপ করে ধরে পিঠে দুইটা কিল দিয়ে বললেন, এই শয়তান ওর গায়ে মুতেছিস কেন? হাসান ঝটকা মেরে হাত ফসকিয়ে দৌড়ে নিরাপদ দুরত্বে গিয়ে চেঁচাল, আমার কি দোষ, সেই তো আগে গাছ থেকে মই নিয়ে দূরে ফেলে দিয়েছে- যাতে আমি নামতে না পারি। মা এবার গিয়ে ফেরদৌসিকে দুইটা থাপ্পড় দিয়ে ‘তুই ওর মই নিলি কেন’ বলে গোসল করাতে লাগলেন। সে আবার ভ্যা ভ্যা করে কান্না শুরু করল আর মাও বকবক শুরু করলেন ‘তোদের জ্বালায় এখন আমার পাগল হয়ে দেশে দেশে ঘুরতে হবে। হাসান বলল, আমার কি দোষ সেই তো মই ফেলে দিয়ে বলল, এখন গাছে একা পেয়ে হামদু আর মামদু ভুত এসে তোর ঘাড় মটকে রক্ত খাবে, তখন আমি ভয়ে মুতে দিয়েছি। মা ওষ্ঠাধর চেপে বেয়ারা হাসিটা দমন করল। তারপর মুখটা কৃত্রিম কোপায়িত করে বলল, আরেক দিন যদি শয়তানি করবি তাহলে টের পাবি মজাটা। আমি বোরকা পড়ে সোজা বাপের বাড়ি গিয়ে বসে থাকব। তখন দেখব ভাত কোথায় খাস? হাসান ‘যান গা, তাতে আমার কি’ বলে হাসতে হাসতে বাইরে চলে গেল।
ফেরদৌসি পিচ্ছি হলে কি হবে তার জেদ ও ক্রোধ খুবই মারাত্মক। সে হাসানকে পেয়ারার জন্য গাছে তুলেনি, তুলেছিল তার মাথায় প্যাক দেয়ার বদলা নিতে কিন্তু এবার তো একেবারে মাথায় মুতে দিল। এটা তার সহ্যের অতীত, মনে তুসের আগুন জ্বলতে থাকে। তার জেদ আরো প্রকট হয়ে উঠে, যেভাবেই হউক এর প্রতিশোধ নিবে। তার সাধারণ অভ্যাস ছিল দুপুরে স্কুল থেকে এসেই সারাক্ষণ হাসানের সাথে লেগে থাকত, খেলাধুলা করত ঘুরাফেরা করত। সন্ধ্যায় গিয়ে ভাইয়্যার সাথে পড়তে বসত বটে কিন্তু কিছুক্ষণ খোচাখোচি করে চলে আসত। কিন্তু এবার অভ্যাসের পরিবর্তন হয়েছে, স্কুল থেকে এসে ছোট ভাইয়ের সাথে খেলা করে, বিকালে তার বোনেরা স্কুল থেকে আসলে তাদের সাথে থাকে। সন্ধ্যায় কখনো বোনদের কাছে, কখনো বাবার কাছে, কখনো মায়ের রুমে একাকি বসে বসে পড়ে।
এখন আর সে হাসানের কাছেও যায় না, কথাও বলে না। কিন্তু চোখের আড়াল বলেই মনের আড়াল নয়। হাসান একই সাথে তার প্রিয় বাঞ্চিত ও অবাঞ্চিত উভয়টাই। যতক্ষণ পর্যন্ত সে প্রতিশোধ না নিতে পারবে ততক্ষণ তার মনের জেদ মিটবে না। সে সুযোগ খুজতে থাকে। তাদের খাওয়ার নিয়ম হল, এশার পর ফেরদৌসির বোনেরা খাওয়া দাওয়া করে। বিশেষ ব্যাঞ্জন লুকিয়ে খাওয়ার জন্য মায়ের নির্দেশ মত সর্বশেষে হাসান খেতে যায়। অনেক সময় হাসানের আসতে দেরি হলে মা রান্না ঘরের কাজ শেষ করে পাশের ঘরে গিয়ে ঝাঁ-এর সাথে আড্ডায় মাতেন। হাসান এসে ডাক দিলে বেরিয়ে এসে ভাত বেড়ে দেন। নিয়মানুযায়ি হাসান এসে রান্না ঘরে গিয়ে মাকে পেল না। কয়েকটা ডাক দিল কিন্তু সাড়া নেই। খুজতে মায়ের ঘরে গেল কিন্তু নেই, ফেরদৌসি একাকি মায়ের বিছানায় উবু হয়ে বসে লিখছে।
হাসান বিছানায় বসল আর সাথে সাথে ‘ও বাবা গো মাইর্যা ফালাইছে’ বলে লাফিয়ে উঠে ডান হাতে ডান নিতম্ব চেপে ধরে চিৎকার করতে করতে ঘরময় নাচতে লাগল। চিৎকার শুনে মা বাবা ও বোনেরা দৌড়ে এল ‘কী হয়েছে, কী হয়েছে’ বলে হাসানকে জড়িয়ে ধরল। হাসান, ‘ফেরদৌসি আমারে মাইর্যা ফালাইছে’ চিৎকার করতে লাগল। আসলে সে যখন বসছে তখন ফেরদৌসি তার পাছার নিচে কলম ধরে দেয়, আর চাপে কলমের নীপ ডান নিতম্বে ঢুকে যায়। রক্তে পাছার লূঙ্গি অনেকাংশ ভিজে গেছে। মাস্টার মেয়েকে বেদম মারতে লাগলেন, তখন সে উঠে দৌড়ে পলায়ন করল। তারপর তিনি তাড়াতাড়ি মলম এনে লাগালেন। এরপর কখনো মেয়েকে কখনো লক্ষ্য না রাখার জন্য কর্ত্রিকে গালাগালি করতে করতে ঔষধ আনতে বাজারে ছুটলেন। মা হাসানকে বিছানায় শুইয়ে হাত পাখায় বাতাস করতে লাগলে। সবাই ফেরদৌসিকে গালাগাল করছে আর সে বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। এখন সে দুঃখিত এবং লজ্বিত, আসলে সে বুঝতে পারেনি হাসান এতটা ব্যাথা পাবে।
কিন্তু বেচারা হাসানের হল সমস্যা, কয়েকদিন পর্যন্ত সে বসতে পারেনি, চিৎ হয়ে শুইতে পারেনি, উপুর হয়ে বা কাত হয়ে শুয়ে ঘুমিয়েছে। এবার তার মনেও ক্ষোভ জমে উঠল। ফেরদৌসি তাকে এতটা কষ্ট দিয়েছে এর বদলা না নিলে কি চলে, এটা কাপুরুষতা হবে। কাজেই সেও উপায় খুজতে থাকে কিন্তু কোন পথ পায় না। সহসা একদিন দেখল মায়ের খাটের নিচে উদুর মারার ফাদ, সে হাসল। বিকালে নিরিবিলি সময় এসে ফাদের সিটকিনিটা লাগিয়ে রেডি করে দরজার কাছে রেখে চলে গেল। এদিন সে অনেক দেরি করে খেতে আসল যাতে মা পাশের ঘরে গিয়ে গপ্পের আড্ডায় বসে। ফেরদৌসিদের উত্তর দক্ষিণা বিশাল লম্বা ঘরটিতে পাঁচ ছয়টি রুম। সর্ব দক্ষিণের বহির্মুখি রুমটিতে হাসান থাকে, সাথের রুমে মাস্টার থাকে, মাঝের রুম গুলিতে মেয়েরা থাকে আর সর্ব উত্তরের রুমটি রান্না ঘরের কাছাকাছি, এতে মা ও ফেরদৌসি থাকে।
হাসান আস্তে আস্তে এসে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে চারদিকে দৃষ্টি বুলাল, মা রান্না ঘরে নেই, পাশের ঘরে তার কথা শুনা যাচ্ছে, আশেপাশেও কেউ নেই। সে মায়ের ঘরে গিয়ে উকি দিল, ফেরদৌসি একাকি দক্ষিন মুখি হয়ে গা ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে পড়ছে। সে নিচু হয়ে বসে ফাদটা হাতে নিয়ে বসাবস্থায় খাটের আড়ালে মাথা নিচু করে অগ্রসর হল। ফেরদৌসির জুতাটা সরিয়ে ঠিক জুতার জায়গায় ফাদটা রেখে চুপিসারে বেরিয়ে গেল। তারপর রান্না ঘরে গিয়ে ‘আম্মা আম্মা ভাত দিয়ে যান’ বলে চেচাতে লাগল। মা এসে ভাত বেড়ে দিলেন। যখন অর্ধেক খাওয়া হল তখনি ‘ও বাবারে, ও মায়ারে মইর্যা গেলাম’ ফেরদৌসির চিৎকার শুনা গেল। সবাই দৌড়ে গেল, হাসান আনন্দে লাফিয়ে উঠল, আজ মনের মত ইদুর ধরা পড়েছে। গিয়ে দেখল পায়ের পাতার দুই পাশে কলের দুই পাটি দাঁত বসে গেছে। আলতা লাগানোর মত পায়ের দুপাশ থেকে রক্ত ঝড়ে পড়ছে।
বাবা পা থেকে কল খুলে জিজ্ঞেস করলেন, এখানে এটা এল কোত্থেকে? ফেরদৌসি সুযোগ পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল ‘এটা ভাইয়্যা রেখেছে। হাসান শশব্যস্তে বলল ‘এই আমি রেখিছি তুই দেখেছিস, আমাকে ঘরে আসতে দেখেছিস? তখন বাবা বললেন ‘ওকে ঘরে আসতে দেখেছ? ফেরদৌসি আমতা আমতা করে দু’পাশে মাথা ঘুরাল। বাবা ধমকালেন ‘না, তাহলে ওকে দোষ দিচ্ছিস কেন? তারপর মেয়ের পায়ে মলম লাগালেন, হাসানের জন্য আনা ঔষধ খাওয়ালেন। এক ঔষধেই দুই অপরাধির চিকিৎসা চলল। এরপর স্ত্রীর দিকে কটমট করে তাকিয়ে ক্রোধ ঝাড়তে লাগলেন, তুমি করটা কি শুনি, কোথায় থাক, জিনিস পাতি কোথায় রাখ, তোমার কাজটা কি? ঐদিন ছেলেটা ব্যাথা পেল আজ মেয়েটা, তুমি তো দেখছি পোলাপান পালতে পারবে না’ তিনি স্ত্রীকে তিরস্কার করতে লাগলেন। মা জানেন এটা কার কাজ, এ জন্যই তিনি একেবারে বোবার মত নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকলেন।
হাসান আবার খেতে গেল। কিছুক্ষণ পর মা গিয়ে ক্ষণকাল গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন। তারপর বিষণ্ণ কণ্ঠে ‘তোরা যদি এমনই করতে থাকিস তাহলে সত্যি সত্যিই বলছি আমি কিন্তু বাপের বাড়ি চলে যাব’ বলে তিনি চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেলেন। মায়ের মত ফেরদৌসিও জানে এটা হাসানের কাজ, সে ভিতরে ভিতরে ফুলতে লাগল। এরপর থেকে দুটি বালক বালিকার মধ্যে খিটিখিটি ও খোচাখোচি চলতেই থাকল। মা ধমক দিয়ে বা দু’চারটা চড় থাপ্পড় দিয়ে একাকি এসব নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা করেন, কর্তাকে বা অন্য কাউকে বুঝতে দেন না। কিন্তু হাসান ফেরদৌসি মায়ের শাসন বারন থোরাই কেয়ার করে, তারা সাপ নেউলের কর্মকান্ড চালিয়েই গেল।
৪
ফেরদৌসিদের আট বোনের মধ্যে বড় তিন বোনের বিয়ে হয়েছে। বড় জামাই ইঞ্জিনিয়ার জামালপুর টাউনে থাকে, দ্বিতীয় জামাই খুলনায় চাকরি করে, তৃতীয় জামাই ব্যবসায়ি, জামালপুর টাউনেই থাকে। বড় মেয়ের নাম মাজেদা, এরা স্বামী স্ত্রী যেমন নিষ্ঠুর তেমনি দাম্ভিক ও স্বেচ্ছাচারী। ইঞ্জিনিয়ারের আত্মশ্লাঘা এতই প্রবল যে, সে সাংসারিক কোন কাজ কর্ম বা দায় দায়িত্ব পালন করে না, লজ্বা পায়। যেমন ব্যাগ নিয়ে হাট বাজারে যাওয়া, বাজার করা তার কাছে লজ্বার বিষয়। অন্যান্য বাবাদের ন্যায় বাচ্চাদের কোলে নিয়ে ঘোরাফিরা করা, স্কুলে নিয়ে যাওয়া লজ্বার বিষয়। বউ বাচ্চার জন্য কাপড় চোপড় কিনা, মার্কেট করা বা কোন কাজ করা তার কাছে খুবই লজ্বাকর। এতে তার আত্মমর্যাদা ফুটো হয়ে যায়। যদিও বড় বড় লোকেরা পরিবারের হাট বাজারসহ প্রয়োজনীয় সব কিছুই করে কিন্তু তার অহংবোধ এমনই চূড়ান্ত যে, তার সামনে পরিবার অতিশয় তুচ্ছ ও নগন্য। এই প্রবল আমিত্বের কারণে সাধারণ মানুষের সাথে সে মিশতে পারে না। তার কাজ হল অফিস করবে, তারপর জাপানি বাইকে চড়ে শহরময় হাওয়া খেয়ে বেড়াবে, মাঝে মধ্যে তাবলীগে যাবে- এই হল তার কাজ। কোন নব যৌবনা কুমারি যেমন তার তনু সম্পদ নিয়ে সদা শংকিত থাকে কখন কে দেখে ফেলে বা ছোয়ে দিয়ে অপবিত্র করে দেয় ইঞ্জিনিয়ারের অবস্থাও তদ্রুপ। সে সদা সতর্ক থাকে কখন কোন কথায় বা কাজে তার আত্মশ্লাঘা ফুটো হয়ে যায়।
ঘরে অনেক সময় বাজার সওদা থাকে না, কাপড় চোপড় থাকে না, বাচ্চারা কে কোথায় গেল খোজ থাকে না। এ নিয়ে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সব সময় খিটিখিটি লেগেই থাকে। মাজেদা কখনো বললে, ‘বাজারে যাও, সওদা নাই’ সে বলে ‘সংসারের এসব ঝক্কি ঝামেলা আমার দ্বারা হবে না বাপু, এসব দায়িত্ব তোমার। - তাহলে তোমার সংসারী কাজ কে করে দেবে, আমি গিয়ে পুরুষদের সাথে ঢলাঢলি করে বাজার করব নাকি? তখনই শুরু হয়ে যায় ঝগড়া। অগত্যা মাজেদা ওকে তাকে দিয়ে বাজার সওদা করায়, অন্যান্য কাজ কর্ম করায়। এভাবেই টেনে হেচড়ে তার সংসার চলে। একদিন বাজার করানোর লোক পেল না। ইঞ্জিনিয়ার হাওয়া সেবন পর্ব শেষ করে রাত্রে বাসায় ফিরল। মাজেদা বলল, তাড়াতাড়ি বাজারে যাও, ঘরে রান্না করার মত কোন তরিতরকারি নাই। ইঞ্জিনিয়ার খেকিয়ে উঠল ‘জানই যে এসব কাজ আমি করি না। তাহলে শুধু শুধুই আমাকে বলে লাভ কি?- তাহলে কে করবে? - কাজের লোক রাখ। - কাজের লোক এনে দাও, আমি কোথায় পাব? সে একটু চিন্তা করে বলল, আমাকে আনতে হবে কেন, তোমার হাতেই তো কাজের মানুষ আছে। - মানে। - মানে হল তোমাদের বাড়িতে যে ছেলেটা থাকে ওকে নিয়ে আস, তাহলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। শ্রাবণের আকাশের মত মাজেদার গম্ভীর মুখটা সহসা উজ্বল হয়ে উঠল। সে আর কোন কথা বলল না। কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, কাল সকালে গিয়ে তোমার অফিসের গাড়িটা পাঠিয়ে দিও আমি বাড়িতে যাব।
রাতে খাওয়া দাওয়ার পর মাজেদা গিয়ে তার বাবার রুমে বসল। মা বাবা দুজনই সামনে বসা। সে বলল, আব্বা আমি একটা আবদার নিয়ে এসেছি। তিনি খুশিতে গদগদ হয়ে বললেন, কী আবদার বল। মেয়ে বলল, তুমি তো জানই তোমাদের জামাই কিচ্ছু করে না, সব কিছুই আমাকে লোক ডেকে করাতে হয়। তাই আমি হাসানকে নিয়ে যেতে এসেছি। সে থাকলে আমার আর বাজার সওদা করার চিন্তা করতে হবে না। বাচ্চাগুলিকেও স্কুলে আনা নেয়া করতে পারবে। তাকে নিয়ে আমি মার্কেটও করতে পারব, বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতেও পারব। তাই ওকে আমি নিয়ে যাচ্ছি। প্রস্তাবটা শুনেই মাস্টারের মুখে যেন কেউ এক পোচ কালি মেখে দিল। তিনি বুঝতে পারলেন, তার মেয়ে হাসানকে কাজের ছেলে বানাতে চায়। তার মন চাচ্ছিল ঢাস ঢাস করে মেয়ের মুখে কয়েকটা থাপ্পড় বসিয়ে দিতে। কিন্তু নিজের মেয়ে সম্পর্কে তিনি জানেন, এই বাঘিনীর গায়ে হাত তুললে আর রক্ষে নাই।
কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকলেন। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, আচ্ছা তোর কি হাসানের পুর্ব পুরুষদের ইতিহাস জানা আছে? মাজেদা বলল, একটা ছন্নছারা রাস্তার ছেলের ইতিহাস জানলেই কি আর না জানলেই কি। বাবা বললেন, কারো অতীত না জানলে তুই তাকে মুল্যায়ন করবি কেমনে, কাউকে মাপতে হলে আগে তার ইতিহাস জানতে হবে। সেই ইতিহাসটাই আজ তোকে বলব। উসমানের পুর্ব পুরুষরা জমিদার ছিলেন, উত্তর ময়মনসিংহে তারাই ছিল বিখ্যাত ও প্রতাপশালী। এক সময় তাদের জমিদারী বিলুপ্ত হয়ে যায় আর সাথে সাথে তাদেরও পতন শুরু হয়। সর্বশেষ উসমানের দাদা সুলতান মাহমুদের আমল পর্যন্তও তাদের অনেকগুলি তালুক ছিল, বিশাল ভুসম্পত্তির অধিকারী ছিল। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর তার ছেলেরা এ সম্পত্তি উড়িয়ে দেয়। তারা খুন খারাবি করে, মামলা মুকাদ্দামা করে, গানের দল করে, জুয়া খেলে একটার পর একটা তালুক পানির দরে বেচতে থাকে। এদের অপকর্ম এলাকায় কিংবদন্তির মত ছড়িয়ে আছে। তারা নাকি জুয়ার আসরে একেকটা তালুক বাজি রাখত আর হারত। এভাবে তাদের জমিদারীর শেষ চিহ্নটুকুও মুছে যায়।
উসমানের দেড় বছর বয়সে তার বাবা মারা যান। তখন আমার খালা মানে তার মা সংসার হাতে নেন। হাতি বাচলেও লাখ মরলেও লাখ (লক্ষ)। তখনো তাদের প্রচুর ভুসম্পত্তি। আমার খালা সেসব হাতে নিয়ে সংসারের উন্নতি করতে থাকেন। এদিকে আমার বাবা মানে তোর দাদা ছিলেন বাউন্ডুলে প্রকৃতির মানুষ, সংসারের কোন ধার ধারতেন না। ইংরেজ আমলে তিনি বিহারের কোন পীরের মুরীদ ছিলেন, বউ বাচ্চা ও সংসার ফেলে এই পীরের সাথে সারা ভারত বর্ষ চষে বেড়াতেন, কদাচ বাড়িতে আসতেন। কিন্তু কয়েকদিন থেকে আবার চলে যেতেন, সংসারে অভাব অনটন লেগেই থাকত। আমি তখন প্রাইমারি শেষ করেছি, মা আমাকে নিয়ে চিন্তায় পড়লেন কোথায় ভর্তি করবেন। আশপাশে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না। অনেক চিন্তা ভাবনার পর অবশেষে বললেন, তুই ফুলপুর চলে যা, সেখানে আমার এক ফুফাত বোন আছে তারা জমিদার, তাদের প্রতিষ্ঠিত অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। তুই সেখানে গিয়ে লেখা পড়া কর।
আমি অভাবের তাড়নায় ও লেখাপড়ার স্বার্থে এতদুর যেতে রাজি হলাম। বিদায়ের দিন মা খালার নামে একটা পত্র লিখে আমার হাতে দিয়ে চোখ মুছে বিদায় দিলেন। তারপর মাষ্টার দুহাতে মুখ ঢেকে উচ্চস্বরে কেঁদে উঠলেন। কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেন, হাসানের মত একটা অবুঝ বালক যে বয়সে তার বাবার পত্র নিয়ে আমার কাছে এসেছে আমিও সেই বয়সে মায়ের পত্র নিয়ে তাদের পরিবারে যাত্রা শুরু করলাম। মনে হচ্ছিল যেন কোন বিদেশ বিভুইয়ে পাড়ি জমাচ্ছি। দূরের পথ, যোগাযোগ ব্যবস্থা নাই বললেই চলে, পথ ঘাট চিনি না। আল্লাহ ভরসা করে রওয়ানা হলাম। কিছুপথ নৌকায়, কিছু গরুর গাড়িতে, কিছু ঘোড়ার গাড়িতে, কিছু রিকশায় চড়ে মানুষকে জিজ্ঞেস করতে করতে অবশেষে সেই এলাকায় গিয়ে পৌঁছলাম।
কিন্তু বাড়ি তো চিনি না, মানুষকে জিজ্ঞেস করতে করতে এগিয়ে গেলাম। একজন লোক আমাকে সাথে নিয়ে গেল। বাড়ির পাশের রাস্তায় দাঁড়িয়ে একটা দুতলা বাড়ি দেখিয়ে বলল, যাও ঐ বাড়ি। খুব ভোরে রওয়ানা করেছিলাম, রাত এগারটার দিকে গিয়ে পৌঁছলাম। বিশাল বড় বাড়ি, কোন জন মানবের সাড়া শব্দ নাই, চারদিকে বাগান জঙ্গল, কেমন যেন ভুতুরে পরিবেশ। বহির্বাড়িতে দাঁড়িয়ে আমি অনেকক্ষণ ডাকলাম কিন্তু কেউ আসল না। আমি ভয়ে ও আশংকায় কাঁদতে লাগলাম আর চিৎকার করে ডাকতে লাগলাম। আসলে বাড়িতে কোণ পুরুষ লোক থাকত না, এজন্য রাত্রে কেউ বের হত না। অবশেষে কান্না শুনে একজন কাজের মহিলা লন্ঠন হাতে এগিয়ে এল। আমি ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললাম, আমাকে খালার কাছে নিয়ে যান। তাকে পরিচয় দিলাম। সে আমাকে নিয়ে গিয়ে কর্ত্রিকে ডেকে বের করল। মধ্য বয়সি একজন সম্ভ্রান্ত মহিলা বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন, পরনে দামি কাপড়, তার পাশে আমার প্রায় সমবয়সী একটি ছেলে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আমি পরিচয় দিলাম। আর সাথে সাথে তিনি যেন পাখির মত উড়ে এসে আমাকে ঝাপটে ধরে চেঁচিয়ে উঠলেন ‘হায় আল্লাহ তুই ফুলবানুর ছেলে, এত রাতে একাকি কোত্থেকে এলি কিভাবে এলি। তারপর আমাকে প্রায় কোলে নিয়ে ঘরে গেলেন। সেদিন থেকেই আমি হয়ে গেলাম রাজপুত্তুর ।
প্রাচীন আমলের টিনের দোতলা ঘর, দোতলার পাটাতনসহ সব গজারি কাঠ। বিশাল বড় ঘরের দুয়েকটা রুম ছাড়া বাকি সব খালী পড়ে আছে। পরদিন খালা আমাকে একটি বড়সড় রুম দেখিয়ে বললেন, এটা তোর রুম, একা থাকতে ভয় পাবি? আমি হাঁ সুচক ইঙ্গিত করলাম। খালা বললেন, ঠিক আছে, উসমান তোর সাথে থাকবে। প্রাচীন জমিদার বাড়ি, আসবাব পত্রের অভাব নাই। প্রাচীন ডিজাইনের অদ্ভুত সুন্দর খাট এল, চেয়ার টেবিল আলনা আলমারি সব এল। উসমান আলাদা খাটে তার মায়ের রুমে থাকত। তার খাটও আমার রুমে আনা হল। এরপর থেকে দুই ভাই, দুই বন্ধু এক সাথে থাকতে লাগলাম।
বৃটিশ আমলে নিউ স্কিম ও ওল্ড স্কিম নামে দুই ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু হয়ে ছিল। নিউ স্কিম প্রতিষ্ঠান গুলিকে হাই মাদরাসা বলা হত। পরবর্তিতে এগুলিই হাইস্কুল নাম ধারন করে। উসমানের বাবা তাদের বহির্বাড়িতে একটা হাই মাদরাসা স্থাপন করেছিলেন, উসমান সেখানে পড়ত। আশ পাশে অন্য কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না। দ্বিতীয় দিন সকালে খালা নিজে গিয়ে আমাকে ভর্তি করলেন। শিক্ষকরা জিজ্ঞেস করল ‘কে? খালা বললেন, আমার বড় ছেলে। শিক্ষকরা মুখ টিপে হাসল। আমি পড়ায় মনোযোগ দিলাম কিন্তু উসমান উদাসিন। লেখা পড়ায় তার কোন আকর্ষন নাই। তার ধমনিতে পুর্ব পুরুষের রক্ত খেলা করে, সে উদাস দুরন্ত। রাত দিন পাড়ার ছেলেদের সাথে খেলা ধুলা করে, দল বেধে ঘোরে, নদীতে সাতার কাটে, সকাল বিকাল বন্ধুক কাধে ফেলে নদী গাঙ বিল জঙ্গল ইত্যাদিতে পাখি শিকার করে ফিরে। গ্রামে গ্রামে খেলার আসর জমায়, পুরুস্কার দেয়, এসব খরচা পাতি সেই বহন করে। কয়েক গ্রামের মধ্যে সেই তরুন হর্তাকর্তা।
খালা তার লেখা পড়ার জন্য খুব চেষ্টা করলেন আমিও করলাম। কিন্তু তার অবস্থা কামারের হাতুড়ির নিচে লোহার মত- যেই লোহা সেই লোহাই। অবশেষে খালা তার খাওয়া বন্ধ করে দিয়ে বললেন, তুই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা, যেদিন উবায়দের মত লেখা পড়া করতে পারবি সেদিন আসবি। তখন অগত্যা কাজের মহিলাটা লুকিয়ে আমার ঘরে ভাত এনে তাকে খাওয়াত। সে সকালে খেয়ে বের হত একদম রাত্রে আসত। তখন আমি তাকে বুঝাতাম ‘দেখ তোর এ অবস্থা তো আমার ভাল লাগে না। তোর জন্য আমারও লেখা পড়ায় মন বসে না, চল দুই ভাই পড়া শুনায় মন দেই। তখন সে আমাকে উল্টো বুঝাত, দেখ আমি জমিদার বংশের সন্তান, আমি লেখা পড়া করি বা না করি জমিদারী হালতেই আমার দিন কেটে যাবে। কিন্তু তুমি কি করবে, লেখা পড়াই তোমার একমাত্র সম্বল। ভাল শিক্ষিত হয়ে একটা চাকরি করবে, সুখি হবে। আমার চিন্তা বাদ দাও তুমি নিজে মানুষ হও।
তারপর মাষ্টার মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন ‘আসলে সে ঠিকই বলেছিল, জমিদারী করেই তার জীবন কেটে গেছে। এখন সমস্যা হল ছেলেটা, আর ছেলের দায়িত্ব সে আমার উপর অর্পন করে গেছে। কাজেই খোদার শপথ, ছেলেও যেন তার পুর্ব পুরুষের মত জমিদারী হালতে চলতে পারে সে ব্যবস্থা আমি করব, আমার জীবন দিয়ে হলেও করব। তারপর তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে উঠলেন, আহ কি সোনালি দিনগুলি আমার গেছে, সেটাই ছিল আমার স্বর্ণ যুগ, আমার মধুময় কাল। হায় সেই দিন গুলি যদি আবার ফিরে আসত। আহ, আবার যদি ফিরে পেতাম আমার সেই সোনালি সময়। দুই ভাই মিলে কত আনন্দ করেছি। ব্রক্ষপুত্রের শাখা খড়িয়া নদীটি ছিল তাদের বাড়ির এক দেড়শ হাত পিছনে। আমরা দল বেঁধে সাঁতার কাটতাম। প্রতিদিন সন্ধ্যায় বর্শিতে জিউল দিতাম, অর্থাৎ বর্শিতে জেতা ছোট মাছ গেথে পানিতে দিয়ে কঞ্চি মাটিতে পোতে রাখতাম। পরদিন সকালে গিয়ে দেখতাম বোয়াল শৌল গজার ইত্যাদি নদীর মাছ জিউল মাছ খেতে গিয়ে আটকে আছে। তখন দুই ভাই মিলে ঘরে আনতাম।
একদিন সকালে গিয়ে দেখলাম একটা বর্শির জিউল নাই। ভাবলাম কোন মাছে খেয়ে চলে গেছে আটকা পড়েনি। তখন কঞ্চিটা মাটি থেকে তুলে টান দিলাম আর সাথে সাথে পানিতে প্রচণ্ড একটা দাবাড় উঠল এবং আমি মুখ থুবড়ে নদীতে পড়লাম। উসমান ঝাপ দিয়ে পড়ল, তার কৌশল জানা ছিল। সুকৌশলে মাছের চোয়ালের ভিতর দিয়ে হাত ঢুকিয়ে দিল, অন্যথায় সেটা সুতা ছিড়ে চলে যাবে, ধরা যাবে না। মাছটা তার হাত কামড়ে ধরল, দাঁত বিঁধে গিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। আমাকে সে কৌশল শিখিয়ে দিল, আমি মাছটার দুই চোয়ালে চাপ দিয়ে মুখটা হাঁ করিয়ে তার হাত রক্ষা করলাম। তারপর সে মাছের অপর চোয়াল দিয়ে বর্শির কঞ্চিটা ঢুকিয়ে দিয়ে আমাকে ধরতে বলল, আমি চোয়ালে ঢোকা কঞ্চির দুই পাশে ধরলাম, সে অপর পাশে হাত ঢুকিয়ে রেখেছে। এবার ডাঙ্গায় তুলব বলে দুই জনে দিলাম টান কিন্তু আজদাহার মত মাছ দাবাড় মেরে আমাদেরকে নিয়ে চলল মাঝ নদী বরাবর।
শুরু হয় যুদ্ধ, মাছে ও মানুষে যুদ্ধ, এক মাছের সাথে দুই যুবকের যুদ্ধ, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ। এক ঘন্টা যুদ্ধের পর ডাঙ্গায় নিয়ে তুললাম। ছয় সাত হাত লম্বা রাঘব বোয়াল। উসমানের হাতটা কামড়িয়ে ঝাঁঝরা করে ফেলেছে। তারপর আমি মাথার দিকটা সে লেজের দিকটা গাছের টুকরার মত কাধে নিয়ে বাড়িতে চললাম। মাছের গল্প কত বলব, অন্যদিন শুনাব, এবার শুন পাখির গল্প। উসমান প্রতিদিন বিকালে বন্ধুক কাধে বের হত আর সন্ধ্যায় এক খাঁচা করে পাখি নিয়ে আসত। পাখির মাংস খেতে খেতে সেই যে অতৃপ্তি ধরেছিল এখনো পাখির মাংস আমার জিবে রোচে না। যাই হউক, উসমান ছিল প্রচণ্ড মেধাবী। কিন্তু অনেক চেষ্টার পরেও যখন সে লেখা পড়ায় মনোযোগি হল না, তখন খালাকে বলে কয়ে একসাথেই খাওয়ার ব্যবস্থা করলাম। দুই ভাই এক সাথে খেতে বসতাম। খালা আগে থেকে ভাল কোন কিছু আমাকে খাওয়াতেন। কিন্তু তখন থেকে উসমানকে যেন খাওয়াতেই চাইতেন না। ভাল মাছ গোশত, মাছের মাথা আমার পাতে ঢেলে দিতেন, ওকে দিতেন চলন সই। আর বলতেন যারা লেখা পড়া করে না তাদের এত খাওয়ার দরকার নাই।
আমি খেতে খেতে অতৃপ্ত হয়ে যেতাম। তখন মাঝে মধ্যে তার পাতে মাছের মাথা দিয়ে বলতাম তুমি খাও। সে বলত, আরে শুন মাথা খেলে মাথা (মেধা) হয়। আমি পড়া লেখা করি না আমার মাথার দরকার নাই তোমার দরকার আছে’ বলে আবার আমার পাতে দিয়ে দিত। এইভাবে সুখ স্বাচ্ছন্দ্যে আনন্দ স্ফুর্তিতে আমার দিন কাটে, বাড়ির কথা মনেও পড়ে না। কিন্তু আমার মা ও খালা পনের দিন পর পর চিঠি চালাচালি করেন। আমাকে বাড়িতে যেতে বলেন, আমি যাই না। তখন বছরান্তে পরীক্ষা শেষে খালা জোর করে আমাকে বাড়িতে পাঠালেন, সাথে উসমানকে দিয়ে দিলেন। কিন্তু বাড়িতে এসে অভাব অনটন, আবার উসমানের মুক্ত বিহঙ্গ জীবন এ সংকীর্ন পরিবেশে ভাল লাগে না। দুয়েক দিন থেকে আবার চলে যাই। এভাবেই চলতে থাকে আমার সোনালি জীবন, রাজকীয় জীবন, জমিদারী জীবন। অবশেষে মেট্রিক্যুলেশন পরীক্ষার পর বাড়িতে চলে আসি। তারপর রংপুর কারমাইকেল কলেজে গিয়ে ভর্তি হই।
ছাত্রাবস্থায় মা আমার জন্য বিয়ে ঠিক করলেন, আমি গিয়ে খালাকে দাওয়াত দিয়ে আসলাম। তোর মাকে অলংকার দেয়ার মত সামর্থ আমাদের ছিল না। আমার মা জমি বিক্রি করে কিছু অলংকার গড়াতে চাইলেন আমি না করলাম। কিন্তু সে যুগে স্বর্নালংকার ছাড়া বিয়ে হত না, তাই চিন্তা করছি খালী হাতে কেমনে বিয়ে করতে যাব। আল্লাহ্র রহমত, বিয়ের তিনদিন আগে পালকি করে খালা আসলেন, সাথে উসমান। রাত্রে যখন বাক্স খুললেন, দেখে তো আমাদের মাথা ঘুরিয়ে গেল। বড় একটা কণ্ঠহার, হাতের বালা, কানের দুল অন্যান্য গহনা গাটি শাড়ি ইত্যাদিতে বাক্স ভর্তি। এগুলি এখন তো তোরাও দেখতে পাচ্ছিস। আমি মনের আনন্দে বিয়ে করতে গেলাম। খালা কয়েক দিন থেকে চলে গেলেন।
এর মধ্যে স্বাধিনতা যুদ্ধ শুরু হল। আসরের সময় খালা বারান্দায় অযু করতে বসলেন। তখন নদীর পাড়ে গোলাগুলি হচ্ছিল, হঠাৎ খালার পিঠে একটা গুলি লেগে বক্ষ ভেদ করে গেল। তিনি সেখানেই মারা গেলেন। আমরা খবর পেয়েছিলাম অনেক পরে। মায়ের মৃত্যুতে উসমান বাউন্ডুলে হয়ে গেল কিন্তু তার আত্মীয়রা আরেক সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে দেখে তার বিয়ে ঠিক করল। উসমান এসে বিয়ের দাওয়াত দিয়ে গেল। কিন্তু কি নিয়ে যাব খালী হাতে কেমনে যাব, তারা আমার বিয়েতে যে উপহার দিয়েছে তা জুড়াতে গেলে আমার সম্পুর্ণ জমি বেচেও কুল পাব না। ইতস্তত করতে করতে শেষ পর্যন্ত আর যাওয়াই হয়নি। বিয়ে হল, সেও ঘরমুখি হল বটে কিন্তু আগের অভ্যাস অনুযায়ি অঢেল খরচ করতে লাগল, আবার জমি বেচা আরম্ভ হল। স্বাধীনতার কয়েক বছর পর ঐ এলাকায় কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। কলেরায় হাসানের মা মারা যায়, তখন তার বয়স তিন বছর। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর উসমান ভেঙ্গে পড়ে, সংসারের প্রতি মনোযোগ হারিয়ে ফেলে। তখন তাবলীগের কিছু লোক তার পিছু নেয়, গাশত করে তিন চিল্লার জন্য রাজি করায়। তখন তার একমাত্র ছেলে হাসানকে প্রতিবেশি এক ভাবী ও কাজের মহিলার যিম্মায় রেখে তাবলীগে চলে যায়। তাবলীগ থেকে এসে বাড়ির পাশে মাদরাসা মসজিদ প্রতিষ্ঠা করে। জমি বিক্রি করে একাই সে এসব নির্মান করে। তারপর ইমাম ও শিক্ষকদের বেতন, ছাত্রদের খাওয়া ইত্যাদির খরচ সে একাই জমি বিক্রি করে চালাতে থাকে।
এদিকে তোর মা শুধু উসমান, খালা ও তাদের পরিবারের ইতিহাস শুনে, এভাবে শুনতে শুনতে সে বেড়ানোর জন্য বায়না ধরল। আমিও ভাবলাম সপরিবারে একবার বেড়ানো দরকার। তখন মোটামোটি যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল, মোটর গাড়ি চলে। ইতিমধ্যে বিশ দিনের জন্য স্কুল বন্ধ হল। সিদ্ধান্ত নিলাম, এই সুযোগে বেড়ানোটা হয়ে যাক। তখন আমরা দুজন আর তোরা তিন ভাই বোন মিলে পাঁচজন রওয়ানা হলাম। তিনি মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন ‘তোর মনে আছে না? মাজেদা সম্মতি সুচক মাথা নাড়ল। মাস্টার আবার বলতে শুরু করলেন, বাড়িতে পৌঁছে তো আমি অবাক, কোন মানুষ নাই, দরজা তালা দেয়া। পাশের বাড়িতে খুঁজ নিতে গেলাম। এই বাড়িটা ছিল তাদের বাড়ির কাজের মহিলার বাড়ি। তিনি তখন বৃদ্ধা হয়ে গেছেন। আমাকে দেখে চিনতে পেরে আহলাদে ফেটে পড়লেন আর বললেন, উসমান সব সময় তোমার কথা আলাপ করে আর বলে তোমার ওখানে বেড়াতে যাবে, তোমাকে ও তোমার বউকে নিয়ে আসবে। এখন তোমাকে দেখে সে খুব খুশি হবে। তবে বর্তমানে সে বাড়িতে নেই জামাতে গেছে, তিনদিন পর এসে যাবে। আমি বললাম, তাহলে আমরা কি করব চলে যাব নাকি? তিনি আঁতকে উঠলেন, সর্বনাশ, তাহলে তোমার ও আমার কারো উপায় থাকবে না।
তারপর সে চাবি নিয়ে এসে দরজা খোলে দিল ও খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করল। দোতলা ঘর, বিশাল বাড়ি, বাগান নদী ইত্যাদি দেখে তোরা তো আনন্দে আত্মহারা। তিনদিন পর সে এসে আমাকে দেখেই ঝাঁপিয়ে পড়ল, পাগলের মত চুমুতে লাগল। তারপর খুশিতে নাচতে নাচতে তোর মায়ের সামনে গিয়ে আবেগে কেঁদে ফেলল ‘ভাবী আপনারা এসেছেন আমি যে কত খুশি হয়েছি, কত খুশি---তা বলে বুঝাতে পারব না। তারপর বলল, আমার এখানে তিন মাস বেড়াতে হবে। বিকালে দেখি বহির্বাড়িতে খাসী জবাই করতেছে, গ্রাম থেকে কিনে এনেছে। এরপর থেকে চলল প্রাচীন জমিদারির ঐতিহ্য, আরব্য পারস্য ও মোগলাই শ্রেণীর খাওয়া দাওয়ার সমাহার। সে প্রতিদিন তোদের ছোট দুবোনকে কোলে কাখে নিয়ে গ্রামময় ঘুরত আর বলত, আমার একমাত্র ভাইয়ের সন্তান এরা। সে ছিল আমার বছর দুয়েকের ছোট, তোর মাকে বড় বোনের মত, মায়ের মত শ্রদ্ধা করত। এক সপ্তাহ থাকার পর বিদায় চাইলাম, সে কাঠ না করে বসল আর জানতে চাইল স্কুল খোলা কবে? আমি বললাম, দশ বারো দিন পর। সে সুযোগ পেয়ে গেল, বলল, খোলার আগের দিন যেতে পারবে, এর আগে যেতে চাইলে তোমাদের আগে আমি বাড়ি থেকে চলে যাব। অগত্যা থাকতেই হল।
সে ময়মনসিংহে দৌড়াদৌড়ি শুরু করল। তোদের কাপড় চোপর, উপহার সামগ্রি ও গয়না গাটি কিনে আনল। তোর গলার হারটা তারই দেয়া। অবশেষে বিদায়ের দিন তোদের হাতে টাকা গুজে দিল আর শেরপুর পর্যন্ত নিজে ভাড়া দিয়ে এগিয়ে দিয়ে গেল। তার দেখাদেখি আমিও বাড়িতে এসে মসজিদ মাদরাসা করলাম। ঐ তারিখে আসার পর আর খোঁজ খবর নেয়া সম্ভব হয়নি। আমি সংসার ও শিক্ষকতা নিয়ে ব্যস্ত থাকলাম। সে মাদরাসা মসজিদ ও তাবলীগ নিয়ে পড়ে থাকল। তাবলীগ জামাত আসলে খাওয়া খরচ সম্পূর্ণ তার। তদুপরি মসজিদ মাদরাসার খরচ চালাতে গিয়ে সম্পূর্ণ জমি বেচে শেষ করল। অবশ্য বাড়ির পিছনে তার অনেক জমি ছিল, সেগুলি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। হাসানের কাছে জানতে পারলাম, নদী ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে ঘর পর্যন্ত চলে আসে। ঘর ভিট কিছুটা ভেঙ্গে যায়। সবাই ঘর সরিয়ে নিতে তাকীদ দিত কিন্তু সে এসব গায়ে মাখত না। অবশেষে একদিনের ঝড়ে ঘরটা ধ্বসে পড়ে, আর উসমান চাপা পড়ে। আমার ভাই উসমান...... তিনি শিশুর মত কেঁদে উঠলেন, ফুফিয়ে ফুফিয়ে কাঁদতে লাগলেন, তার শরীর কাঁপছে।
অবশেষে কান্না নিরোধ করে নাকি সুরে কথা ভেঙ্গে ভেঙ্গে বলতে লাগলেন, ভাগ্যিস যে ছেলেটা মাদরাসায় ছিল, নচেৎ জমিদার বংশের শেষ প্রদীপটিও নিভে যেত। এই হল উসমানের ইতিহাস, হাসানের ইতিহাস, এক ভাগ্য বিরম্বিত বালকের ইতিহাস, জমিদার বংশের শেষ একটি প্রদীপের ইতিহাস। এখন তুই চিন্তা করে দেখ- হাসান তোর বাসায় কাজের ছেলে হওয়ার জন্য কতটুকু উপযুক্ত। মাজেদা উত্তর দিল, কাজের ছেলে বলছ কেন, বোনের বাসায় থাকবে, সংসারি টুকটাক কাজ করবে, এতে কাজের ছেলে বলার কি আছে। মেয়ের এখনো এমন মনোভাব দেখে মাস্টার হতভম্ব হয়ে গেল, অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন, উত্তর দিবার ভাষা খোঁজে পেলেন না। তখন ফেরদৌসির মা বলল, ফরিদ ফরহাদ যেমন আমার ছেলে হাসানও আমার ছেলে। তোর যখন এতই কাজের ছেলের দরকার তাহলে ফরিদ ফরহাদের একজন নিয়ে যা। মাজেদা খেকিয়ে উঠল, তুমি মা হয়ে এ কেমন কথা বললে, পরের ছেলের জন্য নিজের ছেলেকে কাজের লোক বানাতে চাও, ওদের লেখা পড়ার কি হবে? মা তখন ঝাঝিয়ে উঠলেন, তোর কাছে সে পরের ছেলে কিন্তু আমার কাছে সে আমার পেটের ছেলে। নিজের ভাইয়ের লেখা পড়ার দিকে এত দরদ আর ও বুঝি ফেলনা--- ব্যস মা মেয়ের মধ্যে ভীষণ ঝগড়া শুরু হয়ে যায়।
মাষ্টার চিৎকার করলেন ‘থাম, ওদের কাউকে নিলে লেখাপড়া নষ্ট হবে। কাজেই তোর এমন একজন দরকার যার লেখা পড়া নাই। আমার লেখা পড়া নাই, আমাকে নিয়ে যা, তোর বাজার সওদাসহ সংসারি সব কাজ করাতে পারবি, এমনকি রান্না বান্নাও চলবে। মাজেদা ছিটিয়ে উঠে বাবার দিকে অগ্নি দৃষ্টি হেনে ‘হুঃ দিন দিন বুড়া হইতাছে আর ভিমরতি ধরতাছে, যা মুখে আসে তাই কয়। একটা রাস্তার ছেলের জন্য নিজের মান ইজ্জত সব বিসর্জন দিয়ে দিয়েছে’ বকবক করতে করতে হনহন করে চলে গেল। মাস্টার বিস্পারিত নেত্রে মেয়ের গমন পথের দিকে তাকিয়ে আছে। ক্রোধ লজ্বা ও ঘৃনায় তার মুখটা বিকৃত হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর উঠে জামা নিয়ে মসজিদে চলে গেল, অজু করে নামাযে দাঁড়াল। এটা তার অভ্যাস, ক্রোধ, লজ্বা বা বিপদ আপদের সময় সে মসজিদে গিয়ে দুরাকাত নামায পড়ে। পরদিন মাজেদা গাল ফুলিয়ে বাপের বাড়ি থেকে চলে গেল।
বিষয়: সাহিত্য
১২২৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন