ওয়াজ_মাহফিলে প্রচলিত "দৃষ্টি" সংক্রান্ত জাল হাদীস

লিখেছেন লিখেছেন সামসুল আলম দোয়েল ০২ মার্চ, ২০২০, ১০:০২:৫২ রাত

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

আজকাল ওয়াজ মাহফিলগুলোতে বক্তারা শ্রোতাদেরকে নিজেদের প্রতি আকৃষ্ট করতে, প্রসিদ্ধি বাড়াতে, চমক দিতে ও জনপ্রিয়তার সস্তা কৌশলে কথা বলে নানা অঙ্গি-ভঙ্গি করে, হাস্য-রসাত্মক কৌতুক বলে, গাল-গল্প পরিবেশন করে। সাথে সাথে উদ্ভট আর অদ্ভুত সব ফযিলতের কথা বলে থাকে।

ইসলাম কোনো ঠুনকো পথ বা মাযহাবের নাম নয়, এর বিধানগুলো ভিত্তিহীন ও বিজ্ঞান বিবর্জিত নয়। ইসলামী শরীয়াহ প্রতিষ্ঠিত কুরআন ও সুন্নাহর সুষ্পষ্ট দলীলের উপর। তারপরও ওয়াজ মাহফিলে কেন দূর্বল, জাল হাদীল বর্ণনা করা হয়? কেন আজগুবী সব কাহিনি প্রচার করা হচ্ছে?

প্রতিটি আমলের স্বপক্ষে কুরআনের আয়াত ও সহীহ হাদীস থাকার পরও বানোয়াট কথা বলার দরকার কী?

জাল হাদীস বর্ণনা করা ও যাচাই-বাছাইহীন কথা বলার পরিণতি: আল্লাহ বলেন-

‘হে মুমিনগণ, যদি কোনো পাপী তোমাদের কাছে কোনো খবর আনে, তবে তোমরা তা পরীক্ষা করবে যাতে অজ্ঞতাবশত তোমরা কোনো সম্প্রদায়কে ক্ষতিগ্রস্থ না কর, এবং পরে তোমাদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত না হও।’’ (সূরা ৪৯ হুজুরাত: ৬)



রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন:

‘যে ব্যক্তি আমার নামে মিথ্যা বলবে তার আবাসস্থল জাহান্নাম।’ (বুখারী:১২২৯)

‘একজন মানুষের পাপী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শুনবে তাই বর্ণনা করবে। (সহীহ মুসলিম:১/১০)



ইমাম যাইনুদ্দীন আব্দুর রাহীম ইবনুল হুসাইন আল-ইরাকী (৮০৬ হি) বলেন: মাউযূ বা জাল হাদীস যে বিষয়ে বা যে অর্থেই হোক্, তা বলা হারাম। আহকাম, গল্প-কাহিনী, ফযীলত, নেককর্মে উৎসাহ, পাপ থেকে ভীতি প্রদর্শন বা অন্য যে কোনো বিষয়েই হোক না কেন, যে ব্যক্তি তাকে মাউযূ বলে জানতে পারবে তার জন্য তা বর্ণনা করা, প্রচার করা, তার দ্বারা দলীল দেয়া বা তার দ্বারা ওয়ায করা জায়েয নয়। তবে হাদীসটি যে জাল ও বানোয়াট সেকথা উল্লেখ করে তা বলা যায়। (ফাতহুল মুগীস, পৃ: ১২০-১২১)

আবূ সা‘লাবাহ্ আল খুশানী (রাঃ) হতে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কিয়ামতের দিন আমার কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত ও সবচেয়ে দূরতম সে ব্যক্তি হবে, যে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে চরিত্রহীন, বেশি কথা বলে, অসতর্কভাবে যা-তা বলে এবং কথাবার্তায় নিজেকে বড় বলে প্রকাশ করে। (আহমাদ: ১৭৭৩২, সহীহ ইবনু হিব্বান: ৫৫৫৭, মুসান্নাফ ইবনু আবূ শাইবাহ্ : ২৫৩২০,মিশকাত:৪৭৯৭)

ইমাম তিরমিযী রহ. বলেন: ‘আস-সারসার যে লোক বেশি কথা বলে (বাচাল)। আল-মুতাশাদিক' , মানুষের সামনে যে লোক লম্বা লম্বা কথা বলে বেড়ায়, ধৃষ্টতাপূর্ণ ও অশালীন উক্তি করে, নির্লজ্জ ও দাম্ভিকতাপূর্ণ কথা বলে। (দ্রষ্টব্য, তিরমিযী: ২০১৮)

লোক হাসানোর জন্য মিথ্যা বলা:

আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ বান্দা একটি কথা বলে এজন্য যে, সে এটা দ্বারা লোক হাসাবে। সে এ কথার দরুন জাহান্নামের মধ্যে এত দূরে নিক্ষিপ্ত হবে যা আকাশমণ্ডলী ও জমিনের দূরত্বের সমান। বান্দার পা পিছলানোর তুলনায় মুখ পিছলানো ভয়ানক ক্ষতিকর।(মিশকাত:৪৮৩৫)

আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘মানুষের মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা কিছু শোনে [বিনা বিচারে] তা-ই বর্ণনা করে।’’ (মুসলিম:৫)



বাজারে প্রচলিত বক্তাদের মুখে জনপ্রিয় কিছু "দৃষ্টি" সংক্রান্ত জাল হাদীস:



১. "মায়ের দিকে নেক নযর দিলে কবুল হজ্জের সওয়াব"। আমি এই জাতীয় কোনো বর্ণনা কোথাও পাই নি, তবে একটি প্রসিদ্ধ দূর্বল ও জাল রয়েছে এই রকম শব্দে-

"যখন কোন নেক সন্তান নিজের মাতা-পিতাকে অনুগ্রহের দৃষ্টিতে দেখে, আল্লাহ তা‘আলা তার প্রতিটি দৃষ্টির বিনিময়ে তার ‘আমলনামায় একটি কবুলকৃত হজ্জ-এর সাওয়াব লিখে দেন। সহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞেস করলেনঃ হে আল্লাহর রসূল! যদি দৈনিক একশ’বার দৃষ্টিপাত করে? রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ হ্যাঁ, তাও। আল্লাহ মহান ও পবিত্র। (বাইহাকীর শু'আবুল ঈমান: ১০/২৬৫-২৬৬, মিশকাত:৪৯৪৪, মু'জাম আসামীশ শুয়ূখ: ৮)

হাদীসটির দুটি সনদের প্রথম সনদটি দূর্বল (দ্রষ্টব্য সিলসিলাতুয যাঈফাহ: ২৭১৬ , অপরটি জাল। হাদীসটি জাল হওয়ার কারণ, এর সনদে ‘‘নাহশাল (نهشل) ইবনু সা‘ঈদ’’ নামের একজন বর্ণনাকারী প্রসিদ্ধ মিথ্যুক। বিস্তারিত দেখুন- সিলসিলাতুয্ য‘ঈফাহ্ ৬২৭৩।

তবে পিতা-মাতার প্রতি অনুগ্রহ করার জন্য কুরআন ও হাদীছে অসংখ্য নির্দেশ ও ফযিলত রয়েছে। যেমন- সূরা ১৭ ইসরা: ২৩-২৪; তিরমিযী হা:১৮৯৯; নাসাঈ হা:৩১০৪; মুসলিম হ: ২৫৫১; মিশকাত হা: ৪৯১১,৪৯১২ প্রভৃতি।

২. তিনটি বস্তু দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি করেঃ সবুজ বর্ণ, প্রবাহিত পানি ও সুন্দর চেহারার দিকে দৃষ্টি দান। হাদীসটি জাল

( দ্রষ্টব্য:ইবনুল জাওযীর “মাওযূ’আত” :১/১৬৩)

৩. মাসহাফ/ কুরআনের দিকে দৃষ্টি দেয়া ইবাদাত, সন্তান কর্তৃক পিতা মাতার দিকে দৃষ্টি দেয়া ইবাদত এবং আলী ইবনু আবী তালেবের দিকে দৃষ্টি দেয়া ইবাদাত। হাদীসটি জাল

(দ্রষ্টব্য: সুয়ূতীর “আল-লাআলী” গ্রন্থে: ১/৩৪২-৩৪৬)

৪. "পাঁচটি বস্তু ইবাদাতের অন্তর্ভুক্তঃ কম খাদ্য গ্রহণ করা ইবাদাত, মসজিদে বসা ইবাদাত, পাঠ করা ছাড়াই কুরআনে দৃষ্টি দেয়া ইবাদাত, আলেমের চেহারায় দৃষ্টি দেয়া ইবাদাত (আমার ধারণা তিনি বলেন) এবং পিতা-মাতার চেহারায় দৃষ্টি দেয়া ইবাদত"

শায়খ আলবানী রহ. বলেন- এ হাদীসটি খুবই দূর্বল (মাওযুআ'ত: ১৭১০)

৫. "সুন্দর চেহারার দিকে দৃষ্টিদান চোখকে উজ্জ্বল করে আর কুৎসিত চেহারার দিকে দৃষ্টিদান মুখমণ্ডলে ভীতির চিহ্নের উদ্ভব ঘটায়"। জাল হাদীস (ইবনুল জাওযীর “আল-মাওযূ'আত”:১/১৬২-১৬৩)

আরেকটি বানোয়াট হাদীস হলো- "তোমরা চেহারাকে সুশ্রী করো এবং চোখে কালো মনি বিশিষ্ট রূপ ধারন কর। কারন আল্লাহ সুশ্রী চেহারার অধিকারীকে জাহান্নামের শাস্তি দিতে লজ্জা পান"। সবগুলো হাদীস এনেছেন ইবনুল জাওযী তার মাওযূআ'তে। (মাওযুআ'ত:১৩১)

৬. "সুন্দর চেহারার অধিকারিণী নারী এবং সুন্দর ঘাসের দিকে দৃষ্টিদান দৃষ্টিশক্তিকে বৃদ্ধি করে"। ইবনুল কাইয়্যিম বলেনঃ এ হাদীসসহ অনুরূপ হাদীসগুলো যিন্দীকদের (নাস্তিকদের) জালকৃত। (দ্রষ্টব্য: আলবানীর "মাওযুআ'ত: ১৩৩, সাগানীর “আহাদীসুল মাওযুআহ ,পৃঃ ৭)

৭. "ইবাদাত থেকে তোমরা তোমাদের চোখগুলোকে তার অংশ প্রদান করঃ (আর তা হচ্ছে) মুসহাফে (কুরআনে) দৃষ্টি দেয়া (অর্থাৎ দেখে কুরআন পাঠ করা), কুরআনের ব্যাপারে চিন্তা (গবেষণা) করা এবং তার বিষয়গুলো থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা।"(“হিদায়াতুল ইনসান”:১/১৫৩) হাদীসটি জাল

সংকলন ও সম্পাদনায়: সামসুল_আলম

বিষয়: বিবিধ

৬০১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File