শাহেওয়াজ রকি
প্রতিদিন যে পথ ধরে আমি অফিসে যাই তার দুই পাশে উঁচু উঁচু দালান কোনটাই ৩০ তলার কম না। যে দুটি ভবন একটু নিচু সেগুলোও ১৫ তলার মতো। এখানে আমাদের যে অফিস সেটিও ৪০ তলা বিল্ডিয়ের ২৮ তলায় এবং এটি সিউলের পুরনো ভবনগুলোর একটি।
আজ হোটেল থেকে অফিসে যেতে যেতে বারবার বনানীর ভবন থেকে মানুষের লাফিয়ে পড়ার দৃশ্যগুলো চোখে ভাসছে আর হাইপার-সনিক স্পিডে ভাবনা চলছে আচ্ছা আগুন লাগলে ২৮ তলা থেকে আমি পালাবো কী ভাবে?
এই শহরের এতো উঁচু উঁচু দালানগুলোতে আগুন লাগলে কী হবে এতো মানুষের? কোথায় যাবে তারা?
সুতরাং অফিসে ঢুকেই আমার কলিগ ডেভিডকে প্রশ্ন করলাম, আমরা যে এতো উপরে বসে আছি কোন কারণে বিল্ডিংয়ে আগুন লাগলে কি করবে? পালাবে কিভাবে?
ডেভিড মুচকি হাসে, সে বুঝতে পেরেছে কেন আমি এই প্রশ্ন করেছি। কারণ কালকে ঢাকায় অগ্নিকান্ডের খবর সেও জানে। তাই আমাকে আশ্বস্থ করে বলে তোমাকে পালাতে হবে না, আগুন নিজেই পালাবে।
আমি জিজ্ঞেস করি কী ভাবে!
বলে আসো তোমাকে দেখাই, বলে ডেভিড আমাকে পুরো অফিসের ফায়ার সেইফটি দেখালো।
এখানে প্রতিটি ফ্লোরে ফায়ার ড্রিল আছে, কোন কারণে ফ্লোরের তাপমাত্রা নির্দিষ্ট মাত্রা থেকে বেড়ে গেলে সাইরেন বাজতে শুরু করবে। তখন ফ্লোরের একটি নির্দিষ্ট মিটিং পয়েন্টে গিয়ে আমরা অপেক্ষা করবো। ফায়ার ড্রিলগুলো সয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয়ে যাবে আগুন লাগলে তা নিভিয়ে ফেলবে।
ডেভিড আমাকে সতর্ক করলো, এই সময় আমরা ওই মিটিং রূমের বাইরে যাবো না, কারণ ফায়ার ড্রিল যেহেতু চালু হবে অন্যান্য রূমগুলোতে অক্সিজেন সংকট হবে (কারণ ফায়ার ড্রিলের সময় কার্বন-ডাই-অক্সাইডও ছিটানো হয়) তাই মিটিং পয়েন্টের বাইরে গেলে তুমি অক্সিজেন সংকটে মারা পড়তে পারো।
এরপর বিল্ডিংয়ে মোট ৪টি ফায়ার-এক্সিট আছে যেখান দিয়ে আগুন লাগলে লোকজন দ্রুত বের হয়ে মিটিং পয়েন্টে জড়ো হতে পারে।
এবার আমাকে বিল্ডিংয়ের ছাদে নিয়ে গেলো যেখানে বড় বড় ফ্যান বসানো আছে যা বিল্ডিংয়ের ভেতর থেকে ধোঁয়াকে টেনে বের করে নিয়ে আসবে। ফলে ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা কম।
এ ছাড়া প্রতিটি বিল্ডিংয়ের গায়ে ফায়ার হাইড্রেন্ট সংযুক্ত আছে যেন দমকল কর্মীরা আসা মাত্র পানির সরবরাহ পায় এবং দ্রুত আগুন নিভাতে পারে।
এর বাইরেও প্রতিটি অফিসে একজন করে ফায়ার সেইফটি ট্রেনিং জানা লোক থাকতে হবে। ৪০ জনের বেশি লোক হলে দুইজন লোকের ফায়ার সেইফটি ট্রেনিং বাধ্যতামূলক।
এ ছাড়া প্রতি দুই সপ্তাহ পরপর একটা ফায়ার এলার্ম ট্রায়াল বাধ্যতামূলক। যেন লোকজন জানে ফায়ার এলার্ম বাজলে তাদের করনীয় কি এবং ফায়ার সেফটি সিস্টেম কাজ করছে সেটাও যাচাই করা।
আগুন নিয়ন্ত্রণের এতো আয়োজন দেখে ডেভিডকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি বলছো এই এই বিল্ডিং বেশ পুরনো তবুও তো এটাতে এতো কিছু রয়েছে, নতুন গুলোর কী অবস্থা? ওখানে আর বাড়তি কী থাকবে?
ডেভিড আমাকে উদাহারণ দেয়, তোমার যে হোটেল সেটা বেশ নতুন বিল্ডিং। ওই বিল্ডিংয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণের জন্য সফটওয়্যার ইন্সটল করা আছে। আর প্রতিটি ফ্লোরে কিছু রোবট আছে যারা আগুন নিয়ন্ত্রণে দ্রুত সাড়া দিতে পারে। দমকল কর্মীরা আসার আগেই তারা উদ্ধার তত্পরতা শুরু করতে পারে।
ডেভিডের দীর্ঘ ব্রিফিংয়ের পর নিশ্চিন্ত মনে ডেস্কে বসলাম কাজ করতে, আর ভাবছি আগুন নিয়ন্ত্রণে ৩০ বছর আগে থেকেই কত কি ব্যবস্থা! আর আমরা এখনো আগুন নিয়ন্ত্রণ তো দূরে থাক সাধারণ চলাফেরার জন্যই ভবনে সিড়ি রাখি বড়জোর ৩ ফুট প্রস্থের।
এতো লোভী কেন আমরা? সবখানেই শুধু আমার টাকা দরকার টাকা। আমরা এখন মধ্যম আয়ের দেশের পথে। সেটাও ওই জিডিপি-রিজার্ভ আর নানান টাকা পয়সার হিসেবে।
একটা ক্রাইসিস সামনে এলে তখন বুঝা যায় আমরা আসলে কতটুকু এগিয়েছি আর কতটুকু আমাদের এখনো আগাতে হবে।
আমরা এখনো পিছিয়ে আছি মানসিকতায়, শিক্ষায়, মানবিকতায়।
আমরা গর্ব করতে পারি রাস্তায় দামী গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে, উঁচু দালান বাড়ছে, স্কুল কলেজের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু সড়ক, দালান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সবকিছুই যেন এখন লাশ ভেগাস।
লেখক..
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন