শিহান মির্জা
হালযামানায় গণবিনোদন (Mass entertainment) উৎপাদনের জন্য যে ইন্ডাস্ট্রি সেটা কালচারাল ইন্ডাস্ট্রি নামেও পরিচিত। যদিও ‘কালচার’ শব্দটা ব্যাপক অর্থের অধিকারী, তবে কালচারাল ইন্ডাস্ট্রি বা কালচারাল প্রডাকশনকে অনেকটাই বিভিন্ন রকম বিনোদনমূলক পণ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলাটা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। ব্যাপারটি অনেকটা এদিকে ইঙ্গিত করে যে, অন্তত আধুনিক সময়ে একটা দেশের গণমানুষের সংস্কৃতি বা এর নিরঙ্কুশ অংশ এই কালচারাল ইন্ডাস্ট্রি দ্বারাই সংজ্ঞায়িত হয় এবং এর মাধ্যমেই রূপায়িত হয়ে উঠে। কালচারাল ইন্ডাস্ট্রি জিনিসটা একদমই আধুনিক রাষ্ট্রের জন্য স্বতন্ত্র, কিন্তু পুঁজিবাদী আধুনিক রাষ্ট্রে এটি যে জটিল ও অনন্য মাত্রা লাভ করেছে তা অবশ্যই চিন্তাভাবনার দাবী রাখে।
আধুনিক পুঁজিবাদ নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখার স্বার্থে একটি ভোগবাদী সংস্কৃতি গড়ে তুলতে বাধ্য। পুঁজিবাদের এবতেদায়ী ধারণা যাদের আছে তারা মাত্রই জানেন যে, পুঁজিবাদে বাজারকে ক্রমাগত প্রসারিত করে যেতে হয়। সেজন্যই নিত্য নতুন নতুন ভোগ্যপণ্য আবিষ্কার করা হয় এবং সেগুলোর চাহিদা তৈরির জন্য মানুষের মধ্যে কৃত্রিম অভাব তৈরী করা হয়। পুঁজিবাদী লজিক অনুযায়ী, মানুষ র্যাশনাল প্রাণী হয়ে ওঠে মার্কেটের লজিক মেনে চলে অর্থাৎ সে যদি পুঁজিপতি হয় তাহলে কিভাবে আরো মুনাফা লাভ করতে পারে, যদি শ্রমিক শ্রেণীর হয় তাহলে কিভাবে বেতন বাড়াতে পারে, যদি ভোক্তা হয় তবে কিভাবে আরো ভোগ্যপণ্য সংগ্রহ করতে পারে – এগুলোই মানুষের সিদ্ধান্ত নির্ধারণ করে দেবে। কালচারাল ইন্ডাস্ট্রিও এ স্কিমের বাইরে নয়। এখানে যারা বিনোদনের উৎপাদক এবং বিনোদনের ভোক্তা, তারাও উপরোল্লিখিত পুঁজিবাদী লজিকই মেনে চলেন।
পাশ্চাত্যে (এবং এর দ্বারা কালচারালি কলোনাইজড প্রাচ্যের অঞ্চলগুলোতেও) ঐতিহ্যবাহী সমাজব্যবস্থা থেকে আধুনিক সেক্যুলার সমাজব্যবস্থায় পরিবর্তনের ফলে যে কর্তৃত্বশীল (dominant) সমাজতাত্ত্বিক এবং বৈজ্ঞানিক বয়ান তৈরী হয়েছে, তা মহাবিশ্ব ও মানুষের পঞ্চইন্দ্রীয় অভিজ্ঞতাকে অতিক্রান্ত করে যায় (transcendent) এমন যেকোন উচ্চতর অর্থকে নাকচ করে দেয়। আর এর প্রভাব জনমানুষের ওপর পড়েছে তাদের জীবনে এ উচ্চতর অর্থের আংশিক বা পূর্ণ আচ্ছাদনের মাধ্যমে। মূলত অধি-একঘেয়েমি (hyperboredom) বা অস্তিত্বমূলক একঘেয়েমির (existential boredom) উদ্ভব হয়েছে ঠিক একারণেই। এটি এমন একঘেয়েমির (situational or simple boredom) বিপরীত যা কোন নির্দিষ্ট বস্তু, ব্যক্তি বা পরিস্থিতি দূর করার মাধ্যমে দূর হয়ে যায়। প্যাসকেল, সরেন কির্কেগার্ড, মার্টিন হাইডেগারসহ অন্যান্য আধুনিক পশ্চিমা দার্শনিকরা যে একঘেয়েমি নিয়ে কথা বলেছেন তা মূলত এই অস্তিত্বমূলক একঘেয়েমি। আধুনিক মানুষকে ক্রমাগত বিভিন্ন বস্তু, কাজ ও ঘটনার ওপর আরোপ করার জন্য ছোট ছোট খন্ডায়িত ও অস্থায়ী অর্থ তৈরী করে যেতে হয়, কারণ সে এমন কোন ব্যাপক (comprehensive) ও উচ্চতর অর্থ থেকে মাহরুম যা তার বিভিন্ন কাজ এবং ধাপগুলোকে একই সুতোয় বেঁধে একটি একতান (unity) সৃষ্টি করবে। অর্থহীনতার অনুভূতি মাত্রই যেহেতু একঘেয়েমিতা সৃষ্টি করে, আধুনিক মানুষ তার একঘেয়েমি কাটানোর জন্য অস্থায়ী অর্থ তৈরীর প্রয়াস পায় আর বৃহত্তর কোন ব্যাপক অর্থের অভাবে সেটা হয়ে দাঁড়ায় ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক নিম্নস্তরের দৈহিক ও মানসিক চাহিদা (base physical and psychic desires) পূরণ। “আধুনিক” মানুষ তার অবসরের অর্থহীনতা মূলত কালচারাল ইন্ডাস্ট্রির পণ্য ভোগ করতঃ নিম্নস্তরের মানসিক চাহিদা পূরণের মাধ্যমে দূর করার চেষ্টা করে। একটি বিনোদনমূলক প্রোগ্রাম যে অর্থ বা উদ্দেশ্য পূরণ করার জন্য উপভোগ করা হয়, তা তার অবসানের মাধ্যমেই শেষ হয়ে যায় না। বরং এর ফলে নতুন অনুরূপ প্রোগ্রামের জরুরত আরম্ভ হওয়া শুরু করে। ফলে আইরনিক্যালি, তা মানুষের মনে কেবল অশেষ চাহিদার অস্থিরতাই তৈরী করে; কোন স্থিতিশীলতা আনতে সক্ষম হয় না। হালযামানায় যারা মুভি, নাটক, সিরিজ বা ফুটবল লীগ চ্যাম্পিয়নশিপে আসক্ত, তাদের দ্বারা ব্যাপারটি বোঝা যায়। দেখা যায়, মানসিক ও শারীরিক অবসাদ বা অন্য কোন তাৎক্ষণিক জরুরত না আসা পর্যন্ত একের পর এক পণ্য আসক্ত ব্যক্তি ভোগ করে যায়। এই ধরনের ফেনোমেননের সবচেয়ে ভালো শাব্দিক প্রকাশ সম্ভবত ইংরেজি ‘binge’ শব্দটি দ্বারা করা যায়।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ঠিক এই ফেনোমেননকেই কাজে লাগিয়ে এই কালচারাল ইন্ডাস্ট্রির জন্য একরকমের নৈর্ব্যক্তিক (impersonal) বাজার তৈরী করে, যেটার গড় রুচি (average taste) অনুসারেই প্রডাক্ট তৈরী হয়। গড় মানুষ বলতে কোন কিছু নেই যার রুচিকে গড় রুচি হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে। মূলত গড় রুচির সাংস্কৃতিক পণ্য বলতে বুঝায়, পণ্যের সহজবোধ্যতা এবং এবং নিম্নস্তরের মানসিক প্রণোদনার আউটলেট হিসেবে এগুলোর তাৎক্ষণিক উপযোগিতা । আর এ ব্যাপারটিই এসব সাংস্কৃতিক পণ্যকে শিল্প (art) থেকে আলাদা করে। এর আগে কখনোই গণমানুষের চাহিদা বা রুচির দিকে লক্ষ্য রেখে শিল্পের (art) নির্মাণ হতো না। বরং সেসবে শিল্পীর নিজস্ব শৈল্পিকরা ও নান্দনিকতা ফুটে উঠতো। প্রকৃত শিল্প সেগুলোই বিবেচিত হত যা দর্শকের আপাতলব্ধ রুচি ও অভিজ্ঞতার যে অবিরামতা (continuum) সেটার পুনরাবৃত্তি না হয়ে এর মধ্যে সচকিত হস্তক্ষেপ করার যোগ্যতা রাখতো। কিন্তু আধুনিক সময়ে একটি শিল্পকে মূল্যায়ন করতে হলে চিন্তামগ্নতার যে মানসিক প্রচেষ্টা ও প্রচেষ্টার পিছে যে সময়ের প্রয়োজন হয়, কালচারাল ইন্ডাস্ট্রির প্রডাকশনগুলোর ক্ষেত্রে তার কোন দরকার পড়ে না। মানুষ তার স্বাভাবিক নান্দনিকতা (aesthetics) ও সৃজনশীলতা বিকাশের সুযোগ হারাচ্ছে।
তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে যে, কালচারাল প্রডাকশনের বিশাল বৈচিত্র্য কি নির্মাতাদের শৈল্পিকতার প্রমাণ বহন করে না? নতুন শৈল্পিক আইডিয়া ব্যতীত কিভাবে ক্রমাগতভাবে ভিন্ন ভিন্ন প্রডাকশন দেয়া সম্ভব! কিন্তু মূলত এই আপাতদৃষ্টিতে ধরা পড়া বিশাল পরিমাণের এই ভিন্নতার মূলে রয়েছে, থিওডর এডোর্নোর ভাষায়, এক ধরনের প্রামাণিক তালিকা (standardized menu), মুভি এবং গানের ক্যাটারাইজেশন সম্ভবত এদিকেই ইঙ্গিত করে। এই যে ক্রমাগত ভিন্নতা সেটি মূলত এই অধঃস্থ (underlying) প্রামাণিক তালিকার ভিন্ন ভিন্ন কম্বিনেশনাল ও পারম্যুটেশনাল পুনরাবৃত্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। এই পুনরাবৃত্তিও সম্ভব হয় মানুষের মৌলিক শারীরিক ও মানসিক চাহিদাগুলোর পৌনঃপুনিকতার ফলেই। আগেই বলা হয়েছে যে, কালচারাল ইন্ডাস্ট্রির প্রডাকশন উপরোক্ত চাহিদাগুলোর তাৎক্ষণিক সিদ্ধি করতে চায়। যেহেতু এই চাহিদাগুলো কখনো নিঃশেষ হয় না এবং ক্রমাগত পুনরাবৃত্ত হতে থাকে, ফলে এগুলোর চাহিদা মেটানোর ওপর ভিত্তি করে যেকোন কার্যকর মার্কেটের লাভ অর্জন সুনিশ্চিত, কালচারাল ইন্ডাস্ট্রি যার একটি নমুনামাত্র। প্রাক আধুনিক ট্রেডিশনগুলোতে মানুষের সত্ত্বাকে যৌক্তিক ও পাশবিক এ দু ভাগে ভাগ করা হত এবং পৌনঃপুনিক মৌলিক চাহিদাগুলোকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পাশবিক সত্ত্বাকে নিয়ন্ত্রণ এবং যৌক্তিক সত্ত্বার বিকাশের শিক্ষা দেয়া হত, সেখানে আধুনিকতার অন্যতম মাইলফলক হচ্ছে প্রাক আধুনিক যুগের এই নিয়ন্ত্রণকে চরমভাবে শিথিল করা এবং আগে যে অনেক নিম্নস্তরের চাহিদাগুলোর সিদ্ধ করাকে অনেকটাই নিন্দার চোখে দেখা হত অথবা অন্তত খুবই নিয়ন্ত্রিতভাবে তার অনুমোদন দেয়া হত, সেগুলোকে মানবপ্রকৃতির অংশ হিসেবে একরকমের নির্মলীকরণ (Sanctification) করা। আধুনিক ভোগবাদী সমাজের ভিত্তি অনেকটা এ দর্শনের ওপরই। কালচারাল ইণ্ডাস্ট্রির নামে গণবিনোদনের আধুনিক সংস্কৃতি যে শুধু এই ভোগবাদী ব্যবস্থার চাহিদা পূরণ করে শুধু তাই না, বরং ভোগবাদী সংস্কৃতিও তৈরী করে যার মধ্যে এ ধরনের ভোগবাদী-পুঁজিবাদী ব্যবস্থার স্থায়ী একটি রূপ লাভ করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে। এই সংস্কৃতিতে আপাতঃদৃষ্টিতে ব্যাপক বৈচিত্র্য দেখা গেলেও, মূলে তা এক ধরনের এক শৈলিক সংস্কৃতিই (Monoculture)। এ ব্যবস্থায় যদিও একজন নাগরিক কালচারাল ইন্ডাস্ট্রির উৎপাদক বা ভোক্তা মনে করছে যে, উৎপাদক বা ভোক্তা হিসেবে তিনি স্বাধীন, কিন্তু তা একধরনের ভ্রম ছাড়া আর কিছুই নয়। পূর্বোল্লিখিত প্রামাণিক তালিকা তার সামনে একটি নির্দিষ্ট বর্ণালী (Spectrum) নির্ধারণ করে দেয়। এর বাইরে গিয়ে সাংস্কৃতিক পণ্য নির্মাণ বা ভোগ করা যদি অসম্ভব নাও হয়ে থাকে, তবে তা অবশ্যই কঠিন এবং পুঁজিবাদী র্যাশনালিটিকে অমান্য করার স্পর্ধা দেখায়।
তবে এসবের বাইরে কালচারাল ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে বড় ভূমিকা হল ক্রিটিকাল সচেতনতা হ্রাস করা এবং স্থিতাবস্থাকে (Status quo) এক প্রকার সত্যায়ন করা। একজন আধুনিক মানুষ সারাদিনের যান্ত্রিক কর্মঘন্টা শেষে বিরতি হিসেবে এই গণবিনোদনেরই আশ্রয় নিচ্ছে। সে অর্থে আধুনিক মানুষের এই অবসর সময় মূলত তার কর্মঘন্টারই একটি প্রলম্বিত অংশ দিনশেষে, কারণ এই অবসরটা সে কাটাচ্ছে মূলত স্রেফ পুনরায় তার যান্ত্রিক কর্মঘন্টায় ফিরে যাওয়ার শক্তি অর্জনের জন্য। এই সময়টাতে বিনোদন মাধ্যমের সাথে তার মিথষ্ক্রিয়তা হচ্ছে অনেকটাই একপাক্ষিক। এর ফলাফল স্রেফ আত্মকেন্দ্রিকতা না, স্থিতাবস্থার প্রতিও এক ধরনের নিষ্পৃহতা। যে কর্পোরেট চাকুরিজীবি বা মেশিনের কলকব্জার মধ্যে দিন কাটানো শ্রমিক সারাদিনের কাজ শেষে বাসায় এসে প্রেম-ভালোবাসার নাটক দেখছে বা কোন সিরিজের পর্বের ক্লিফ হ্যাঙ্গিং সমাপ্তি দেখে ঘুমুতে যাচ্ছে পরদিন আবার কর্মক্ষেত্রে ফেরার জন্য এবং দিনের পর দিন একই চক্রের পুনরাবৃত্তি করছে, নিজেকে কিংবা বড়জোর নিজের পরিবারকে অতিক্রান্ত করে যাওয়ার তার সময় কোথায়?! মানুষের ব্যক্তিকতা ও সামষ্টিকতার মধ্যে সবসময়ই একটি ভারসাম্যের দরকার। মানুষের ব্যক্তিত্বের নিরঙ্কুশ বিকাশ ঘটে সামষ্টিকতার মধ্যেই, সামষ্টিকতার সাথে সচেতন ও নিঃস্বার্থ মিথষ্ক্রিয়তার মাধ্যমেই। আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী পুঁজিবাদী সমাজ মানুষকে তা থেকে মাহরুম করছে এবং এর মাধ্যমেই এক ধরনে সেলফ এলিয়নেশন ঘটছে। এই প্রক্রিয়ায় কালচারাল ইন্ডাস্ট্রি নিঃসন্দেহে একটি বড় হাতিয়ার।
শায়খ লুতফুল্লাহ মসজিদ
ইরানে অবস্থিত শায়খ লুতফুল্লাহ মসজিদের গম্বুজের আভ্যন্তরীণ অংশ
বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক জোসেফ পিপার তাঁর ‘Leisure: The Basis of Culture’ বইতে অবসরকে (leisure) নিষ্ক্রিয়তা নয় বরং সংজ্ঞায়িত করেছেন এক ধরনের মনোভাব হিসেবে যা ধারণ করার মাধ্যমে মানুষ হাক্বীকতের (reality) সামনে নিজের মনের দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়। মুসলিম সভ্যতার ভিত্তিমূল যে কোরআন তাতে বারবার জোর দিয়ে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, এই মহাবিশ্ব খেলাচ্ছলে বা নিরর্থকভাবে সৃষ্টি করা হয়নি। কিন্তু এর পরেও শরীয়াতে মুসলিমদের সীমার মধ্যে বিনোদনের অনুমতি রাখা হয়েছে। হাদীছে তীরন্দাজি, ঘোড়-সওয়ারী, দৌড়, সাঁতার, কুস্তি (এবং এর সম্প্রসারণ হিসেবে ক্বিয়াস অনুযায়ী অন্যান্য শারীরিক ও মানসিকভাবে উপকারী খেলাধুলা) ইত্যাদির প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। সাহাবীরা একসাথে তরমুজ খাওয়ার পর কৌতুকস্বরূপ একে অপরের দিকে তরমুজের অবশিষ্টাংশ ছুঁড়ে মেরেছেন। একজন মুসলিম তার অবসর কাটানোর জন্য একান্তে বসে প্রকৃতির সৌন্দর্য তথা খোদার সরাসরি আর্টওয়ার্ক উপভোগ করুক অথবা আদাব পড়ুক অথবা পরিবার বা বন্ধুবান্ধবদের সাথে খেলাধুলা বা অন্য কোন সৃজনশীল উপায়ে সময় কাটাক অথবা ইসলামী চারু ও স্থাপত্যশিল্পের এরাবেস্ক (arabesque), জ্যামিতিক ও প্রতিসাম্যিক (symmetrical) সূক্ষ্মতার সৌন্দর্য তন্ময় হয়ে আবিষ্কার করুক, এগুলোর বাহ্যিক ধরনে বিভিন্নতা থাকলেও প্রত্যেকটি বিভিন্নভাবে এক পরম হাক্বীকতকেই সমুজ্জ্বল করে তোলে। প্রাক আধুনিক মুসলিম সভ্যতায় শিল্প ব্যাপারটি কোন আলাদা পেশা ছিল না, শিল্প ছিল সর্বব্যাপী; মানুষের কোরআনের হরফের স্টাইল ও এর কভারের উপর ডিজাইন থেকে শুরু করে কাপড়, ঘরদোর, গৃহসরঞ্জাম, স্থাপত্য, মিউজিক, আদাব (সাহিত্য) সবকিছুতেই, এমনকি বিনোদন যেসব উপকরণের আশ্রয় নিতো সেগুলোতেও। এসব শিল্প কখনোই কেবল শিল্পের খাতিরে ছিল না বরং এগুলোর মাধ্যমে হাক্বীকতের ব্যাপারে ইসলামের তাসাওউরকে ফুটিয়ে তোলা হত। এরাবেস্ক যদি দর্শকের কল্পনার দিগন্তকে যদি খোদার অসীমত্ব দিকে টেনে নিয়ে যেতো, তবে স্থাপত্যে গাণিতিক ও জ্যামিতিক নির্ভুলতা (precision) চিরন্তন ও কালাতীত সৌন্দর্যকে প্রতিফলিত করতো, যা মূলত খোদায়ী বৈশিষ্ট্য। ‘আল্লাহ সুন্দর এবং তিনি সৌন্দর্যকে ভালোবাসেন।’ আদাব ছিল শিক্ষার অবিচ্ছেদ্য অংশ। আদাব অর্থ কেবল সাহিত্য না। এর অন্যান্য অর্থের মধ্যে আছেঃ ভদ্রতা, শিষ্টতা, নৈতিকতা, সংস্কৃতি, রীতি-নীতি, সবকিছুকে এবং সবাইকে তার যথাযোগ্য স্থান দেয়ার প্রজ্ঞা ইত্যাদি। ইসলামী সভ্যতায় সাহিত্যকে আদাব বলা হত ঠিক এই কারণেই যে, সাহিত্যের কাজ ছিল মানুষের মধ্যে খোদায়ী ওহী নির্দেশিত আদাব প্রোথিত করে দেয়া। তাই আদাব ছিল মুসলিমদের কাছে কোরআনিক মহাসাগরের দিকে ধাবমান নদীনালাস্বরূপ। রুমী, আত্তার, ইবনে ফরিদ, শেখ সাদী, আমীর খসরুসহ অসংখ্য কবিগণ তাদের রূহানী কবিতায় অর্থ, কাঠামো, ভঙ্গির মধ্যে কোরআনের সাথে নিকট সামঞ্জস্য ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন; এমনকি আবু নুয়াস, মুতানাব্বী ও আবুল আ’লা মা’আরির মত কবিদের লৌকিক কবিতায়ও কোরআনিক ভাষা, ছন্দ ও বাগধারার দেখা মিলতো। ইবনে সিনা, ইবনে তুফাইল, সোহরাওয়ার্দীদের দার্শনিক উপন্যাসগুলোতে কোরআনের বয়ান ও কনসেপ্টকে ব্যবহার করে আক্বল ও কল্পনাশক্তির সমগ্রতাসাধনকে উৎসাহিত করেছেন। আল ফারাবীসহ মুসলিম দার্শনিকগণ পিথাগোরিয়ান ঐকতানের মূলনীতিকে ব্যবহার করে বিস্তারিত সঙ্গীতত্ত্বের ভিত্তি স্থাপন করেছেন। ইসলামী সঙ্গীতের মধ্যেও ইসলামী হাক্বীকাতের ভিশন ফুটে উঠতো। ইসলামী সঙ্গীতসমূহের মধ্যে একটি স্থায়ী ছন্দ যেমন অপসৃয়মান সময়ের মধ্যে একত্বের ছাপকে প্রতীকায়িত করতো, তেমনি শেষেরদিকে একদম থেমে যাওয়ার আগে গানের গতি বৃদ্ধিকরণ ক্বিয়ামতের আগে সময়ের ত্বরণকে প্রতিফলিত করতো। এই সঙ্গীত বা সামাগুলো অনেকসময় সালাওয়াত বা কোরআনিক তেলাওয়াতের মাধ্যমে শুরু হতো। শ্রোতাদের কাছে তা অনেকটাই ছিল যেন ফেরেশতা ও দুনিয়া কর্তৃক খোদার শব্দহীন প্রশংসা শোনার মতই। প্রচলিত ছায়া-নাটক (shadow play) বা ফোকলোর ভিত্তিক পুঁথিপাঠের যে প্রচলন ছিল, যেটাকে শিক্ষিত শ্রেণীতে কিঞ্চিৎ নিচু চোখে দেখা হত, সেগুলোতেও যে স্রেফ দর্শক ও শ্রোতাদের জন্য বিনোদন থাকতো তা নয়, কোরআনিক নৈতিকব্যবস্থাকে প্রতিফলিত করতো। ইসলামী শিল্পকলা নিয়ে আলোচনা এই আর্টিকেলের বিষয় বস্তু নয়, যে নোক্তাটি এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে সেটা হচ্ছে, বিনোদনের ধারণার মধ্যে যে এক ধরনের অনর্থকতার ও লঘুত্বের অর্থ ইঙ্গিতবহ, যেটা কিনা আধুনিক সময়ে এসে আরো বেশী সুস্পষ্ট, সেখানে এই সম্পূর্ণ অনর্থকতাটা মুসলিমদের ঐতিহ্যবাহী বিনোদনের ধারণার মধ্যে কখনো বিদ্যমান ছিল না; এ বিনোদন কর্মময় এবং ‘অর্থপূর্ণ’ জীবন থেকে বিচ্ছিন্নতা ছিল না বরং দুয়ের মধ্যে ছিল একরকম অবিচ্ছিন্নতা।
আধুনিক যুগে এসে অবশ্যই গণমাধ্যমকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। তবে একে ভোগবাদী-পুঁজিবাদী স্কিম থেকে বের করে আনতে হবে যেন এটি স্রেফ মানুষের হীনস্তরের চাহিদাগুলোর ইন্ধন না হয়েও মানুষের মানসিক প্রশান্তি ও প্রফুল্লতার মাধ্যম হতে পারে এবং অর্থহীনতার মধ্যে আপতিত না হয়। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা সেটা হচ্ছে, বিনোদন ও অবসর যাপনের জন্য গণবিনোদন বা কালচারাল ইন্ডাস্ট্রির ওপর একান্ত নির্ভরতার অবসান। যথার্থ অবকাশযাপন হাক্বীকতের সাথে সংযোগের মাধ্যমেই হওয়া সম্ভব, ম্যাস এন্টারটেইনমেন্টে বুঁদ হয়ে হাক্বীকতের সাথে সাময়িক সম্পর্কচ্ছেদের মাধ্যমে নয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন