ক্রাউশ কায়
০১.
“... যে সদ্যনির্মিত বাড়িতে উঠলাম, সেগুলিকে বলা হত টুইন কোয়ার্টাস (Twin quarters) পাশাপাশি দু’টি ডুপ্লেক্স, সামনে-পেছনে বেশ খানিকটা জমি নিয়ে প্রতিটি বাড়ির কম্পাউন্ড, আমার স্ত্রী মহাউৎসাহে কৃষিকর্ম — পেছনের জমিতে সবজিক্ষেত শুরু করলেন। অবশ্য সামনের চত্বরে পাশাপাশি মৌসুমী ফুলের চর্চাও ছিল। ক্যাম্পাসে এ-পর্যায়ে দু ধরনের বাসগৃহ তৈরি হয়েছিল, — সদ্য উল্লেখিত টুইন-ফ্ল্যাট, দোতলা ও ৬টি ফ্ল্যাট নিয়ে ৩ তলা বাড়ি। এই ফ্ল্যাটগুলিও ছিল সুপরিসর।
ষাটের দশকে এই ছিল এই ছিল রেওয়াজ। এরপর যত সময় গড়িয়েছে, সরকারি-আধাসরকারি ভবনের পরিসর সঙ্কুচিত হয়েছে। বিরাজমান অর্থনৈতিক বাস্তবতাই বাধ্য করেছে আমাদের আবাসন চিন্তা ও কল্পনার রাশ টেনে ধরতে।
বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনী যারা দখলদারমুক্ত রাজশাহী ক্যাম্পাসে এল, তারা ক্যাম্পাসের বাড়িঘরের চেহারা দেখে মন্তব্য করেছিল, এত ভালো ব্যবস্থা তােমাদের, এরপরও তােমরা নাখােশ ছিলে পাকিস্তানিদের প্রতি? মন্তব্য করেছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর পানজাবি কোন সদস্য। ওদের একটা রক্তের টান ছিল পরাজিত পাকিস্তানিদের প্রতি। তবে এটাও মিথ্যে নয় যে আমাদের সরকারি আধা-সরকারি ভবন নির্মাণে আমরা দেশের সীমিত সম্পদের কথা সব সময় বিবেচনা করিনি, দেশের অধিকাংশ দরিদ্র জনগণের কথা ভাবিনি এবং সকল ক্ষেত্রে পরিমিতিবােধের পরিচয় দিতে পারিনি। মতিহার ক্যাম্পাসে উপাচার্য ভবন ও প্রভােস্ট ভবন আমাদের এই বিলাসী কল্পনার সাক্ষ্য।
... দারুণ উত্তেজনার সৃষ্টি হল সেপ্টেম্বরের যুদ্ধকে কেন্দ্র করে। ক্যাম্পাসে রাতের বেলা নিষ্প্রদীপ, প্রত্যেক বাড়িতে বালুর স্তুপ দিয়ে দরোজার সামনে বাঁধ তৈরি, সারা দিনের উত্তেজনাময় আলাপ যুদ্ধের প্রতিদিনের পরিস্থিতি নিয়ে, রাতে জাগরণ ও ক্যাম্পাসবাসী আমাদের পালাক্রমে প্রহরীর কর্তব্য পালন। কী ধরণের কর্তব্য সম্পাদন করতে হবে, সে বিষয়ে কোন স্পষ্ট ধারণা ছিল না। শুধু জানতাম, জেগে থাকতে হবে, ও ওপর থেকে কোন নির্দেশ এলে পালন করতে হবে। পাকিস্তানে পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে যে রাজনৈতিক টানাপোড়েন চলছিল, যুদ্ধের ধাক্কায় সব মিলিয়ে গেল। পূর্ববাংলায় আমরা এক প্রবল পাকিস্তানি ভাবের জোয়ারে ভেসে গেলাম।
রেডিওতে (তখনও টেলিভিশন আসেনি) দেশাত্মবোধের বন্যা বইয়ে দিলেন কর্তৃপক্ষ। রেডিও পাকিস্তানের রাজশাহী কেন্দ্র থেকে যুদ্ধ প্রচারনায় খুব সফল অনুষ্ঠান করলেন আমাদের বন্ধু, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আবু হেনা মোস্তফা কামাল। একাত্তরে তার এই সাফল্যই তার কাল হয়েছিল। ঢাকা কেন্দ্র থেকে এধরণের অনুষ্ঠান করে যিনি বিখ্যাত হয়েছিলেন, তিনি জনাব নূরুল মোমেন, নাট্যকার। যুদ্ধের সঙ্কট এভাবেই কোন কোন ব্যক্তির সৃষ্টিশীলতার এক অজানা কক্ষ উন্মোচন করে দেয়। এভাবেই, একাত্তরে দিয়েছিল সাংবাদিকতার জগত থেকে আসা এম. আর. আখতার মুকুলকে।
কথায় আছে, যুদ্ধের প্রথম বলি হল সত্য। '৬৫-র সেপ্টেম্বরের ১৭ দিনের যুদ্ধে, '৭১-এর নয় মাসের যুদ্ধে, এ-কথার সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে। রেডিওতে আবু হেনা মোস্তফা কামালের প্রচারকর্মটির নাম ছিল 'শুভঙ্করের ফাঁকি'। আমার সঙ্গে ওর ছিল একটা দৃঢ় বন্ধুত্বের সম্পর্ক। আমি শুধু এই জানি যে আবু হেনা তার বেতার-প্রচারে একটাই লক্ষ্য রেখেছিলেন, - কিছু তথ্য দিয়ে ভারতীয় প্রচারণার বেলুন ফুটো করা। তার নিজস্ব অপরূপ বাকভঙ্গি দিয়ে তিনি এ-কাজটি করতেন। স্বীকার করতে লজ্জা নেই, এ-সব পাল্টাপাল্টি রেডিও-প্রচার যুদ্ধে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। আমি জানতাম, আবু হেনা যা করছে, নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তার দায়েই তা করছে। তার ভিতরে-ভিতরে চলছে সার্বক্ষণিক রক্তক্ষরণ। কিন্তু যুদ্ধশেষে মুজিবনগরের বিচারকেরা সেটা বিবেচনায় আনেনি। আবু হেনার নিজের গুরুস্থানীয়া নিলীমা ইব্রাহীমও অত্যন্ত কঠোর মনোভাব গ্রহণ করেছিলেন, তার প্রতি। যুদ্ধের পর বেশ কিছুদিন, বাংলাদেশ বেতারে আবু হেনা ছিল নিষিদ্ধ শিল্পীর তালিকায়।
কিন্তু '৬৫-র যুদ্ধসময়ে তিনি যা করেছিলেন, তা সর্বান্তকরণেই করেছিলেন মনে করব। সেদিন আমরা সবাই মনে-প্রাণে পাকিস্তানী ছিলাম। আমাদের বাঙালিত্ববোধের সঙ্গে এর কোন বিরোধ সেদিন আমরা দেখিনি। পশ্চাদ্দৃষ্টিতে একটু অসঙ্গিপূর্ণ মনে হবে, কিন্তু সেদিনের বাস্তবতা বোধহয় এরকমই ছিল॥”
- জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী / আমার চলার পথে ॥ [ জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ - জুন, ২০১২ । পৃ: ১৩৭ ]
০২.
“... ভারতবর্ষ তথা বাঙ্গালা বিভক্তির পর তৎকালীন পাকিস্তানের পূর্ববঙ্গ প্রদেশ (বর্তমানে বাংলাদেশ) সে সময় (১৯৪৭) কি-কি ভাগে পেয়েছিল তার একটি মােটামুটি ধারণা অবশ্যই শ্রমিক শ্রেণীর থাকা দরকার।
পূর্ববঙ্গ পেয়েছিল ৪ কোটি ২০ লক্ষ জনসংখ্যা অধ্যুষিত ৫৪,৫০১ বর্গমাইল এলাকা। আর এ জনসংখ্যার প্রায় ৮০ শতাংশই ছিলেন আধা-সর্বহারা বা সর্বহারা।
এখানকার অধিকাংশ জমিদারই ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের। ধনশালী আর সম্পদশালী ছিলেন তাঁরাই। পূর্ববঙ্গের বড় ব্যবসায়ী ও মহাজন প্রায় সবই হিন্দু সম্প্রদায়েরই ছিলেন। তাঁদের বৃহৎ অংশই অর্থাৎ ধন-সম্পদশালীদের প্রায় সবাই যা কিছু গড়েছিলেন বা বিনিয়ােগ করেছিলেন তার প্রায় সবই কলিকাতা ও হুগলী ভিত্তিক এবং বাঙ্গালা বিভক্তির পর তাঁরা পূর্ববঙ্গ ছেড়ে চলে যাওয়ার ফলে তাঁদের পুঁজি-সঞ্চিত অর্থসহ অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী সবই ভারতে চলে যায়। জ্ঞান চক্রবর্তী তাঁর “ঢাকা জেলার কমিউনিস্ট আন্দোলনের অতীত যুগ” বইয়ের ১৩১ পৃষ্ঠায় বলেছেন, “ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান রাষ্ট্রকে হিন্দু জনসাধারণ প্রথম হইতেই আপনার বলিয়া মনে করিতে পারে নাই। ফলে দেশ বিভাগের পরেই হিন্দুরা ব্যাপকভাবে দেশত্যাগ শুরু করে। হিন্দু সরকারী কর্মচারীরা প্রায় সকলেই অপশনের ব্যবস্থা অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে চলিয়া যায়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মীরাও, বিশেষ করিয়া আর, এস, পি, ও ফরােয়ার্ড ব্লকের লােকেরা তাহাদের পরিবারসহ দেশত্যাগ করে।”
ঐ পর্যায়ে মুসলমান সম্প্রদায়ের হাতে মূলতঃ তেমন কোন মূলধন ছিল না। এমনকি এ অঞ্চলের একমাত্র অর্থকরী ফসল পাট ব্যবসায়টিও মূলতঃ হিন্দু মাড়ওয়ারীদের হাতেই ছিল। তারা আবার মুনাফার টাকাটা ভারতেই বিনিয়ােগ বা স্থানান্তরিত করতেন।
পূর্ববঙ্গের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির অধিকাংশই প্রতিষ্ঠিত ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের দ্বারা। তাই কয়েক হাজার সম্পদশালী হিন্দু পরিবার পূর্ববঙ্গ থেকে চলে যাওয়ার ফলে শুধু যে পূর্ববঙ্গের অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়েছিল তাই নয়, এখানকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিও মারাত্মকভাবে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিল।
সে বিপর্যস্ত অর্থনীতির পাশাপাশি ভারত থেকে আসতে থাকল লক্ষ লক্ষ নিঃস্ব বাস্তুত্যাগী মানুষের ঢল যার সংখ্যা সরকারী হিসাবেই সাত লক্ষ বলে বলা হল।
পূর্ববঙ্গের ভাগে চাষযােগ্য জমি পড়েছিল সর্বমােট দুই কোটি চল্লিশ লক্ষ একরের মত, যার মধ্যে ঐ সময়কালে এক কোটি আশি লক্ষ একরের মত চাষ করা সম্ভব হত; আর এর মধ্যে আঠার লক্ষ একরের মত পাট চাষযােগ্য জমি ছিল। অর্থকরী ফসল বলতে ছিল একমাত্র পাট। কিন্তু বাঙ্গালার ৬৮,২৫৮টি তাঁত সম্বলিত ১১৩টি পাটকলের মধ্যে একটি পাটকলও পূর্ববঙ্গের মাটিতে ছিল না। আর এখানে খাদ্যশস্য যা উৎপন্ন হত তা আবার এই প্রদেশের জনসংখ্যার প্রয়ােজনের তুলনায় ছিল কম; তাই ছিল খাদ্য ঘাটতি সমস্যা।
শিক্ষার দিক থেকে পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা পিছিয়ে ছিলেন যথেষ্ট পরিমাণে। তাই চাকুরীর ক্ষেত্রেও এখানকার হিন্দু সম্প্রদায়ই অগ্রগামী ছিলেন; তাদের মধ্যকার সক্ষম অংশও তখন ভারতে চলে গেলেন। এ প্রসঙ্গে একটি মাত্র উল্লেখ থেকেই তখনকার পূর্ববঙ্গের বাকি অবস্থাটা বুঝতে পারা যাবে, তাহল এই যে, সে সময় সুপেরিয়র সিভিল সার্ভিসের মধ্যে মাত্র একজন এখানকার মুসলমান কর্মচারী ছিলেন।
এর ফলে যে প্রশাসন যন্ত্র পূর্ববঙ্গের জনগণের উপর চেপে বসে তা গঠন করতে হয় পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশের লােক ও বাস্তুত্যাগীদের মধ্য থেকেই।
খনিজ সম্পদ বলতে পূর্ববঙ্গ কিছুই পায়নি। তবে এখানে মৎস্য সম্পদ ছিল। আর ছিল দুই লক্ষ হস্তচালিত তাঁত।
বন সম্পদ যা পাওয়া গিয়েছিল তা রাজেন্দ্র প্রসাদ-এর 'ইন্ডিয়া ডিভাইডেড’ বইয়ের ২৯০ পৃষ্ঠায় উল্লেখিত তথ্যই যথেষ্ট। তিনি বলেছেনঃ “ঐ সময়ের (বিভাগপূর্ব) সমস্ত বাঙ্গালার ৬,৫৮,০৩৩ টাকা সরকারী রাজস্ব আয়ের বনাঞ্চলের মধ্যে যে অংশ পূর্ববঙ্গের ভাগে পড়ে তার সরকারী রাজস্বের পরিমাণ ছিল মাত্র ২,০০,০০০ টাকার কিছু উপরে। আর পশ্চিমবঙ্গ পেয়েছিল ৪,৫০,০০০ টাকা রাজস্ব আয়ের বনাঞ্চল।”
অর্থাৎ পূর্ববঙ্গের ভাগে বনসম্পদ পড়েছিল রাজস্ব আদায়ের অনুপাতে সমগ্র বাঙ্গালার বন সম্পদের ১৩ ভাগের ৪ ভাগ মাত্র।
পূর্ববঙ্গের স্থলপথ ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের। তেমন উল্লেখযােগ্য পরিমাণের পাকা রাস্তা এখানে ছিল না। তবে রেলপথ উন্নত ছিল এবং রেলপথ পাওয়া গিয়েছিল ১,৬১৯ মাইল। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই রেলপথগুলি খুব বেশী ব্যবহারের ফলে ইঞ্জিন ও গাড়ী যা পাওয়া গিয়েছিল তার অবস্থা প্রায় ভগ্নদশায় এসে দাঁড়িয়েছিল।
শিল্প বলতে যা বুঝায় তা পূর্ববঙ্গের ভাগে যা পড়েছিল তা অতি নগণ্য-তেমন উল্লেখযােগ্য শিল্প এখানে স্থাপিত ছিল না। এ প্রসঙ্গে প্রফেসর আর. কুপল্যান্ড-এর খতিয়ানটি উল্লেখযােগ্য। তিনি তাঁর 'The future in India' (ভারতের ভবিষ্যৎ) বইয়ের ৯৬ পৃষ্ঠায় বলেছেন যে, "বৃটিশ ভারতের শতকরা ২০ ভাগ লােকের বাস বাঙ্গালায় এবং শিল্পীয় শ্রমিকের সংখ্যার হিসাবের অনুপাতে বৃটিশ ভারতের ৩৩ শতাংশ শিল্প বাঙ্গালায় অবস্থিত। কলিকাতা বাদে পূর্ববঙ্গে অবস্থিত বৃটিশ ভারতের শিল্প মাত্র ২.৭ শতাংশ।
অর্থাৎ বৃটিশ ভারতের সমগ্র শিল্পের মধ্যে বাঙ্গালায় ছিল ৩৩ শতাংশ শিল্প। তার মধ্যে পূর্ববঙ্গ পেল ঐ ৩৩ শতাংশের মধ্যে মাত্র ২.৭ শতাংশ, আর বাকি ৩০.৩ শতাংশ শিল্পের অধিকারী হল ভারতভুক্ত পশ্চিমবঙ্গ। তাছাড়া বৃটিশ ভারতের সমগ্র বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলির মধ্যে মাত্র ৩ শতাংশ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র পড়েছিল সমগ্র পাকিস্তানের ভাগে।
রাজেন্দ্র প্রসাদ ‘ইন্ডিয়া ডিভাইডেড’ বইয়ের ২৯৫-২৯৬ পৃষ্ঠায় এ প্রসঙ্গে যা বলেছেন তা হল : পূর্ববঙ্গ, পশ্চিম পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, বেলুচিস্তান ও সিন্ধু (অর্থাৎ তদানিন্তন পাকিস্তান - লেখক) অংশে বৃটিশ ভারতের ২৬.৭ শতাংশ লােকের বাস ছিল; কিন্তু এসকল অঞ্চলে সম্মিলিতভাবে শিল্পের অবস্থান ছিল বৃটিশ ভারতের মাত্র ১৩.৯ শতাংশ। আর বৃটিশ ভারতের শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিকদের মধ্যে মাত্র ৭.৩৬ শতাংশ শ্রমিক এ সকল অঞ্চলের (অর্থাৎ তদানিন্তন সমগ্র পাকিস্তান - লেখক) শিল্পে নিযুক্ত ছিল।
আদতে শিল্পের দিক থেকে পূর্ববঙ্গ পরিপূর্ণভাবেই অবহেলিত ছিল। এমনকি বিখ্যাত রাজনীতিবিদ এ, কে, ফজলুল হক, শহীদ সােহরাওয়ার্দী এবং খাজা নাজিমুউদ্দীন এক্ষেত্রে কোন উল্লেখযােগ্য অবদানের অধিকারী হতে পারেননি।
পূর্ববঙ্গে কি-কি শিল্প তখন ছিল না বা পশ্চিমবঙ্গে কি-কি শিল্প পড়ল তা বলে বক্তব্য দীর্ঘায়িত করব না। শুধু পূর্ববঙ্গ তখন শিল্প বলে যা পেয়েছিল তাই এখানে উল্লেখ করছি আর তা হল :
১। ৫০,০০০ টন উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি মাত্র সিমেন্ট ফ্যাক্টরী ছাতকে। ২। ৭টি কাপড়ের কল ২৬০০ লুম ও ১,১২,০০০ স্পিন্ডল সম্বলিত। ৩। ৫টি চিনির কল। ৪। ৩৫ থেকে ৪০টির মত জুট বেলিং প্রেস। ৫। ৬০/৬৫টি ধান ভাঙ্গান কল। ৬। ছােট ছােট কয়েকটি ছাপাখানা। ৭। ছােট-খাট কয়েকটি এঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ ও ডক। ৮। মাত্র ৭,৭০০ একরের চা বাগান। ৯। সৈয়দপুর ও পাহাড়তলীতে শুধু মেরামতযােগ্য দুটি রেলওয়ে ওয়ার্কশপ। ১০। ছােট ৪টি ম্যাচ (দিয়াশলাই) কারখানা।
এর বাইরে উল্লেখ করার মত আর কোন শিল্প পূর্ববঙ্গের ভাগে পড়েনি। পূর্ববঙ্গ আর যা পেয়েছিল তা হল : (ক) মাত্র ৭২৮৬ কিলােওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। (খ) নদী পথে চলাচলের জন্য যাত্রীবাহী কিছু জাহাজ ও লঞ্চ ছিল। (গ) নদী পথে মাল চলাচলের জন্য বার্জ, ফ্লাট, স্টিমার ও টাগ প্রভৃতি ছিল। (ঘ) সে সময়কালে বছরে মাত্র ৫ লক্ষ টনের মত মাল হ্যান্ডলিং করার ক্ষমতাসম্পন্ন চট্টগ্রাম বন্দর। (ঙ) ঢাকায় একটি ছােট বিমান ঘাটি ছিল। এ প্রসঙ্গে আর উল্লেখ করার মত কিছু পূর্ববঙ্গ পায়নি।
পূর্ববঙ্গের কমিউনিস্ট নেতৃত্ব তখন পূর্ববঙ্গে (সমগ্র পাকিস্তানে নয়) পাকিস্তান সরকারের প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রের বিশ্লেষণ করে এই সরকারকে উচ্ছেদের আহবান জানিয়ে হাজার হাজার গােপন ইস্তাহার বিলি করেছিলেন। তাঁদের সেই কৃষকসভা সর্বস্ব ‘পাটি’র ‘সশস্ত্র বিপ্লবের’ নামে হঠকারিতার প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল প্রধানত পূর্ববঙ্গের গ্রামাঞ্চল। এই বিপ্লবের পর্বে পূর্ববঙ্গের কৃষির যথেষ্ট ক্ষতিসাধিত হয়েছিল। এমনিতেই এখানে খাদ্য ঘাটতি থাকত, তার উপর ১৯৪৮-৪৯ সালের উৎপাদনের হিসাবের তুলনায় ১৯৪৯-৫০ সালে তিন লক্ষ টন চাউল কম উৎপাদন হল। এর পাশাপাশি পূর্ববঙ্গের একমাত্র অর্থকরী ফসল পাটের উৎপাদন ১৯৪৮-৪৯ সাল থেকে হ্রাস পেতে থাকে এবং ১৯৪৭-৪৮ সালের তুলনায় ১৯৪৯-৫০ সালে পাটের উৎপাদন অর্ধেকেরও নীচে নেমে যায়। যেমন ১৯৪৭-৪৮ সালে যেখানে পাট উৎপন্ন হয়েছিল ৬৮,৪২,০০০ বেল সেখানে ১৯৪৯-৫০ সালে পাট উৎপন্ন হল মাত্র ৩৩,৩৩,০০০ বেল। একদিকে চাউলের উৎপাদন ঘাটতি এবং অন্যদিকে বিনিময়পণ্য পাটের উৎপাদনের বিপর্যয়ের ফলে ১৯৪৯ সাল থেকে পূর্ববঙ্গে খাদ্য সংকট অত্যন্ত তীব্ররূপ ধারণ করেছিল।
এই সময়কালে বেশকিছু সু-শিক্ষিত ও প্রতিভাবান তরুণও মার্কসবাদের চর্চা শুরু করেছিলেন এবং মার্কসবাদের দিকে ঝুঁকে ছিলেন, যদিও ঐ হঠকারী ‘বিপ্লবে’র ফলে তারাও নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন।
সে সময়কালের ঐ কমিউনিষ্ট পার্টির অবস্থান প্রসঙ্গে জ্ঞান চক্রবর্তী তার “ঢাকা জেলার কমিউনিস্ট আন্দোলনের অতীত যুগ” বইয়ে বলেছেন, “পাটির অধিকাংশ কমরেডই ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত ... অপরদিকে মুসলিম লীগের প্রচার এবং মুসলিম জনসাধারণের পার্টি বিরােধী মনােভাবের ফলে মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত পাটি কর্মীদের ভিতরে অনেকেই পার্টির সহিত খােলাখুলি যােগাযােগ রাখিতে ইতস্ততঃ করিতে থাকেন (পৃঃ ১৩৭) ... পার্টির সমস্ত কিছু গােপন ব্যবস্থা ছিল হিন্দু কমরেড়দের ভিত্তি করিয়া এবং পার্টির সক্রিয় কর্মীর বেশীর ভাগই হিন্দু সম্প্রদায় হইতে আগত (পৃঃ ১৪৯)।”
একদিকে প্রচলিত ঐ হঠকারী সশস্ত্র সংগ্রামের কার্যকলাপ, অন্যদিকে খাদ্য সংকটসহ পূর্ববঙ্গের জনগণের অন্যান্য দুঃখ-দুর্দশার কারণে সৃষ্ট অসন্তোষ ব্যাপক গণ-আন্দোলনের সৃষ্টি করতে পারে আশংকায় মুসলিম লীগ সরকার আতংকিত হয়ে উঠেছিল। সে সময় ৯০ শতাংশেরও বেশী হিন্দু সম্প্রদায়ের লোেক ঐ কমিউনিস্ট পাটি’র ‘সভ্য’ থাকার সুযােগে, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক কৌশলের মাধ্যমে সে ‘সশস্ত্র সংগ্রাম’ ও গণ-অসন্তোষ দমনের কোনরূপ পদক্ষেপ গ্রহণ না করে প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম লীগ সরকার কিছু ভাড়াটে লােকজন তথা গুন্ডাপান্ডাদের উষ্কানি দিয়ে ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে পূর্ববঙ্গে এক জঘন্য হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধিয়ে দিয়ে তথাকথিত ‘সশস্ত্র সংগ্রামে’র অবসান ঘটাতে প্রয়াশ পায়। কিন্তু ভারতেও শুরু হয়েছিল এক ব্যাপক হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা।
এর ফলে পূর্ববঙ্গের হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যম শ্রেণীর ব্যবসায়ী ও মহাজনসহ দক্ষ হস্তশিল্পী ও কারিগর এবং বুদ্ধিজীবী শ্রেণী ব্যাপক আকারে পূর্ববঙ্গ ত্যাগ করে চলে যান। অপরদিকে পূর্ববঙ্গে আসতে থাকে উদ্বাস্তুদের ঢল যাদের অধিকাংশই আসেন সহায়-সম্বলহীন অবস্থায়। পূর্ববঙ্গের অর্থনীতি বলতে বাকী যা ছিল তা ঐ পর্বে ধ্বংসপ্রাপ্ত হল আর সে সঙ্গে ঐ হঠকারী রাজনীতির খেসারত দিতে হল লক্ষ লক্ষ নিরীহ সাধারণ জনসাধারণকেই।
ভারতবর্ষ তথাকথিত ধর্মভিত্তিক বিভক্তির মধ্য দিয়ে দু’টি পৃথক রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের ফলে ১৯৪৭ সালের আগষ্ট মাসের পরে এখানে সার্বিকভাবেই একটি নূতন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভের পর পাকিস্তানে রাজনৈতিক অঙ্গন তথা রাজনৈতিক আন্দোলনের অবস্থাটারও নিশ্চয়ই পরিবর্তন ঘটেছিল এবং অবশ্যই এই নূতন আঙ্গিকে শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনের ক্ষেত্রেও নূতন দৃষ্টিভঙ্গী অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছিল। তাছাড়া যেখানে বৃটিশ ভারতের ২৬.৭ শতাংশ মানুষের পাকিস্তানের ভাগে পড়েছিল বৃটিশ ভারতের মাত্র ১৩.৯ শতাংশ শিল্প, আর ঐ শিল্পে নিযুক্ত ছিল বৃটিশ ভারতের মাত্র ৭.৩৬ শতাংশ শ্রমিক। পাকিস্তানের পূর্ববঙ্গ প্রদেশের প্রশ্ন তুললে দেখা যাবে যে বৃটিশ ভারতের প্রায় ১৫ শতাংশ মানুষের পূর্ববঙ্গের ভাগে পড়েছিল মাত্র ২.৭ শতাংশ শিল্প, আর শিল্পীয় শ্রমিকের অনুপাতে শিল্পীয় শ্রমিকের সংখ্যা পূর্ববঙ্গের ভাগে পড়েছিল মাত্র ১.৪৩ শতাংশ।
উপরন্তু, ১৯৪৬ সালের ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মাত্র এক বছর পর ‘ধর্মভিত্তিক’ দু’টি রাষ্ট্রের সৃষ্টি স্বাভাবিকভাবেই উভয় দেশের সংখ্যালঘু জনসাধারণের মধ্যে ভয়-ভীতির সঞ্চার করেছিল; আর এ ভয়-ভীতি নিরসনের দায়-দায়িত্ব স্বাভাবিকভাবেই বর্তায় শ্রমিক শ্রেণীর পার্টি অর্থাৎ কমিউনিষ্ট পার্টির উপর (যদি তা থাকে) অথবা শ্রমিক শ্রেণীর উপর। কোন কমিউনিষ্ট পার্টির পক্ষে ঐ অবস্থায় কোনরূপ হঠকারিতার পদক্ষেপ গ্রহণ করার প্রশ্নই উঠতে পারে না। তবে কমিউনিষ্ট নামধারী ‘সংকীর্ণতাবাদী পার্টি’ বা ‘সংকীর্ণচেতা কমিউনিষ্ট’দের পক্ষে হঠকারিতার আশ্রয় নিয়ে ঘোলাজলে মৎস্য শিকারের পদক্ষেপ গ্রহণ করা খুবই স্বাভাবিক।
পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পরই ঐ সকল ‘কমিউনিষ্ট’রা যে ভাবে আর যে পদ্ধতিতে কাজ করা শুরু করলেন তাতে শুধু তারাই যে নির্যাতিত হয়েছিলেন তা নয় - অন্যান্য সামগ্রিক ক্ষতির পাশাপাশি সে সময়কালে যে সকল সুশিক্ষিত, প্রতিভাশালী ও সাহসী তরুণ মার্কসবাদের দিকে আকৃষ্ট হয়েছিলেন তাদেরও এরা সর্বনাশ করেছেন, আর সে সঙ্গে শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনের নামে নিজস্ব মনগড়া ‘সংকীর্ণ কমিউনিজমের বেড়াজালে আবদ্ধ থেকে’ নবাগত প্রতিভাবান তরুণসহ সমগ্র শ্রমিকশ্রেণীকে এঁরা বাধার সৃষ্টিই করেছেন এবং তথাকথিত ‘মাতৃপার্টি’ আর ‘পিতৃপার্টি’র ধোয়া তুলে বর্তমান পর্যায়েও শ্রমিক শ্রেণীর মঞ্চটাকে বিভিন্নভাবে ও কৌশলে দখল করে রেখেছেন। তাদের ঐ সময়কালের কার্যকলাপ প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলিকেই ঐক্যবদ্ধ হতে এবং শ্রমিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণে সহায়তা করেছিল। সর্বোপরি ১৯৫৪ সালে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল সরকার ঐ ‘কমিউনিষ্ট পার্টি’র কার্যকলাপ বেআইনী ঘোষণা করেছিল।
পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পরই ঐ সকল ‘সংকীর্ণতাবাদী কমিউনিষ্ট’রা তাদের তথাকথিত রাজনীতির প্রশ্নে পূর্ববঙ্গ প্রদেশকে পাকিস্তান থেকে আলাদা করে ফেলেছিলেন। পাকিস্তানের তিনিটি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল, সাতটি কেন্দ্র শাসিত রাজ্য ও চারটি প্রদেশের মধ্যে পূর্ববঙ্গ ছিল একটি প্রদেশ। পূর্ব পাকিস্তান নামে তখন (১৯৫৫ সাল পর্যন্ত) কোন প্রদেশের নামকরণ করা হয়নি, অথচ ঐ সকল ‘সংকীর্ণতাবাদী কমিউনিষ্ট’ নেতৃত্ব ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারী- মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত ‘ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টি’র কলিকাতা কংগ্রেসে বসে শুধু একটি তথাকথিত ‘পাকিস্তানের কমিউনিষ্ট পার্টি’ গঠন করে ক্ষান্ত হননি- সেখানে বসেই তথাকথিত ‘পূর্ব পাকিস্তান কমিটি’ গঠন করলেন যা কাজ করল ‘ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টি’র বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির নেতৃত্বে ও কতৃত্বাধীনে এবং তার পরপরই এঁরা তথাকথিত ‘পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিষ্ট পার্টি’ও গঠন করেছিলেন। শুধু তাই নয়, ঐ তথাকথিত ‘পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিষ্ট পার্টি’ ‘পাকিস্তানের কমিউনিষ্ট পার্টি’র সঙ্গে সরাসরি কাজ না করে, ‘ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টি’র ‘বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির নেতৃত্বে ও কতৃত্বাধীনে’ কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ঐ ‘সংকীর্ণতাবাদী কমিউনিষ্ট’ নেতৃত্ব।
ঘটনাগুলি বিশ্লেষণ করলে যা দাঁড়ায় তা হলঃ-
(১) ‘পাকিস্তানের কমিউনিষ্ট পার্টি’ গঠিত হল ভারতের কলিকাতার মাটিতে বসে- পাকিস্তানের মাটিতে নয়; (২) পাকিস্তানের পূর্ববঙ্গ প্রদেশের নামকরণ করা হল ‘পূর্ব পাকিস্তান’ ঐ ভারতের মাটিতে বসেই; (৩) ‘পাকিস্তানের কমিউনিষ্ট পার্টি’ গঠন করার পরে ভারতের মাটিতে বসেই লোক দেখানো যে ‘পূর্ব পাকিস্তান কমিটি’ গঠন করা হল তা আবার ‘পাকিস্তান কমিউনিষ্ট পার্টি’র সঙ্গে কাজ না করে কাজ করল ‘ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টি’র বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির অভ্যন্তরে এবং (৪) ‘পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিষ্ট পার্টি’ গঠিত হল ভারতের মাটিতে বসেই এবং তা কাজ করল ‘পাকিস্তানের কমিউনিষ্ট পার্টি’র নেতৃত্বে বা কর্তৃত্বাধীনে নয় - কাজ করল ‘ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টি’র বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির নেতৃত্বে ও কর্তৃত্বাধীনে। আর এঁদের এই পর্বের ‘কমিউনিষ্ট’ কার্যকলাপের মধ্যে শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবী অংশ তো দূরের কথা, শ্রমিক শ্রেণীরই কারো কোন স্থান ছিল না। এঁরা সকলেই ছিলেন মধ্যশ্রেণীর সেই ‘বাবু শ্রমিক’ বা ‘বাবু কৃষক’ অর্থাৎ ‘বাবু কমিউনিষ্ট’। সে সঙ্গে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে কোনরূপ কাজ করা বা পদক্ষেপ গ্রহণেও এঁরা ব্যর্থ হয়েছিলেন- যদিও এদের কাছ থেকে তা আশা করাটাই অপরাধ।
কি অদ্ভুত এদের ঐ ‘কমিউনিজম’ ! এরা কি একটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব কি জিনিস তাও বুঝতেন না ? এরা কি সমগ্র পাকিস্তানের শ্রমিক শ্রেণীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেননি ? এরা কি সমগ্র পাকিস্তানের শ্রমিক শ্রেণীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেননি ? এঁরা কি এটাই বুঝাতে চাননি যে বাঙ্গালী, পাঞ্জাবী, সিন্ধি, পাঠান, বেলুচি প্রভৃতি শ্রমিক শ্রেণী আলাদা আলাদাভাবে শোষিত হয় এবং শোষণের নীতি আর ধারাও যেন আলাদা ?
আর ঐ তথাকথিত ‘পার্টি’কেই ‘মাতৃপার্টি’ আর ‘পিতৃপার্টি’ বলে তার ধারক ও বাহকরা বিভিন্ন দল আর উপ-দলে বিভক্ত হয়ে তৎকালীন পাকিস্তানের পুরো পর্বটায় যেমন শ্রমিক শ্রেণীকে তাঁদের লেজড় বৃত্তি করেয়েছেন এবং শ্রমিক শ্রেণীর ত্রাণকর্তা বলে দাবীদার হয়ে শ্রমিক শ্রেণীর মঞ্চটাকে দখল করে রেখেছেন, ঠিক একইভাবে আজও পর্যন্ত তারাই বাংলাদেশের শ্রমিক শ্রেণীকে তাদের লেজুড় বৃত্তি করাচ্ছেন এবং শ্রমিক শ্রেণীর মঞ্চটাকে নিজেদের দখল রাখতে প্রয়াস পাচ্ছেন॥”
- এম. আর. চৌধুরী / ভারতবর্ষ-পাকিস্তান পর্বে ছিল না, বাংলাদেশেও কমিউনিস্ট পার্টি নাই ॥ [ ডলফিন এন্টারপ্রাইজ - নভেম্বর, ১৯৮৯ । পৃ: ১৮৪-১৯৩ ]
০৩.
“... পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল (পূর্ববাঙলা) ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনীতি, চাকুরী, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সকল ক্ষেত্রে বৈষম্যের যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে এবং সেই বৈষম্যের কারণে পূর্ববাঙলার জনগণের, পশ্চিমাদের ওপর বিক্ষুব্ধ হওযার যে কথা বলা হয়েছে তা যতই সত্য হোক, সেটি হ'ল ঘটনার এক দিক। এর বিপরীতে আরও যে অনেক সত্য ও বাস্তব ঘটনা আছে তা পাকিস্তানের প্রতি চরম বিদ্বেষের কারণে কখনও আমরা তাকিয়ে দেখার প্রয়োজন বোধ করি না। পাঠকদের এখন আমরা সেই বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করাতে চাই।
ইতিহাসের অপর পিঠ হ'ল : পশ্চিম পাকিস্তানীদের নির্মম শোষণ-লুন্ঠন এবং পূর্ব-পশ্চিমের অনেক বৈষম্যের পরও পূর্ববাঙলার আর্থ-সামাজিক অবস্থা ১৯৪৭ সালের আগেকার বৃটিশ শাসনামলে যেরকম ভয়াবহ রকমের পশ্চাৎপদ ছিল - সে তুলনায় সাতচল্লিশ-উত্তর তেইশ বছরে বহুগুণ উন্নত হয়েছিল।
আমরা জানি, ৪৭-এর পর মাত্র ২৩ বছরের মধ্যে বৃটিশ আমলের পান্ডবর্জিত, পশ্চাৎপদ, হতদরিদ্র পূর্ববাঙলায় গড়ে উঠেছিল এশিয়ার বৃহত্তম পাটকল আদমজী জুটমিল, উপমহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম টুলস ফ্যাক্টরি জয়দেবপুর মেশিন-টুলস ফ্যাক্টরী, চিটাগাং স্টীল মিল, প্রগতি ইন্ডাস্ট্রি, বাওয়ানী জুটমিল, করিম জুটমিল এবং পাকশী ও কর্ণফুলী পেপারমিল সহ বহু গুরুত্বপূর্ণ শিল্প কারখানা। ঢাকায় স্থাপিত হয়েছিল পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাজধানী (যেটি আজকের শেরেবাঙলা নগর এবং আমাদের গর্বের সংসদ ভবন)। এমনকি ১৯৬৪ সালের শেষের দিকে ঢাকায় ডিআইটি ভবনে যে টিলিভিশন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয় সেটি ছিল সমগ্র পাকিস্তানের প্রথম টেলিভিশন কেন্দ্র (তখনও পশ্চিম পাকিস্তানে কোন টেলিভিশন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি)।
যাদের বয়স আজ ষাটের কোঠায় তাদের নিশ্চয়ই স্মরণ আছে, তখন ঢাকাসহ সমগ্র পূর্ববাঙলার রাস্তাঘাটে চলাচল করতো চট্টগ্রামের প্রগতি ইন্ডাস্ট্রির বাস ও ট্রাক। এমনকি আজ শুনলে অলীক স্বপ্নের মতই মনে হবে - ১৯৭২-৭৩ সালেও প্রগতি ইন্ডাস্ট্রি চালু ছিল এবং সে সময় শোনা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীকে উপহার দেওয়ার জন্য প্রগতি ইন্ডাষ্ট্রিকে দিয়ে একটি প্রাইভেট কার তৈরীরও নাকি উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
আর সেই অপার সম্ভাবনাময় প্রগতি ইডাস্ট্রি আজ এক ধ্বংসস্তূপ, কেবলই এক বিস্মৃত ইতিহাস। আদমজী জুটমিল, চিটাগাং স্টিল ইন্ডাস্ট্রি, বাওয়ানী জুটমিল, মেশিন-টুলস ফ্যাক্টরি, পাকশী পেপার মিলসহ বড় বড় শিল্পকারখানাগুলো সব আজ ধ্বংস হয়ে গেছে।
অথচ পাকিস্তান আমলেই এইসব শিল্পকারখানায় লক্ষ লক্ষ বেকার, হতদরিদ্র বাঙালীরা চাকুরী করে আধুনিক শিল্পশ্রমিক হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। হাজার হাজার শিক্ষিত বেকার বাঙালীর কর্মসংস্থান হয়েছিল। সেসব শিল্পকারখানার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল অনেক ব্যবসাকেন্দ্র ও প্রতিষ্ঠান - সেখানেও বিপুলসংখ্যক বাঙালীর কর্মসংস্থান হয়েছিল। এর ফলে ওই ২৩ বছরেই পূর্ববাঙলায় বিকাশ ঘটেছিল এবং মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর।
পূর্ববাঙলার শিক্ষা, শিল্প, চিত্রকলা, সাহিত্য্, সঙ্গীত, গল্প, উপন্যাস, কবিতা আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হয়েছিল সেই আমলেই। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, এস. এম. সুলতান, কামরুল হাসান, কাইয়ুম চৌধুরী, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, আবু ইসহাক, শামসুর রহমান, আল-মাহমুদ, আব্বাসউদ্দিন, মুনির চৌধুরী, আলতাফ মাহমুদ সকলেই ওই আমলের। তাদের সকলেরই পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটেছে পাকিস্তান আমলের ২৩ বছরে। স্বাধীন বাংলাদেশের তেতাল্লিশ বছরে যার বিকাশ আরও বহুগুণ ও বহুমাত্রিক হওয়া উচিত ছিল - সেখানে তেতাল্লিশ বছরে একজন জয়নুল আবেদীন, এস. এম. সুলতান, কামরুল হাসান, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আলতাফ মাহমুদ, মুনীর চৌধুরী, শামসুর রহমান, আল মাহমুদ তৈরী হয়েছে কি? তৈরী হয়েছে কি লালসালু, আব্দুল্লাহ, সূর্যদীঘল বাড়ী, চিলেকোঠার সেপাইয়ের মত কোন কালজয়ী উপন্যাস?
আমরা জানি, পাকিস্তানী আমলের ২৩ বছর পূর্ববাঙলার মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবনযাপনের মান প্রতিবেশী ভারতের অনেক রাজ্যের চেয়ে ওপরে ছিল। টাকার মান ভারতীয় রুপীর তুলনায় অনেক বেশী ছিল। অথচ স্বাধীন হয়ার পর সেই বিপুল স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর অবস্থা আজ তেতাল্লিশ বছরে আপেক্ষিক মাত্র্রায় শুধু অসচ্ছল নয়, চরম দূর্দশাগ্রস্ত হয়েছে। কারণ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আয় বেড়েছে হয়তো পঞ্চাশ গুণ, কিন্তু ব্যয় বেড়েছে দেড়শ' গুণ। আজ ঢাকা শহরে যে দশ লক্ষ রিক্সা শ্রমিক রয়েছে তাদের প্রায় এক তৃতীয়াংশ পরিবার পাকিস্তান আমলে ছিল মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীভুক্ত।
ষাটের দশকে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে সবচেয়ে উত্তেজনাকর শ্লোগান দিয়ে আওয়ামী লীগ যে "সোনার বাংলা শ্মশান কেন" শিরোনামে পোস্টার প্রচার করেছিল, সেটি ছিল আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে এ অঞ্চলের জনগণকে উত্তেজিত করে তোলার জন্য রাজনৈতিক শ্লোগান। প্রকৃতপক্ষে অতীতের (ছোলতানী-নবাবী আমলের) "সোনার পূর্ববাঙলা" শ্মশানে পরিণত হয়েছিল বৃটিশ আমলের দু'শ' বছরে। বৃটিশ শাসনাধীন দু'শ বছরের সেই "শ্মশান পূর্ববাঙলা" পাকিস্তান আমলের মাত্র তেইশ বছরে সোনার বাঙলা না হোক, অন্তত শ্মশান থেকে উঠে এসে সোনার বাঙলা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছিল। শেখ মুজিব যে 'ছয় দফা'র মাধ্যমে পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্য থেকেই পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত পূর্বপাকিস্তান (পূর্ববাঙলা) চেয়েছিলেন এবং সেই বাঙলাকেই 'সোনার বাঙলা' বানাতে চেয়েছিলেন, তার মনস্তাত্ত্বিক মর্মার্থ বুঝতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
সাতচল্লিশ -পূর্বকালের সেই পান্ডববর্জিত ভূখন্ডের ম্লেচ্ছ-যবনরা' সাত্চল্লিশের পর কীভাবে ঊষার আলোর মত জেগে উঠেছিল তার একটি ক্ষুদ্র চিত্র ফুটে উঠেছে হাল আমলের বাংলাদেশের বিদগ্ধ লেখক ও প্রাবন্ধিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের একটি বক্তব্যের মধ্যে। অতি সম্প্রতি জনাব মনজুরুল ইসলাম দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত তার এক নিবন্ধে সাতচল্লিশ-উত্তর পূর্ববাঙলা (পূর্ব পাকিস্তান) সম্পর্কে বলেছেন :
“... কী এক রসায়নে এর শিল্প-সাহিত্যে শুরু হল জোয়ার। এক দশকেই-পঞ্চাশের দশকে আধুনিকতার বড় বড় সব ঢেউ আমাদের চিত্রকলা, গল্প, উপন্যাসে-শিল্প-সাহিত্য সংস্কৃতির সৈকতে আছড়ে পড়ল, যেন নতুন শক্তি নিয়ে জাগল। ... ষাটের দশকে এসে বুঝলাম, আমরা বিশ্বের সঙ্গে আছি, গন্ডগ্রামে পড়ে থাকার মানুষ নই আমরা। আমরা এখন একটি স্বতন্ত্র পরিচয়ের জাতি।”
কেউ আমরা স্বীকার করি না করি - সৈয়দ মনজুরুলের ভাষায় যে "রসায়ন" আমাদের শিল্প-সাহিত্যে জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল, সেই "রসায়নে"র নাম "সাতচল্লিশ"।
পাঠক যেন ভুল না বুঝেন - অতীতের এসব ইতিহাস বয়ানের উদ্দেশ্য বাংলাদেশকে পুনরায় পাকিস্তানে ফিরিয়ে নেওয়া নয়। তার কোন অবকাশও নেই, প্রয়োজনও নেই। তবে নতুন প্রজন্মকে এসব ইতিহাস অবশ্যই পাঠ করতে হবে। প্রজন্মকে ইতিহাস পাঠ করাতে হবে তাদেরকে "পাকিস্তানপ্রেমী" বানানোর জন্য নয়, বরং তাদেরকে ইতিহাস সচেতন করে তুলতে হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে সুসংহত করে তোলার জন্যই॥”
- রইসউদ্দিন আরিফ (সাবেক সম্পাদক, পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি) / অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধ : বাঙালী ও বাংলাদেশ ॥ [ পাঠক সমাবেশ - ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ । পৃ: ১২৬-১২৯ ]
০৪.
“... মুসলিম লীগ, যুক্তফ্রন্ট ও আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-মেম্বার, নেতা-উপনেতা দেশসেবার বদৌলতে ঢাকায় স্ব-স্ব বাড়ী-ঘর নির্মাণে অপূর্ব দক্ষতার পরিচয় দেন। ধানমন্ডি এলাকায় আওয়ামী লীগ সদস্যদের নির্মিত ঘরবাড়ীসমূহ 'আওয়ামী লীগ কলোনি' আখ্যা পায়। ইহা আওয়ামী লীগ সরকারের অকৃত্রিম জনসেবার অতুলনীয় স্বাক্ষর বটে।
রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নির্লজ্জ আচরণ সেক্রেটারিয়েটের মহাজন আমলাদিগকে তাহাদের অবাঞ্ছিত পদাংক অনুসরণ করিতে উৎসাহিত করে এবং আমলাগোষ্ঠী সংখ্যাধিক্য বিধায় লুটপাটের সিংহভাগ তাহারাই পায়। পাকিস্তান সুপিরিয়র সার্ভিসভুক্ত সিভিল সার্ভিস, পুলিশ সার্ভিস, ফাইনান্স সার্ভিস ইত্যাদির অন্তর্গত কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারীদের শতকরা ৯৫ জন ছিলেন দরিদ্র ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। তাহারা চাকুরীর প্রথম জীবনে ছিলেন ৩ শত হইতে ৫ শত টাকার বেতনভুক্ত কর্মচারী। অথচ প্রশাসনিক ক্ষমতার অপপ্রয়োগ ও অপব্যবহার দ্বারা স্বীয় জীবন ভোগের উদগ্র বাসনায় চরম অসদুপায় অবলম্বনে তাহারা কোন সময়ই কুন্ঠিত হন নাই এবং বিপুল অর্থোপার্জনের মাধ্যমে এই দেশে তাহারাই 'রামরাজত্ব' কায়েম করিয়াছিলেন।
৩, ৪ অথবা ৫ বৎসরের চাকুরী জীবনে রাজধানী ঢাকা অথবা বন্দর শহর চট্টগ্রাম বা খুলনার বুকে সুরম্য অট্টালিকা নির্মাণ বা ক্রয়, শহরে, গ্রামে-গঞ্জে জোতজমি ক্রয়, স্বীয় ব্যবহারের জন্য গাড়ী ক্রয়, ঠাঁট বজায় রাখিবার অতিরিক্ত জিনিসপত্র যথা: রেফ্রিজারেটর, দামী কার্পেট, ডাইনিং হলসেট, সহধর্মীনীর শাড়ী-গহনা ক্রয়, দেশে-বিদেশে স্বনামে-বেনামে ব্যাংক ব্যালেন্সের মোহ তাহাদের পাইয়া বসিয়াছিল। ৩ শত, ৫ শত এমন কি হাজার দুই হাজার টাকা বেতনভোগী সরকারী কর্মচারীদের জীবনে এইসব ছিল রূপকথার কাহিনীর ন্যায়। পিতৃ সম্পত্তির উত্তরাধিকারী নগন্যসংখ্যক সরকারী কর্মচারী ব্যতীত অধিকাংশের বেলায়ই ইহা ছিল অকাট্য সত্য। জীবন ও যৌবন ভোগের উন্মত্ত নেশায় তাহাদের সচেতন অপরাধ প্রবণতা জাতিকে দুর্নীতির অতল গহ্বরে নিমজ্জিত করে।
এতদবর্ণিত জাতিদ্রোহী, সমাজদ্রোহী, নীতিদ্রোহী জীবশ্রেণীর বিরুদ্ধে যাহারা কন্ঠকে সোচ্চার রাখিয়াছিলেন, তাহাদিগকে প্রশাসনিক ক্ষমতার দাপটের শিকার হইতে হইত ও পুন: পুন: কারাবরণ ছিল তাহাদের জন্য অবধারিত। মাওলানা ভাসানীর বিশাল ব্যক্তিত্বকেও বার বার কারা নির্যাতন ভোগ করিতে হইয়াছে। খোলাফায়ে রাশেদীন ইসলামী জীবনবোধ ও মূল্যবোধ বাস্তবায়নের স্বর্ণযুগ ছিল। মাওলানা ভাসানী সেই যুগের একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। পক্ষান্তরে পাকিস্তানী শাসনদন্ডের নায়কবৃন্দ যথা - নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খান, গোলাম মোহাম্মদ, ইস্কান্দার মীর্জা, শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রমুখ ইসলামী জীবনদর্শন নির্দেশিত জীবনবোধ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের বিরুদ্ধে ছিলেন পর্বতপ্রমাণ বাধা। তাহাদের বক্তৃতা-ভাষনে একদিকে ইসলামী জীবনাদর্শনের গভীর তাৎপর্য ও ব্যবহারিক জীবনে উহার রূপায়নের খই ফুটিত এবং অন্যদিকে তাহারাই আবার মাওলানাকে 'লুঙ্গীসর্বস্ব' 'ইসলামের শত্রু' 'পাকিস্তানের শত্রু' 'ভারতের চর' ইত্যাদি হীন আখ্যায়িত করিতে সামান্যতম ক্লেশ বোধ করেন নাই।
জাতীয় চরিত্রের অবক্ষয়কালে জনগণ আদর্শচ্যুত ও লক্ষ্যভ্রষ্ট হইয়া আত্মশক্তি হারাইয়া ফেলে ও বহি:শক্তির নিকট অবচেতন অবস্থায় আত্মসমর্পন করে। আত্মিক শক্তির পরাভব ও অবলুপ্তির এই সন্ধিক্ষণেই ইস্কান্দার মীর্জা আইউব খানের অভ্যুত্থানকে স্বাগত জানান এবং এইভাবেই জনগনের সার্বভৌমত্বের অস্বীকৃতির উপর জেনারেল আইউব খানের একনায়কত্বের ভিত রচিত হয়॥”
- অলি আহাদ / জাতীয় রাজনীতি : ১৯৪৫ থেকে '৭৫ ॥ [ বিসিবিএস - অক্টোবর, ২০১২ (পঞ্চম সংস্করণ) । পৃ: ২৪৩-২৪৪ ]
০৫.
“... কপালের লিখন। মাত্র কয়েক মাস আগে প্রধানমন্ত্রী বগুড়ার মোহাম্মদ আলী ফজলুল হককে আখ্যায়িত করেছিলেন পাকিস্তানের দুশমন ও রাষ্ট্রদ্রোহী এবং রুশ-ভারতের দালালরূপে। আজ তার উপরেই ভরসা। আর আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দকে ভারতীয় দালাল ও কম্যুনিস্ট প্রভৃতি বিশেষণে বিভূষিত করা সত্ত্বেও গোলাম মোহাম্মদ গোষ্ঠী শেষ রক্ষার জন্যে নির্ভর করতে লাগলেন আওয়ামী লীগের সেই সব তথাকথিত রাষ্ট্রদ্রোহী নেতৃবৃন্দের উপর।
পূর্ব বাংলার ঐক্য হল দ্বিখন্ডিত। ক্ষমতার গন্ধ পেয়ে যুক্তফ্রন্টের ফজলুল হকের দাবি জনসাধারণের প্রতি প্রদত্ত একুশ দফার সমস্ত প্রতিশ্রুতি ভুলে গিয়ে ভিড়ে গেলেন মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে। এদিকে যুক্তফ্রন্টের অপর দল আওয়ামী লীগ ভিড়লেন গোলাম মোহাম্মদের তরীতে। পূর্ব বাংলার এই অনৈক্যের মধ্যখানে পড়ে রইলেন শত শত দেশপ্রেমিক কারাপ্রাচীরের অন্তরালে। নেতৃত্ববিহীন জনতা পড়ে থাকলেন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের গর্ভে যে অনিশ্চয়তায় তারা ইতিমধ্যেই কাটিয়েছেন গত সাতটি বছর।
অবস্থা চরমে উঠল গোলাম মোহাম্মদের পূর্ব বাংলা সফর নিয়ে।
যুক্তফ্রন্টের দুই দলে তীব্র প্রতিযোগিতা গোলাম মোহাম্মদের গলায় কে আগে মালা পরাবেন। গলা গোলাম মোহাম্মদের একটি কিন্তু মালা দুটি। গোলাপ-রজনীগন্ধার একটি মালা শোভা পাচ্ছে শেরে বাংলা ফজলুল হকের হাতে, আর আতাউর রহমানের হাতে রয়েছে বেল-করবী-বকুলের মালা।
দুই রাধা এক কৃষ্ণ।
কৃষ্ণ পড়লেন মুশকিলে, কারে থুই কারে রাখি।
অবশেষে উপায়ন্তর না দেখে তিনি বললেন : দুই রাধা এক হও। দুই মালা এক কর। চার হাতের দুই মালা এক করে পরাও এক গলায়। পরিস্থিতিটি ন্যাক্কারজনক। পূর্ব বাংলার মাথা হেঁট হল বিশ্বের চোখে। বুদ্ধিবৃত্তিতে দেউলিয়াগ্রস্থ পূর্ব বাংলার নেতৃবৃন্দ আরেকবার প্রমাণ করলেন যে, মন্ত্রিত্বের হালুয়ার জন্যে তারা করতে পারেন না এমন কিছুই যেন নেই। দেশবাসীর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতাতেও আপত্তি নেই তাদের।
এমনি করে করাচির চক্রান্তজালে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক মৎস্যরা ধরা দিল। চার ছড়ান হয়েছিল মন্ত্রিত্বের। প্রধানমন্ত্রী বগুড়ার মোহাম্মদ আলী বললেন ফজলুল হকের দলকে : যুক্তফ্রন্ট থেকে আওয়ামী লীগকে ভাগিয়ে দাও, তোমাদের হাতে পূর্ব বাংলার মসনদ তুলে দিচ্ছি। তোমরা খাঁটি মুসলমান, তোমাদের সঙ্গে আমাদের মুসলিম লীগের মুসলমানদের কোন ঝগড়া নেই। কিন্তু য্তসব গোলমালের মূলে কম্যুনিস্ট ও হিন্দুস্তানের দালাল ঐ আওয়ামী লীগের মুসলমানেরা।
এদিকে গোলাম মোহাম্মদ আওয়ামী লীগের নেতা আতাউর রহমানকে ডেকে চুপি চুপি বললেন : মিয়ারা, তোমরা-আমরা তো এক এবং অভিন্ন। পাকিস্তানে আমরাই তো নির্ভেজাল মুসলমান। যতসব গন্ডগোল ঐ ফজলুল হককে নিয়ে। তিনিতো হিন্দুস্তানের পাকা দালাল এবং একজন ঘোর কম্যুনিস্ট। তাকে বাদ দিয়ে এস পূর্ব বাংলার মসনদ তুলে দিচ্ছি তোমাদের হাতে। আমাদের আমেরিকার বন্ধুদেরও মনে হয় তাই ইচ্ছে।
করাচির রাজনীতির ডাক্তারগণ পূর্ব বাংলার তথাকথিত নেতাদের রোগটি ঠিকই ধরে ফেললেন। এখানকার যারা সাচ্চা দেশপ্রেমিক, তাদের তারা ভাল করেই চেনেন এবং তাদের পক্ষে পূর্ব বাংলায় ক্ষমতাসীন হবার সম্ভাবনা আপাতত: নেই। তাদের বাদ দিয়ে আর যারা দেশপ্রেমিকের দাবিদার তাদের অধিকাংশই মেকী। পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে তারা নাবালক। চাকরি বা মন্ত্রিত্বের মোয়া দিয়েই ভুলান যায়। কাজেই অষুধ তাদের লেগে গেল। ক্ষমতার গন্ধে দিশেহারা নেতৃবৃন্দের একদল ছুটলেন বগুড়ার মোহাম্মদ আলীর পিছু পিছু। অপরদল গোলাম মোহাম্মদের॥”
- খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস / ভাসানী যখন ইউরোপে (রচনাসংগ্রহ) ॥ [ বাংলা একাডেমী - জুন, ২০১৩ । পৃ: ১৭৯-১৮০ ]
০৬.
“… গভর্ণর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ পূর্ব পাকিস্তান সফরে আগমন করিলেন। প্রসঙ্গত: উল্লেখযোগ্য যে, গণপরিষদ বিলুপ্তিকালে তিনি ওয়াদা করিয়াছিলেন যে, যথাশীগগির পূর্ব পাকিস্তানের মন্ত্রিসভা পুন:প্রতিষ্ঠিত করিবেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুন:প্রবর্তনের আশায় যুক্তফ্রন্ট পার্টিও তাই গভর্ণর জেনারেলকে অভ্যর্থনা জানাইবার মনস্থ করিল যদিও ইহা অনেকের কাছে বিসদৃশ্য ঠেকিয়াছিল। এই ব্যাপারে যুক্তফ্রন্ট অফিসে সভা আহুত হইল। কিন্তু সামান্য একটা ব্যাপারে কথা কাটাকাটির পর সভায় শেষ পর্যন্ত নিজেদের মধ্যে হাতাহাতি হইয়া গেল। যুক্তফ্রন্টের তরফ হইতে আর অভ্যর্থনা কমিটি গঠিত হইল না। আওয়ামী লীগ ও কৃষক-শ্রমিক পার্টি তখন পৃথক অভ্যর্থনার আয়োজন করিল। বিমানবন্দরে এক কলঙ্কময় দৃশ্যের অবতারনা হইল॥”
- তফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া) / পাকিস্তানী রাজনীতির বিশ বছর ॥ [ বাংলাদেশ বুকস ইন্টারন্যাশনাল - ফেব্রুয়ারী, ১৯৮৪ । পৃ: ৬৩ ]
০৭.
“... ১৯৪৮ সাল থেকে সব কমিউনিস্ট কর্মীদের মুসলিম লীগ সরকার গ্রেপ্তার করতে শুরু করে। মুসলিম লীগ প্রশাসন জানত এই কমিউনিস্টরাই হচ্ছে পাকিস্তানের প্রধান শত্রু। কারণ তখন পর্যন্ত (আজাদীর বছর না ঘুরতেই) পাকিস্তান সম্পর্কে মোহমুক্তিটা মুসলিম কর্মীদের মধ্যে শুরু হয়নি। সেটা আওয়ামী লীগের কথাই বলি বা মুসলিম লীগের কথাই বলি।
... তোমরা তো জানো না যে কাজী মোতাহার হোসেন, নাসিরুদ্দীন সাহেব, নুরজাহান বেগম বা রোকনুজ্জামানের মত লোকেরা সাহিত্য সংসদে বিভিন্নভাবে জড়িত থাকলেও এরা মূলত ছিলেন কমিউনিস্টদের লোক। ... মুসলমান শিক্ষকদের মধ্যে কমিউনিস্টদের সাথে ঘনিষ্ঠ ছিলো এমন আরেকটা নাম শহীদুল্লাহ সাহেব অর্থাৎ ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ্।
... আমাদের পলিসি ছিলো কাউকে hostile না করে বিভিন্ন কেন্দ্রগুলো দখল করে নেয়া। যেমন ধরো, মুসলিম লীগের নেতা আবুল হাশিম - বন্ধু, মান্যবর। আমাকে ভীষণ ভালোবাসেন। তাকেও আমরা ডিল করেছি কম্যুনিস্টের জায়গা থেকে। পার্টি আমাদেরকে হুকুম করেছে, তোমরা হাশিম সাহেবের কাছে কাছে থাকবা। যা সাহায্য লাগে করবা। এই রকম হুকুমই করা ছিলো। হুকুমের চোটে আবার ধরো দুই একজন নষ্টও হয়ে গেছে। যেমন ধরো শামসুদ্দীন। আবুল হাশিম সাহেবকে সামলানোর জন্য তাকেও পাঠানো হয়েছিলো। সে এমনি সামলায় যে নিজেই পাকিস্তানপন্থী হয়ে যায়। পরে পাকিস্তানেই চলে যায়। সেখানেই মারা যায়।
... এই যে পাকিস্তানিজমের চিন্তাটা, এটা যেহেতু মূল স্রোত একে hostile করে কি হবে? এটা হলো এক ধরণের চিন্তার কাঠামো। এখন এই চিন্তার যে ভ্রান্তি তাকে তো জোর করে কথার মাধ্যমে শেষ করে ফেলা যাবে না। আমাকে তার কাছে যেতে হবে, তাকে ম্যানেজ করে ফেলতে হবে।
... যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে বিজয়ীদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ছিলো কম্যুনিস্ট অথবা কম্যুনিস্ট মাইন্ডেড। যদিও মুসলমান পরিবার থেকে আসা কম্যুনিস্টরা নিজেদের কম্যুনিস্ট হিসেবে উল্লেখ করতো না। সমস্যা ছিলো কম্যুনিস্টদের প্রধান সংযোগ ছিলো আওয়ামী লীগের সাথে। ঐ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের প্রধান ভিত্তি ছিলো কম্যুনিস্ট কর্মীরা। কেন যেন ১৯৫৪ পরবর্তী প্রজন্মের যে সব লোক কম্যুনিজম করে তারা এ কথাটা বলার উৎসাহ রাখে না। যদিও তৎকালে কম্যুনিস্টরা আওয়ামী লীগকে জয়ী করার জন্য শ্রম-মেধা ব্যয় করেছে তবুও অন্তত ত্রিশজন গোপন কম্যুনিস্টকে তুমি পাবে যারা নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন। এরা কম্যুনিস্ট পরিচয় গোপন রাখতেন কিন্তু শেখ মুজিব এদেরকে জানতেন।
... মনে রাখতে হবে, আমরা যে স্বপ্ন দেখতাম সে স্বপ্নের মধ্যে এন্টি-হিউম্যান অর্থে এন্টি-পাকিস্তানী হওয়ার ব্যাপার ছিলো না। Pakistan was also a land of people. আমরা সেজন্য পাকিস্তান কম্যুনিস্ট পার্টি তৈরি করেছি। আমরা পাকিস্তানে গণতন্ত্র চেয়েছি এবং পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রক্রিয়াটার মধ্যে ডেমোক্রেটিক ইলিমেন্টগুলোকে যুক্ত করতে চেয়েছি। এসব নিয়ে অনেক কথা আছে। যেমন ধরো, মুজিব মণি সিংহকে বলছে - 'দাদা, এবার লাগাইয়া দেই'? মণি সিংহ বলছেন - 'একটু ধৈর্য ধর। অস্থির হয়ো না'। আসলে কম্যুনিস্টরা লং টার্মে চিন্তা করে। তারা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার টার্মে চিন্তা করেনি। সেসব যাই হোক - আমি একটা সময়ে এসে এটাই ভাবছিলাম যে, যা হওয়া উচিত তাই হচ্ছে। পিপল মুভ করছে। দেশ গণঅভ্যুত্থানের পর্যায়ে যাচ্ছে। আসাদকে হত্যার ঘটনা যেদিন ঘটে সেদিন আমি সাংঘাতিকভাবে আলোড়িত হয়েছিলাম॥”
- সরদার ফজলুল করিম / আমি সরদার বলছি ॥ [ অন্বেষা - ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ । পৃ: ৭১ / ২৫২ / ২৫৫ / ২৫৮ / ২৮১ / ২৮৮-২৮৯ ]
০৮.
“… ষাটের দশকে নৌকা কিংবা হাঁটাপথ যোগাযোগের একমাত্র উপায় ছিল, যে জন্য কৃষিজাত পণ্যের ভালো বাজার ধরা কঠিন ছিল। প্রতিমাসে থানা কাউন্সিলের সভা করার জন্য আমাকে অন্তত একবার প্রতি থানায় যেতে হতো। আমার মনে আছে, মোল্লাহাটে চার আনায় এক হালি ডিম পাওয়া যেত।
এতসব সীমাবদ্ধতার মধ্যেও দেশে মোটামুটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় ছিল এবং বর্তমান সময়ের তুলনায় খুন-রাহাজানিসহ মারাত্মক ধরণের অপরাধ সরকারের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ছিল। রাজনৈতিক সন্ত্রাস তো দূরের কথা, দুর্বৃত্তদের মধ্যেও বর্তমান স্টাইলের সন্ত্রাস আমাদের কাছে অজানা ছিল। দেশে দারিদ্র্য অসহনীয় পর্যায়ে ছিল - শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ মহকুমা আর থানা সদরের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এত কষ্টের মধ্যেও মানুষের মনে তাদের নিরাপত্তা নিয়ে উৎকন্ঠা ছিল না; ছিল না মাঠেঘাটে সর্বত্র পাল্লা দিয়ে দুর্বৃত্তায়ন আর অপশাসনের ঊর্ধ্বগতি॥”
- এ টি এম শামসুল হুদা (সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার) / ফিরে দেখা জীবন ॥ [ প্রথমা প্রকাশন - ফেব্রুয়ারী, ২০১৪ । পৃ: ১১৬ ]
ক্রমশ ...
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন