জন্য দফ ও ঢোল বাজিয়ে রোজাদারদের ঘুম ভাঙাতে ডাকা হচ্ছে। বাংলাদেশে এই দৃশ্যের সঙ্গে মানুষ অল্প পরিচিত। পক্ষান্তরে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম প্রধান দেশগুলো এবং এর পাশাপাশি পাকিস্তান ও ভারতের মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে দফ বাজানোর সংস্কৃতি বেশ সাড়াজাগানো।
রমজান এলেই বিশ্বের বিভিন্ন শহরে দফ বাজানোর ঐতিহ্যবাহী নানা দৃশ্য নিয়ে খবর ছাপে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো। রোজার শুরুতেই তুর্কি সংবাদমাধ্যম ডেইলি সাবাহ জানালো, এ বছর রমজানজুড়ে শুধু ইস্তাম্বুলেই অন্তত ৩ হাজার ৪০০টি ঢোল বাজিয়ে রোজাদারদের সেহরিতে ডাকা হবে। আসলে এটি এত প্রচলিত ও গুরুত্বপূর্ণ কীভাবে হলো—এই লেখায় সেটিই জানার চেষ্টা করবো।
ব্যাংক অথবা কার্ড থেকে অ্যাড মানি
একজন গ্রাহক নগদ ইসলামিক অ্যাপ ব্যবহার করে বিভিন্ন ব্যাংক অথবা কার্ড থেকে টাকা আনতে পারবেন খুব সহজেই। নগদ ইসলামিক অ্যাপে অ্যাড মানি ফিচার ব্যবহার করে বিভিন্ন ইসলামি ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানসহ আরো অন্যান্য ব্যাংক, মাস্টারকার্ড এবং ভিসা কার্ড থেকে টাকা আনা যায় মুহূর্তেই। ফলে সেন্ড মানি, মোবাইল রিচার্জ, ইউটিলিটি বিল প্রদান, কেনাকাটার পেমেন্ট করা যায় যেকোনো সময়, যেকোনো জায়গা থেকে। এ ছাড়াও ডোনেশন ফিচার ব্যবহার করে নগদ ইসলামিক-এর মাধ্যমে খুব সহজেই পৌঁছে দিন আপনার যাকাত ও ডোনেশন অসহায় মানুষদের কাছে।
সেহরিতে দফ বা ঢোল বাজানো আসলে কী?
সেহরিতে দফ-ঢোল বাজানো হলো—সেহরি খাওয়ার জন্য রোজাদারদের ডাকার একটি বিশেষ পদ্ধতি, আরবরা যেটিকে ‘মেসাহারাতি’ বলে থাকে। আর যে এ কাজটি করেন, তাকে তারা বলে ‘মুসাহহির’। মুসাহহিরকে ‘মুসাহহারাতি’ও বলা হয়ে থাকে। আসলে এসব শব্দ এসেছে আরবি মূল ধাতু ‘আস-সাহুর’ থেকে। বাংলায় যার অর্থ—সেহরির সময় খাওয়া বা সেহরি খাওয়া।
মেসাহারাতি আরব মুসলমানদের প্রাচীন একটি সংস্কৃতি। যখন বর্তমান সময়ের মতো ডাকাডাকির আধুনিক মাধ্যম সহজলভ্য ছিল না, তখন রমজান মাসে আরবের মুসলমানদের কাছে এটির ছিল বেশ কদর। ঢোল, দফ, বাঁশি, তুরি ও এ জাতীয় অন্যান্য বস্তুর মাধ্যমে মানুষকে ঘুম থেকে জাগানোর চেষ্টা করা হতো। কারণ এগুলোর শব্দ পৌঁছে যায় অনেক দূর পর্যন্ত।
শুধু দফ-ঢোল বাজানোকেই যে মেসাহারাতি বলে তা কিন্তু নয়; বরং সেহরির সময় মুসাহহিরদের গাওয়া নাশিদ, ধর্মীয় সঙ্গীত, দোয়া ও স্থানভেদে নানা বাক্যও এর অন্তর্ভুক্ত। আরব বিশ্বে মেসাহারাতি রমজানের পরিবেশকে আরও মনোমুগ্ধকর করে তোলে এবং সৃষ্টি করে ভিন্নরকম এক আধ্যাত্মিকতা।
কোথা কে এলো?
সেহরির সময় রোজাদারদের ঘুম থেকে জাগানোর জন্য ডাকাডাকির প্রচলন রাসুল (সা.)-এর যুগ থেকেই শুরু হয়েছে। তখন ফজরের আজান হতো দু’বার—হজরত বেলাল (রা.) ফজরের সময় হওয়ার আগেই একবার আজান দিতেন। উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে এটা জানানো যে—সেহরির সময় শেষ হচ্ছে। এরপর আজান দিতেন হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাকতুম (রা.)। এটি ছিল ফজরের আজান। এর মাধ্যমে বোঝানো হতো—সেহরির সময় শেষ হলো, আর খাওয়া-দাওয়া চলবে না, এখন নামাজ পড়তে হবে।
এরপর ইসলামি রাষ্ট্র বিস্তৃত হতে লাগলো এবং এর সঙ্গে সেহরিতে ডাকার যে পদ্ধতি তাতেও আসতে থাকলো ভিন্নতা। সেহরিতে ডাকা পুণ্যের কাজ—এই ভাবনার ওপর ভিত্তি করে তখনকার মুসলিমরা নানা উপায়ে রেওয়াজটি জারি রাখলেন।
এরই মধ্যে শুরু হলো আব্বাসি শাসনামল। খেলাফতের মসনদে তখন আলমুনতাসির মোহাম্মদ বিন খালিফা মুতাওয়াক্কিল আলাল্লাহ জাফর। তিনি আনবাসাহ বিন ইসহাককে মিসর এলাকার গভর্নর নিযুক্ত করলেন। আনবাসাহ দেখলেন—এ অঞ্চলের মুসলিমদের মধ্যে সেহরিতে ডাকার সুন্নাত আমলটিতে তেমন আগ্রহ নেই, কেউ গুরুত্বপূর্ণ এ দায়িত্ব পালন করছে না। এজন্য সিদ্ধান্ত নিলেন—তিনি নিজেই সেখানকার মানুষকে সেহরিতে ঘুম থেকে জাগাবেন। ফলে বেরিয়ে পড়লেন, তিনি আসকার নগরী থেকে শুরু করে ফুসতাতের আমর ইবনুল আ’স (রা.) মসজিদ পর্যন্ত রাস্তায় ঘুরে ঘুরে এই বলে মানুষকে ডাকতেন—‘আল্লাহর বান্দারা, সেহরি খাও। কেননা, সেহরি বরকতপূর্ণ।’ এভাবে উচ্চ শব্দে ঘুরে ঘুরে নানা নাশিদও গাইতেন তিনি। এজন্য আনবাসাহকে ইতিহাসের সর্বপ্রথম আনুষ্ঠানিক মুসাহহির আখ্যায়িত করা হয়।
আব্বাসি শাসনামলেই সেহরিতে ডাকাডাকির জন্য কাঠের টুকরো কিংবা চামড়ার দণ্ড দিয়ে ড্রাম বাজানোর প্রচলন শুরু হয়। এ সময় বাদকদের সঙ্গে উৎসবের আমেজে অংশ নিত শিশুরাও। তাদের হাতে থাকতো বাহারি মোমবাতি, যার মাধ্যমে রাস্তা আলোকিত করা হতো। ফাতেমি যুগে মেসাহারাতি আরও ব্যাপকতা লাভ করে। শাসক হাকেম বি-আমরিল্লাহ তার সৈন্যদের আদেশ দেন প্রজাদের বাড়ির দরজায় কড়া নাড়তে। যাতে বাড়ির লোকেরা সেহরিতে উঠতে পারে। তিনিই সর্বপ্রথম তার শাসনাধীন প্রতিটি এলাকায় রমজানে মুসাহহির নিযুক্ত করেন। যাদের কাজ—রাস্তায় ঘুরে ঘুরে মানুষদের এই বলে ডাকা—‘হে ঘুমন্ত, জাগ্রত হও, চিরঞ্জীব সত্তার জন্য ঐক্যবদ্ধ হও।’
মামলুক যুগে বিন নুকতাহর হাত ধরে মেসাহারাতি আরও বিকশিত হয়। তাকে বলা হতো ‘শায়খে মেসাহারাতি’। মানে মেসাহারাতি বিশেষজ্ঞ। তিনি সুলতান আল-নাসের মোহাম্মদের বিশেষ মুসাহহির হিসেবে দায়িত্ব পান। এরপর থেকে এই সংস্কৃতি আর পেছনে ফিরে তাকায়নি; সমগ্র আরবে এটি ছড়িয়ে পড়ে এবং ড্রামের বদলে তবলা বাজানো শুরু হয়।
তুলুনি রাজবংশের শাসনামলে নারীরাও মেসাহারাতিতে অংশ নেন। তাদের পদ্ধতি ছিল একটু ভিন্ন। তারা রাস্তায় বের হতেন না, বাড়ির মাশরাবিয়্যাতে (ভবনের বাইরের বারান্দা) বসে ইসলামী সঙ্গীত গাইতেন, যাতে পাড়ার লোকজন সেহরির জন্য ঘুম থেকে জাগতে পারে।
এজন্য বর্তমানে প্রচলিত মেসাহারাতির উদ্ভাবক বলা হয় মিসরকে। সেখানে তবলা ও দফ বাজিয়ে মানুষকে ডাকা হতো। কিন্তু পরে যখন এটি সমগ্র আরববিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে, তখন নানা জায়গায় নানান রকম বস্তু বাজিয়ে ডাকাডাকি করা হতো। যেমন—ইয়ামেনে এটি করা হতো বাঁশের তৈরি বিশেষ লাঠি দিয়ে দরজায় আঘাত করে, মরক্কোতে বাঁশি বাজিয়ে এবং প্রাচীন সিরিয়াতে সুগন্ধি জ্বালিয়ে, দফ বাজিয়ে ও নাশিদ গেয়ে। উনিশ শতকে এসে মিসর, সুদান ইত্যাদি অঞ্চলে মেসাহারাতি ও রমজানের বিশেষ অনুষঙ্গ হিসেবে যুক্ত হয়েছে বাহারি ফানুস। এছাড়া, সেহরিতে ডাকাডাকির জন্য বিশ্বব্যাপী আরও বেশকিছু পদ্ধতি চালু আছে।
আরববিশ্বে রমজানের আরেকটি বড় সংস্কৃতি হচ্ছে কামান দাগানো। এটি যেমন সেহরিতে ডাকার জন্য ব্যবহৃত হয়, তেমনি ইফতারির আগ মুহূর্তেও এটি করা হয়।
ইসলামি শরিয়তে সেহরিতে ঢোল বাজানোর অনুমোদন কতটুকু?
এক ব্যক্তি দারুল উলুম দেওবন্দের ফতোয়া বিভাগে রমজান মাসে সেহরিতে ডাকার জন্য ঢোল বাজানোর বিষয়ে জিজ্ঞেস করেন। এর প্রতিউত্তরে দেওবন্দ জানায়, রোজাদারদের ঘুম ভাঙানোর জন্য সেহরিতে ঢোল বাজানোর অবকাশ আছে। তবে শর্ত হলো—এত জোরে বাজানো যাবে না, যার কারণে মানুষ বিরক্ত হয়। অনেক এলাকায় যারা সেহরিতে সারামাস ঢোল বাজান, তারা এলাকাবাসীর কাছ থেকে মাস শেষে ‘বখশিশ’ স্বরূপ অর্থ দাবি করেন। এটি যদি এলাকাবাসী স্বেচ্ছায় দেন, তাহলে তো সমস্যা নেই, তবে যদি বাদকরা এজন্য জোরজবরদস্তি করে থাকেন, তাহলে তা জায়েজ নেই।
তথ্যসূত্র: আলইয়াউমুস সাবি, আলমিজান, উইকিপিডিয়া আরবি, দারুল উলুম দেওবন্দের ওয়েবসাইট, ফতোয়ায়ে শামি ও অন্যান্য
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী; শিক্ষক, মারকাযুদ দিরাসাহ আল ইসলামিয়্যাহ, ঢাকা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন