বন্দিদের সব ধরনের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করে ইসলাম। কারাগারেও অন্ন, বস্ত্র, আবাসন, চিকিৎসা, শিক্ষা ও বৈধ বিনোদনের সুযোগ নিশ্চিত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে ফিকহ গ্রন্থগুলোতে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ ও আত্মীয়-স্বজনকে দানের নির্দেশ দেন এবং তিনি নিষেধ করেন অশ্লীলতা, অসৎ কাজ ও সীমালঙ্ঘন; তিনি তোমাদের উপদেশ দেন যেন তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করো।’ (সুরা নাহল, আয়াত : ৯০)
সাহাবি আবু আজিজ বিন উমাইর (রা.) বলেন, আমি বদর যুদ্ধে (কাফির হিসেবে মুসলমানদের হাতে) বন্দি ছিলাম। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা বন্দিদের প্রতি কল্যাণকামী হও।’ আমি এক আনসার দলের সঙ্গে ছিলাম। খাবার আনলে তারা নিজেরা খেজুর খেত। আর আমাকে রাসুল (সা.)-এর উপদেশ মতে (অধিক উত্তম খাবার) জবের রুটি খেতে দিত।’ (ইবনে হিশাম : ৩/৫৭৯)
ফিকহবিদদের মত
কারাগারে বন্দিদের সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর সাক্ষাতের সুযোগ না থাকায় দীর্ঘ নিঃসঙ্গ জীবনে বহু বিবাহিত ও অবিবাহিত নারী-পুরুষ বাধ্য হয়ে কিংবা জোরপূর্বক অবৈধ উপায়ে দৈহিক চাহিদা পূরণের পথ বেছে নেয়। তাই বেশির ভাগ হানাফি ও হাম্বলি ফিকহবিদের মতে, কারাবন্দির চারিত্রিক সংশোধন ও দৈহিক সুস্থতার কথা বিবেচনা করে স্ত্রীর বা স্বামীর সঙ্গে একান্তে সময় কাটানোর ব্যবস্থা করা উচিত। তবে এর জন্য কারাগারের অভ্যন্তরে একান্ত নির্জনবাসের সুযোগ থাকতে হবে। (হাশিয়াতু ইবনে আবিদিন : ৫/৩৭৮)
অধিকাংশ ইসলামি আইনবিদ দাম্পত্য সম্পর্ককে স্বামী-স্ত্রীর মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত বলে মত দিয়েছেন। এতে কারাবন্দির দৈহিক ও আত্মিক পরিশুদ্ধি নিশ্চিত হয়। তবে সামগ্রিক পরিবেশ বিবেচনা করে বিচারক কল্যাণকর মনে করলে বন্দির এ অধিকারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারেন।
সংশোধনই মুখ্য
কারাগারের মূল উদ্দেশ্যই হলো বন্দির সংশোধন ও প্রায়শ্চিত্তের সুযোগ দেওয়া। তাই কারাগারে তাকে আরও অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠার সুযোগ দেওয়া যাবে না। তা ছাড়া এই সুযোগ না থাকলে কারাগারের বাইরে থাকা স্ত্রী বা স্বামীর মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়। তাই কয়েদির জন্য এই সুযোগ থাকা উচিত।
আব্বাসীয় আমলে কারাগার ও কারাবন্দিদের সংখ্যা বাড়তে থাকলে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) কারাবন্দিদের জন্য একটি আচরণবিধি প্রণয়ন করেন, যা তার ‘আল খারাজ’ গ্রন্থের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। সেই আচরণবিধিতে কারাবন্দিদের অধিকার বিষয়ে খলিফা উমর ইবনে আবদুল আজিজ (রহ.)-এর নির্দেশনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কারাবন্দিদের প্রতি সদয় হও, যেন তাদের জীবনাবসান না হয়। তাদের জন্য পর্যাপ্ত খাবারের ব্যবস্থা করো। শাস্তি প্রয়োগকালে বাড়াবাড়ি করো না। বন্দিদের কেউ অসুস্থ হলে তার দেখাশোনা করো। কারাগারে নারীদের জন্য পৃথক কক্ষের ব্যবস্থা করো। বন্দিদের দেখাশোনার দায়িত্বে আস্থাবান ও নীতিবান ব্যক্তিকে নিযুক্ত করো। ঘুষখোর কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিয়ো না। কারণ সে যেকোনো অন্যায় কাজে লিপ্ত হতে পারে।’ (ইমাম আবু ইউসুফ, আল খারাজ, পৃষ্ঠা ১৫০)
আন্তর্জাতিক আইন
আমেরিকার মিসিসিপি, অরিগন ও ক্যালিফোর্নিয়ার বিভিন্ন কারাগারে গবেষণা করে দেখা যায়, স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক বন্দি স্বামীর চরিত্রকে উন্নততর করে। তা ছাড়া কারাগারে বিরাজমান বিকৃতভাবে দৈহিক চাহিদা পূরণের প্রবণতা হ্রাস করে। দক্ষিণ আমেরিকার বহু কারাগার ও পশ্চিম ইউরোপের অনেক কারাগারে বন্দিদের সঙ্গে সময় কাটাতে স্ত্রীদের আসার ব্যবস্থা করা হয়। তা ছাড়া বিভিন্ন উপলক্ষে অনেক কয়েদিকে নিজ বাড়িতে স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ দেওয়া হয়। (ইনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটেনিকা : ১৪/১১০০; আহকামুস সিজনি ফি মুআমালাতিস সুজানা, পৃষ্ঠা ৪৫৯)
জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদ ‘ইউনিভার্সেল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটস’-এর বলা হয়েছে, নারী ও পুরুষ প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর বিয়ে করা ও পরিবার গড়ার অধিকার তাদের আছে। এ অধিকার বাস্তবায়নে প্রথা, সমাজ, রাষ্ট্র বা ধর্মীয় কোনো বাধা-নিষেধ নেই। এ অধিকার বাস্তবায়নে কারাবন্দি ও আটক ব্যক্তিদের নিজেদের পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও স্ত্রীদের একান্ত বাসের সুযোগ দেওয়া আবশ্যক।
জাতিসংঘের নীতিমালার ২৮ নম্বর ধারা, যা ‘দ্য ব্যাংকক রুলস’ নামে পরিচিত, তাতে বলা হয়, স্বামীর সঙ্গে সাক্ষাৎকালে নারীবন্দিদেরও পুরুষদের মতো এ অধিকার দিতে হবে। এ ছাড়া পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ ও সাক্ষাতের সুযোগ দিতে হবে। বন্দির চারিত্রিক সংশোধন ও পুনর্বাসন করতে বন্দি স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে শরিয়তসম্মত নির্জনবাসের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। কেননা ইসলামি শরিয়ত কারাগারের ভেতর ও বাইরে থাকাবস্থায় দাম্পত্য জীবন সুদৃঢ় করার নির্দেশনা দেয়।
বিভিন্ন দেশের নজির
যুক্তরাষ্ট্রের কারাগারে স্ত্রীদের সঙ্গে বন্দিদের সাক্ষাতের সুযোগ দেওয়া হয়। মিসরে কারাবন্দিদের নির্ধারিত সময়ের এক-তৃতীয়াংশ অতিবাহিত হওয়ার পর বহু বন্দিকে ঘরে গিয়ে পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ দেওয়া হয়। সুদানে ১৯৯২ সাল থেকে বৈবাহিক সম্পর্ক সুনিশ্চিত হওয়ার পর বন্দিদের স্ত্রীদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ দেওয়া হয়।
জর্দানের ‘সংশোধন ও পুনর্বাসন কেন্দ্র’ প্রকাশিত আইনের ২০ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, এক বছর বা এর বেশি সময়ের সাজাপ্রাপ্ত বন্দিরা কেন্দ্রের নির্ধারিত স্থানে ‘শরিয়তসম্মত বৈবাহিক নির্জনবাস’ যাপনের সুযোগ পাবে। ২০০৫ সাল থেকে লিবিয়াতেও সংশোধন ও পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোর নির্ধারিত স্থানে চার মাসে কমপক্ষে এক ঘণ্টার জন্য স্ত্রীদের সঙ্গে স্বামীরা সময় কাটানোর সুযোগ পায়। অবশ্য এ ক্ষেত্রে বৈবাহিক সম্পর্ক সুনিশ্চিত হওয়ার জন্য নির্ধারিত নীতিমালা অনুসরণ করতে হয়।
সৌদি আরবে তিন মাসের বেশি সময়ের কারাবন্দিদের প্রতি মাসে তিন ঘণ্টার জন্য স্ত্রীদের সঙ্গে নির্জনবাসের সুযোগ দেওয়া হয়। এ জন্য কারাগার ও অফিস থেকে দূরে নিরাপত্তাবেষ্টিত স্থান প্রস্তুত থাকে। এমনকি পারিবারিক সুসম্পর্ক দৃঢ় করতে নানা খাবার ও উপঢৌকনও আনার সুযোগ আছে। (সৌদি মন্ত্রিপরিষদের নির্বাহী আদেশ, ১৩ নম্বর ধারা, ১৭৪৫ নম্বর আদেশ, ১৭-০৬-১৪১১ হি. প্রকাশিত) এ ছাড়া ডেনমার্ক, সুইডেন, নিউজিল্যান্ড, স্পেনসহ ইউরোপের অনেক দেশে বন্দিদের একটি নির্দিষ্ট সময় লোকদৃষ্টির আড়ালে প্রয়োজনীয় সুবিধাসম্পন্ন ছোট কক্ষে স্ত্রীর সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ দেওয়া হয়। (হিউম্যান রাইটস মেথলজি ইন প্রিজন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, পৃষ্ঠা : ১০১)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন