সাওরা আল বারী:
মক্কা, মদীনার প্রতি মুসলিমদের আবেগ ও ভালোবাসা সীমাহীন। সহস্র বছর ধরে অজস্র মুসলিম কাবা যিয়ারতের স্বপ্ন নিয়ে যুবক থেকে বৃদ্ধ হয়েছেন। নবিজির দেশে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা বুকে নিয়ে পরকালে পাড়ি জমিয়েছেন অসংখ্য আশিক।
তাদের সংখ্যা বেশুমার। অর্থবিত্ত বা শক্তিসামর্থ্যের অভাব যেভাবে তাদের স্বপ্নপূরণকে কঠিন করে তুলত, তেমনি বিক্ষুব্ধ সমুদ্র ও ধূ ধূ মরুভূমি দুঃসাধ্য করে তুলত তাদের হেজাজের যাত্রা। তবুও অনেকেই দৃঢ় মনোবল নিয়ে হেজাজের পথে মুসাফির হতেন। এই যাত্রা কতটা কঠিন, কতটা দীর্ঘ হত- সে বর্ণনা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিব্রাজকের কলমে উঠে এসেছে। কখনো নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছে কোনো হাজীর স্মৃতিচারণে।
সে সময় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কেউ জাহাজে করে, কেউ পদব্রজে, কেউ ঘোড়া বা উঠের পিঠে চড়ে হজে যেতেন। স্থলপথে হাজার হাজার হাজী দলবদ্ধ হয়ে পাড়ি দিতেন মরুসাগর। নিরাপত্তার জন্য তাদের সাথে থাকত প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র। এ দীর্ঘ যাত্রার পদে পদে থাকত বিপদ। কখনো ডাকাতরা হামলা করত হাজীদের উপর, কখনো বেদুইনরা। তারা সবকিছু লুটে নিত। বাধা দিতে গেলে প্রাণ কেড়ে নিত হাজীদের।
পরবর্তীতে হাজীদের নিরাপদ হজযাত্রার জন্য যাতায়াতের পথের বেদুঈন গোত্রদের সাথে চুক্তি করে মক্কা-মদীনার হজ্ব ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। তখন থেকে হাজীদের দুর্ভোগ কিছুটা কম হয়।
উপমহাদেশের মুসলিমদের জন্যও অতীতকালে হজ্বযাত্রা ছিল এক দুঃসাধ্য সফর। অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত তাদের জন্য মক্কার পথ ছিল দু’টো। একটা সমুদ্রপথ, তবে এ পথ ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপৎসংকুল। যে কোনো সময় সমুদ্রে ঝড় উঠত, অথবা শুরু হত পর্তুগিজ জলদস্যুদের উৎপাত।
অপরটা স্থলপথ, উত্তর-পশ্চিম ভারত অতিক্রম করে পাকিস্তান থেকে পারস্য হয়ে তারপর গন্তব্য। প্রথম পথের তুলনায় এটা একটু নিরাপদ হওয়া সত্ত্বেও এই পথ তাদের সফরের উপযোগী ছিল না। একে তো যাত্রাপথের কষ্ট, তার উপর পারস্যের (ইরান) শিয়াদের বিরূপ আচরণ। এজন্য বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের হাজীরা সমুদ্রপথকেই হজ্বের জন্য বেছে নিয়েছিলেন।
বাঙ্গালী হাজীরা ভারতের বোম্বে (মোম্বাই) থেকে জাহাজে চড়তেন। কিছু হাজী বোম্বে যাওয়ার পর অসুস্থ হয়ে পড়া বা জাহাজ মিস করার ফলে হজে যেতে পারতেন না। তারা দেশে না ফিরে সেখানেই অবস্থান করতেন। হজ্ব শেষে মক্কা থেকে হাজীরা যখন ফিরে আসতেন, তখন বোম্বাইতে আটকে যাওয়া হাজীরা তাদের সঙ্গে ঘরে ফিরতেন। এসব হাজীদেরকে বলা হত ‘বোম্বাই হাজী’।
হাজীরা ভারত থেকে পাকিস্তান হয়ে পাড়ি দিতেন লোহিত সাগর। তাদের এই সফর ছিল অন্যরকম। একদিকে বুকের ভেতর সীমাহীন আবেগ, অপরদিকে কাবার যিয়ারত নসীব হবে কিনা, সেই শংকা। সমুদ্রপথের সফরে যে কোনো সময় ঝড়ের কবলে পড়তেন তারা। সাগর গর্জে উঠে লণ্ডভণ্ড করে দিত তাদের স্বপ্ন।
কোনো কোনো জাহাজ সম্মুখীন হত পর্তুগিজ জলদস্যুদের। ষোলো শতকের লোহিত সাগর ছিল পর্তুগিজ নিয়ন্ত্রণে। ফলে সমুদ্রে পর্তুগিজ জলদস্যুদের দৌরাত্ম্য ছিল অনেক বেশি। বিশ্বাসের দিক থেকে ওরা কট্টর খ্রিস্টান ছিল। হজযাত্রীদের জাহাজে হামলা করাকে তারা আর্থিক লাভের পাশাপাশি পুণ্যের কাজও মনে করত। এ কারণে বাংলাদেশ ও উপমহাদেশের হজযাত্রীদের জন্য আতঙ্ক বলে বিবেচিত হত তারা। অবশ্য পরবর্তীতে জলদস্যু ও পর্তুগিজ কর্তৃপক্ষের সাথে চুক্তি হয়। তখন আর্থিক বিনিময় নিয়ে ওরা পাস দিত উপমহাদেশের সকল জাহাজ।
ঝড়ঝঞ্ঝা বা জলদস্যুর বিভীষিকা ছাড়াও হাজীরা সম্মুখীন হতেন আরো অনেক পরীক্ষার। কখনো শেষ হয়ে যেত খাবার-পানি। ক্ষুধা-পিপাসায় কাতর হয়ে পড়তেন তারা। কখনো আক্রান্ত হতেন মহামারীতে। মক্কায় পৌঁছার আগেই অনেক হাজী ঢলে পড়তেন মৃত্যুর কোলে।
খান বাহাদুর আহছানউল্লা হজ্ব করেছেন ১৯১২ সালে। ফিরে এসে নিজের অভিজ্ঞতা কথা লিখেছেন তিনি। তাদের জাহাজ ইয়েমেনের সুকুট্রা (سُقُطْرٰى) দ্বীপের নিকটবর্তী হওয়ার পর ঝড়ের কবলে পড়েছিল। জাহাজ কাঁত হয়ে যাওয়া বা প্রচণ্ড দোল খাওয়ার ফলে তাদের কাচের জিনিসপত্র ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গিয়েছিল। আতঙ্কে বমি ও মলমূত্র ত্যাগ করেছিলেন ডেকের যাত্রীরা। জাহাজের শিকল ধরে মৃত্যুর প্রহর গুনছিলেন অনেক হাজী।
তবে মাঝে মধ্যে কোনো হাজীবাহী জাহাজের যাত্রা হয়ে উঠত খুবই সুখকর। সৌভাগ্যবশত তাদেরকে না স্পর্শ করত সমুদ্রঝড়, আর না তাদের জাহাজে হানা দিত পর্তুগিজ জলদস্যু। তারা নিশ্চিন্তে তালবিয়া পড়তেন, সূর্যাস্ত দেখতেন, উপভোগ করতেন উড়ুক্কু মাছের উড়ে এসে জাহাজের পাটাতনে পড়ার দৃশ্য।
বাংলাদেশ ও উপমহাদেশের হাজীবাহী জাহাজ নোঙ্গর করত জেদ্দা সমুদ্রবন্দরে। সেখান থেকে হাজীরা কখনো যেতেন মক্কায়, কখনো মদীনায়। মদীনায় যাওয়ার জন্য পাড়ি দিতে হত দীর্ঘ মরুপথ। মাথার উপর সূর্যের প্রচণ্ড তাপ, পায়ের নিচে উত্তপ্ত ভূমি আর পানি শূন্যতা নিয়ে অব্যাহত থাকত তাদের যাত্রা। তার উপর ছিল বেদুঈন দস্যুদের অত্যাচার। খান বাহাদুর আহছানউল্লা এ সময়টুকুর স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন-
‘জাহাজ জেদ্দা বন্দরে পৌঁছাল। এরপর আমরা উটের পিঠে উঠে মদীনা শরীফ অভিমুখে যাত্রা শুরু করি। মদীনা শরীফ এখান থেকে ২৫০ মাইল দূরে। পথে অনেক মনজিল রয়েছে। প্রত্যেক মনজিলে জ্বালানি কাঠ ও মশকভরা পানি পাওয়া যায়। পাওয়া যায় কফি, খেজুর আর তরমুজ। বাদ-জোহর কাফেলা চলত। শেষরাতে এসে মনজিলে পৌঁছাত। আমাদের কাফেলায় ৩০০টি উট ছিল। শত্রুভয়ে কাফেলা পথে থামত না। মনজিলে পৌঁছানোর পর গোসল, পায়খানা-প্রস্রাব ও খাওয়াদাওয়া সম্পন্ন হতো। আমরা কয়েকটি মনজিল খুব কষ্ট করে পৌঁছালাম। রাত নামলেই শত্রুরা বন্দুক ও তলোয়ার নিয়ে এগিয়ে আসত। তাদের টাকা দিয়ে খুশি করতে হত। এদের উৎকোচ দিতে গিয়ে আমরা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়লাম। আমরা তাদের সঙ্গে লড়াই করার প্রস্তুতি গ্রহণ করলাম।’
বাংলাদেশ ও উপমহাদেশের হাজীদের হজসফরে সময় লেগে যেত প্রায় ছয় থেকে আটমাস। এরমধ্যে রোগশোকে মারাও যেতেন অনেকে। যেহেতু দীর্ঘদিনের সফর ছিল, আবার দেশে ফিরে আসতে না পারার আশংকাও থাকত, তাই বাঙ্গালী মুসলিমরা শেষ বয়সে হজ্ব করাকে প্রাধান্য দিতেন। আবার তখন হজ্বের প্রক্রিয়াটাও ছিল জটিল আর দীর্ঘ। এজন্য তারা নিজেদেরকে যাবতীয় বৈষয়িক বিষয়আশয় ও দুনিয়াদারি থেকে মুক্ত করে হজের প্রস্তুতি নিতেন। যাতে তাদের কোনো পিছুটান না থাকে। যদি মারা যান, তাহলে সে বরকতময় ভূমিতেই যেন দাফন হতে পারেন।
তাদের এ অভিব্যক্তিকে খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম-
‘চলরে কাবার জিয়ারতে, চল নবীজীর দেশ।
দুনিয়াদারীর লেবাস খুলে পর রে হাজির বেশ।’
সূত্র :
ট্রাভেলস অব ইবনে বতুতা
আমার জীবন-ধারা, খান বাহাদুর আহছানউল্লা
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন