হজে যেতে প্রাক নিবন্ধন ও নিবন্ধনের জন্য টাকা জমা দিলেও করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে এবার আর সৌদি আরবে যাওয়া সম্ভব হবে না বলেই মনে করছেন নিবন্ধনকারীরা।
হজের দায়িত্বে থাকা সরকারি কর্মকর্তারাও তাদের আশা দেখাতে পারছেন না। তবে তারা আশ্বস্ত করেছেন, শেষ পর্যন্ত এবার বাংলাদেশ থেকে হজে যেতে না পারলেও কারও টাকা খোয়া যাবে না।
হজ নিয়ে অনিশ্চয়তার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে আশকোনা হজ অফিসের পরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ বছর হজের বিষয়ে এখনও সৌদি সরকার কিছু জানায়নি। আশা করছি রবি-সোমবার একটা কিছু জানাবে।
“সৌদি সরকার কী জানায় এবং আমাদের সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে কী সিদ্ধান্ত নেয় তার ওপর সব কিছু নির্ভর করছে।”
গত মার্চের প্রথম দিকে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পর এখনই সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হচ্ছে। মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বৃহস্পতিবার লাখ ছাড়িয়েছে। আর শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত বাংলাদেশে এ রোগে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১ হাজার ৩৮৮ জন হয়েছে।
সৌদি আরবেও মহামারী পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি, বরং সেখানেও সংক্রমণ বাড়ছে। বৃহস্পতিবার একদিনে দেশটিতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪ হাজার ৭৫৭ জনের সংক্রমণ ধরা পড়েছে বলে সৌদি গেজেট জানিয়েছে।
তাতে সৌদি আরবে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে এক লাখ ৪৫ হাজার ৯৯১ জনে। আর মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক হাজার ১৩৯ জনে।
করোনাভাইরাস সংক্রমণের এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে মানুষের চলাচলে বিধি-নিষেধ তুলে নেওয়া হলেও সৌদি আরবে গত তিন মাস ধরে চলমান লকডাউন এখনও অব্যাহত রয়েছে।
এই অবস্থায় এবার আর হজে যাওয়া হবে না বলেই মনে করছেন মো. দেলোয়ার হোসেন, যিনি সময়মতো নিবন্ধন করেছিলেন।
শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমি এ বছর হজে যাওয়ার কোনো আশাই করছি না। সৌদি আরব মনে হয় না কাউকে নেবে।
“ধারণা করছি, সৌদি সরকার আশপাশের দুই-একটি দেশ থেকে অল্প কিছু সংখ্যক লোক নিয়ে হজের কাজটা এই বছর চালিয়ে নেবে।”
করোনাভাইরাসের কারণে হজে যেতে না পারলেও জমা করা টাকা খোয়া যাবে না বলে আশ্বস্ত করেছেন ধর্ম মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মোহাম্মদ আনোয়ার হোসাইন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “প্রাক নিবন্ধন ও নিবন্ধনের টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে দিতে হয়। টাকা ব্যাংকে জমা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রণালয় থেকে একটি চিঠি দেওয়া হয় যেন এই টাকা আর কেউ উঠাতে না পারে।
“পরে বিমানের টিকেট বা অন্যান্য বাবদ পে-অর্ডারের মাধ্যমে ওই টাকা উত্তোলন করা যাবে। সুতরাং যারা হজে যেতে পারবেন না তাদের টাকা খোয়া যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।”
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের এই কর্মকর্তা বলেন, এ বছর কেউ হজে যেতে না পারলে তারা তাদের টাকা ফেরত নিতে পারবেন। আবার আগামী বছর যেতে চাইলেও তারা যেতে পারবেন। সেটা তার ওপর নির্ভর করবে।
সৌদি আরবের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী, চলতি বছর বাংলাদেশ থেকে এক লাখ ৩৭ হাজার ১৯৮ জন হজে যাওয়ার কথা ছিল। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ১৭ হাজার ১৯৮ জন এবং বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় এক লাখ ২০ হাজার জনের হজে যাওয়ার সুযোগ ছিল।
সে মোতাবেক ১ মার্চ থেকে হজে যেতে আগ্রহীদের নিবন্ধন শুরু হয়। তবে ৮ মার্চ দেশে প্রথম কোভিড-১৯ রোগী ধরা পড়লে নিবন্ধনে ভাটা পড়ে। এরপর প্রথম দফায় ২৫ মার্চ, দ্বিতীয় দফায় ৮ এপ্রিল এবং শেষ দফায় ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত নিবন্ধনের সময় বাড়ানো হয়।
শেষ পর্যন্ত সরকারি ব্যবস্থাপনায় তিন হাজার ৪৫৭ জন এবং বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ৬১ হাজার ১৩৭ জনসহ মোট ৬৪ হাজার ৫৯৪ জন নিবন্ধন করেন।
বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় নিবন্ধনের সময় প্রত্যেককে এক লাখ ৮২ হাজার ৯৫২ টাকা ব্যাংকে জমা দিতে হয়েছে। তাতে মোট
এক হাজার ১১৮ কোটি ৫১ লাখ ৩৬ হাজার ৪২৪ টাকা। সৌদি আরবে বাড়ি ভাড়া ও মোয়ালেম ফি হিসেবে পরে তাদের আরও টাকা দেওয়ার কথা।
আর সরকারি ব্যবস্থাপনায় হজের জন্য যারা নিবন্ধন করেছেন, তাদের প্যাকেজ অনুযায়ী পুরো টাকা ব্যাংকে জমা দিতে হয়।
সরকারিভাবে এবছর হজের যে তিনটি প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে প্রথম প্যাকেজে ৪ লাখ ২৫ হাজার টাকা, দ্বিতীয় প্যাকেজে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা এবং তৃতীয় প্যাকেজে তিন লাখ ১৫ হাজার টাকা খরচ হওয়ার কথা।
মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, তিন ধরনের প্যাকেজেই টাকা জমা দিয়েছেন নিবন্ধনকারীরা। তবে কোন প্যাকেজে কতজন টাকা জমা দিয়েছেন তা তিনি জানাতে পারেননি।
যদি সবচেয়ে কম সশ্রয়ী প্যাকেজ ধরেও হিসাব করা হয় তাহলে সরকারি ব্যবস্থায় নিবন্ধনকারীদের জমা দেওয়া অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ১০৮ কোটি ৮৯ লাখ ৫৫ হাজার টাকা।
বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় যারা নিবন্ধন করেছিলেন, তাদেরও টাকা খোয়া যাওয়ার কোনো ভয় নেই বলে আশ্বস্ত করেছেন হজ এজেন্সি অ্যাসেসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হাব) সভাপতি শাহাদাত হোসেন তসলিম।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এখান থেকে কারও টাকা ওঠানোর সুযোগ নেই। সুতরাং কোনো টাকা মাইর যাবে না- এটা শতভাগ নিশ্চিত।”
প্রতি বছর হজে লোক পাঠান কেরানীগঞ্জের শুভাড্যা গ্রামের বাসিন্দা হাজী মো. মোস্তফা। হজের জন্য জমা দেওয়া টাকা নিয়ে দুশ্চিন্তা না করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
মোস্তফা বলেন, “হজের নিবন্ধনের টাকা ব্যাংকে জমা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই অ্যাকাউন্ট সরকার ফ্রিজ করে ফেলে। পরে পে-অর্ডারের মাধ্যমে ওই টাকা উত্তোলন করা যায়। সুতরাং টাকা খোয়ানোর কোনো ঝুঁকি নেই। আমরা ইচ্ছা করলেও ওই টাকা উঠাতে পারব না।
“তবে যদি আমি হজে যেতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের কাছ থেকে প্রাক নিবন্ধন ও নিবন্ধনের টাকা নিয়ে ব্যাংকে জমা না দিই, তাদের বলি যে ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু আমি তাদের টাকা নিয়ে ব্যক্তিগত কাজে খরচ করি... সেটা হচ্ছে অন্য হিসাব।”
আগামী ২৩ জুন বাংলাদেশ থেকে প্রথম হজ ফ্লাইট ছাড়ার সূচি ঠিক হয়েছিল জানিয়ে মোস্তফা বলেন, “কিন্তু আমরা তো নিবন্ধনে আটকে রইলাম। এবার হজে যাওয়ার কোনো আশাই দেখছি না।
“এমনিতে সময় খুব কম আর করোনাভাইরাসের বিস্তার দেশে এবং সৌদি আরবেও বেড়ে গেছে। অনেক দেশ থেকেই ঘোষণা এসেছে যে, হজে যাবে না।”
করোনাভাইরাসের কারণে হজ বাতিল হলে বহু মানুষ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে জানান হাব সভাপতি তসলিম।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “হজের সঙ্গে এ বছর প্রায় আটশ এজেন্সি জড়িত এবং এসব এজেন্সির সঙ্গে লক্ষাধিক মানুষ। হজের ওপর তাদের জীবন ও জীবিকা নির্ভর করে।
“এছাড়া সৌদি আরবে প্রায় ৫০ হাজার বাংলাদেশি সারা বছর এই হজের সময়ের অপেক্ষায় থাকেন। এই সময়ের আয় দিয়ে সেখানে ও দেশে তাদের পরিবার চলে।”
‘গেরো’ কাটছে না উপাধ্যক্ষ সোলায়মানের
চাঁদপুরের কচুয়া বঙ্গবন্ধু ডিগ্রি কলেজের উপাধ্যক্ষ পদ থেকে কিছু দিন আগে অবসর নেওয়া মো. সোলায়মান মিয়ার মন খারাপ এবার দ্বিতীয় দফায়ও হজে যাওয়ার চেষ্টায় বাধা আসার কারণে।
গেল বছর স্ত্রীকে নিয়ে হজে যাওয়ার জন্য ২০১৮ সালে নিজের সাবেক এক ছাত্রের হাতে তুলে দিয়েছিলেন চার লাখের বেশি টাকা। সেই ব্যক্তি প্রাক নিবন্ধন ও নিবন্ধন করেছেন জানিয়ে ২০১৯ সালেই তারা হজ করতে পারবেন বলে আশ্বাস দেন।
কিন্তু হজের তারিখ ঘনিয়ে এলেও তাদের ফ্লাইটের দিন না পড়ায় সন্দেহ বাড়তে থাকে সোলায়মানের। পরে ওই ব্যক্তি তাদের বলেন, এ বছর হজে যেতে পারবেন না, সামনের বছর ২০২০ সালে যেতে পারবেন, কারণ ‘সিরিয়াল’ পেছনে পড়েছে।
তখন সোলায়মান মিয়া খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, ওই ব্যক্তি তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। তিনি টাকা নিয়ে শুধু প্রাক নিবন্ধন করেছেন, নিবন্ধন করেননি।
পরে অনেক ধরাপড়া করে ওই ব্যক্তির কাছ থেকে কয়েক দফায় চার লাখ টাকা ফেরত নেন সোলায়মান মিয়া। বাকি কয়েক হাজার টাকার আশা তাকে ছেড়ে দিতে হয়েছে।
এবার স্বামী-স্ত্রী হজে যাওয়ার জন্য প্রাক নিবন্ধন ও নিবন্ধন বাবদ জনপ্রতি এক লাখ ৮২ হাজার টাকা করে জমা দিয়েছেন হজ এজেন্সির মাধ্যমে। প্রাক নিবন্ধনের জন্য দেন জনপ্রতি ৩০ হাজার ৭২০ টাকা আর বাকি টাকা দিয়ে নিবন্ধন করেন। আরও টাকা দেওয়ার বাকি রয়েছে তাদের, সৌদি আরবে বাড়ি ভাড়া ও মোয়ালেম ফি হিসেবে ওই টাকা দিতে হয়।
তবে এবারও তাদের আর হজে যাওয়া হচ্ছে না বলেই মনে করছেন সোলায়মান মিয়া।
শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “গত বছর যেতে পারলাম না প্রতারণার শিকার হওয়ায় কারণে। আর এ বছর হলাম করোনাভাইরাসের শিকার।”
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন