হযরত যায়েদ ইবনে হারেসা রদিয়াল্লহু আনহু। জাহিলিয়াতের যুগে তার মায়ের সঙ্গে নানা বাড়িতে যাচ্ছিলেন। বনু কায়সের লোকেরা তাদের কাফেলাকে লুন্ঠন করিল। তার মধ্যে হযরত যায়েদ (রা.) ও ছিলেন। তাকে মক্কার বাজারে বিক্রয় করিয়া দিলেন। হাকীম ইবনে হিযাম তাকে তার আপন ফুফু হযরত খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা এর জন্য ক্রয় করিয়া নিলেন।
যখন প্রিয় নবীর সহিত হযরত খাদিজার বিবাহ হইল তখন তিনি যায়েদকে রাসুলুল্লাহর খেদমতে হাদিয়া স্বরূপ পেশ করিলেন। হযরত যায়েদ রদিয়াল্লহু আ’নহু এর পিতা পুত্রের বিচ্ছেদে অত্যন্ত ব্যথিত ছিলেন। আর এরূপ হওয়াটাই স্বাভাবিক। কেননা সন্তানের মুহাব্বাত জন্মগত জিনিস। তিনি যায়েদের (রদিয়াল্লহু আ’নহু) বিচ্ছেদে কাঁদিতেন আর শোকের কবিতা পড়িয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেন। অধিকাংশ সময়ে যেসমস্ত কবিতা পাঠ করিতেন। মোটকথা তিনি এই সমস্ত কবিতা পড়িতেন এবং ক্রন্দনরত অবস্থায় তাহাকে খুঁজিয়া বেড়াইতেন।
ঘটনাক্রমে তাহার গোত্রের কিছু লোক হজ্জে গেল। এবং তাহারা যায়েদ রদিয়াল্লহু আনহু কে দেখিয়া চিনিয়া ফেলিন। তাঁহাকে পিতার অবস্থা শুনাইল, কবিতা শুনাইল এবং তাহার স্মরণ ও বিচ্ছেদের করুন কাহিনী শুনাইল। হযরত যায়েদ রদিয়াল্লহু আ’নহু তাহাদের মাধ্যমে পিতার নিকট তিনটি লাইন বলিয়া পাঠাইলেন যাহার অর্থ ছিল–
আমি এখানে মক্কায় ভাল আছি। আপনারা আমার জন্য কোন দুঃখ ও চিন্তা করিবেন না। আমি অত্যন্ত দয়ালু লোকদের গোলামীতে আছি।
তাহারা যাইয়া যায়েদের হাল অবস্থা তাহার পিতাকে জানাইল এবং যায়েদ রদিয়াল্লহু আ’নহু যে কবিতা বলিয়া দিয়াছিলেন তাহাকে শুনাইল এবং ঠিকানা বলিয়া দিল। যায়েদ রদিয়াল্লহু আ’নহু এর পিতা এবং চাচা কিছু মুক্তিপণ লইয়া তাঁহাকে মুক্ত করার উদ্দেশ্য মক্কা মুকাররমায় পৌঁছিলেন।
তারা এসে প্রিয় নবীর খেদমতে পৌছিলেন এবং আরজ করিলেন, হে হাশেমের বংশধর! এবং আপন গোত্রের সরদার, হারাম শরীপের অধিবাসী এবং আল্লাহর ঘরের প্রতিবেশী। আপনার স্বয়ং কয়েদীদের মুক্ত করেন, ক্ষুধার্তদের খাদ্য দান করেন। আমরা আমাদের ছেলের তালাশে আপনার নিকট আসিয়াছে। আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করুন, দয়া করুন এবং মুক্তিপণ লইয়া তাহাকে ছাড়িয়া দিন। বরং মুক্তিপণ যাহা আসে উহার চাইতেও বেশী গ্রহণ করুন।
রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলিলেন, কি ব্যাপার? তাহারা বলিলেন, আমরা যায়েদের খোঁজে আসিয়াছি। রসুলুল্লাহ বলিলেন, শুধু এই ব্যাপার? তাহারা বলিলেন, শুধু ইহাই উদ্দেশ্য। প্রিয় নবী বলিলেন তাহাকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করুন। যদি সে আপনাদের সহিত যাইতে চায় তবে মুক্তিপণ ছাড়াই তাহাকে দান করিলাম। আর যদি সে যাইতে না চায়, তবে আমি এমন ব্যক্তির উপর চাপ সৃষ্টি করিতে পারিনা যে নিজেই যাইতে চাহে না। তাহারা বলিল, আপনি আমাদের দাবীর চেয়ে বেশী অনুগ্রহ করিয়াছেন। আমরা ইহা খুশীতে মানিয়া লইলাম।
হযরত যায়েদ রদিয়াল্লহু আ’নহু কে ডাকা হইল। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞাসা করিলেন। তুমি কি ইহাদের চিন? তিনি বলিলেন, জ্বি হ্যাঁ, চিনি। ইনি আমার পিতা, ইনি আমার চাচা। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলিলেন, তুমি আমার অবস্থা সম্পর্কে জান। এখন তোমার ইচ্ছা, যদি আমার কাছে থাকিতে চাও তবে আমার কাছে থাক, আর ইহাদের সহিত যাইতে চাহিলে অনুমতি আছে।
হযরত যায়েদ রদিয়াল্লহু আ’নহু বলিলেন, আমি কি আপনার মুকাবিলায় অন্য কাহাকেও পছন্দ করিতে পারি? আপনি আমার পিতৃতুল্য ও চাচাতুল্য। পিতা ও চাচা বলিলেন, হে যায়েদ! তুমি আযাদীর তুলনায় গোলামীকে অগ্রাধিকার দিতেছ? আর বাপ, চাচা ও পরিবারের লোকদের চেয়ে গোলাম থাকাকেই পছন্দ করিতেছ? হযরত যায়েদ রদিয়াল্লহু আ’নহু প্রিয় নবীর দিকে ইশারা করিয়া) বলিলেন, আমি তাঁহার মধ্যে এমন বিষয় দেখিতে পাইয়াছি যাহার মুকাবেলায় অন্য বস্তুকেই পছন্দ করিতে পারিতেছি না। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম তাহার এই উত্তর শুনিয়া তাহাকে কোলে উঠাইয়া লইলেন এবং বলিলেন, আমি তাহাকে আপন পুত্র বানাইয়া লইলাম। যায়েদ রদিয়াল্লহু আ’নহু এর পিতা ও চাচা এই দৃশ্য দেখিয়া অত্যন্ত আনন্দিত হইলেন এবং খুশিমনে তাঁহাকে রাখিয়া চলিয়া গেলেন। (খামীস)
যায়েদ রদিয়াল্লহু আ’নহু ঐ সময়ে বাচ্চা ছিলেন। বাচ্চা অবস্থায় পিতামাতা পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন সকলকে ত্যাগ করিয়া গোলাম থাকাকে পছন্দ করা কতখানি মুহাব্বাতের পরিচয় দেয় তাহা পরিষ্কার বুঝা যায়।
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন