প্রবীণদের প্রতি সম্মান দেখানো সব সমাজেরই রীতি। তাদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, দায়িত্বশীলতা ও তাদের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট থাকতে ইসলাম সব সময় গুরুত্ব দিয়েছে। সাধারণত বয়স্ক-প্রবীণ বা বড় ও শ্রদ্ধাভাজনদের প্রতি যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শনে কেউ কার্পণ্য করে না।
প্রবীণদের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করা মুসলিমদের রীতি ও ঐতিহ্য। প্রবীণদের প্রতি সম্মানসূচক ব্যবহার সমাজে শৃঙ্খলা ও শান্তির পরিবেশ বজায় রাখে।
প্রবীণদের শ্রদ্ধা ও নবীনদের স্নেহ করা প্রিয়নবী (সা.)-এর সুন্নত। হাদিসে রাসুল (সা.) এ সম্পর্কে বলেন, ‘যারা ছোটদের স্নেহ করে না এবং বড়দের সম্মান করে না, তারা আমার দলের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ (জামিউস সুন্নাহ ওয়া শুরুহুহা, হাদিস : ৩৫৫)
মর্যাদাবান ব্যক্তিকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দেওয়া উচিত। এটা মহানবীর শিক্ষা। এক হাদিসে হজরত রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘মানুষের সঙ্গে তাদের পদমর্যাদা অনুযায়ী আচরণ করো।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৮৪২)
বাস্তবিকভাবে পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রবীণদের অবদান অপরিসীম। পরিবার গঠন, উন্নয়ন ও সমাজের কল্যাণে কর্মময় জীবন ব্যয় করেএকসময়ে তারা বার্ধক্যে উপনীত হন। তখন প্রবীণদের সার্বিক কল্যাণ ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা সমাজের আবশ্যিক কর্তব্য।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের এক তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখের মতো প্রবীণ রয়েছেন। তাদের মধ্যে শতকরা ৮৮ ভাগ প্রবীণের কোনো না কোনো সন্তান পরিবারের বাইরে থাকেন। শতকরা ২০ জন হয় একাকী পরিবার-পরিজনহীন অথবা কেবল স্বামী-স্ত্রী মিলে বসবাস করেন। শতকরা ৫৯ জন প্রবীণ নারী বিধবা এবং সন্তানের মা। তারা ছেলেসন্তানের সঙ্গে থাকেন না। নানা দুরবস্থার মধ্য দিয়ে তাদের জীবন কাটে। (তথ্যসূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৬ আগস্ট, ২০১৪)
অন্যদিকে সন্তানরা বৃদ্ধ বাবা-মাকে প্রাপ্য মর্যাদা না দেওয়ার ফলে পারিবারিক শান্তি বিঘ্নিত হচ্ছে ও পরিবারপ্রথা হুমকির মুখে পড়ছে। বিভিন্ন ধরনের সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে।
অথচ পবিত্র কোরআনে (সন্তানদের শিক্ষামূলক) বলা হয়েছে, ‘হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাকে সামর্থ্য দাও, যাতে আমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারি। আমার প্রতি ও আমার বাবা-মায়ের প্রতি তুমি যে অনুগ্রহ করেছো, তার জন্য এবং যাতে আমি সৎকাজ করতে পারি, যা তুমি পছন্দ করো।’ (সুরা আহকাফ, আয়াত : ১৫)
দুঃখজনক হলেও আমাদের সমাজে বৃদ্ধ বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসার প্রবণতা তৈরি হচ্ছে। অথচ সন্তানরা বেশ সামর্থ্যবান ও বিত্তশালী। প্রবীণরা বৃদ্ধাশ্রমে যদিও খাওয়া-পরা সবকিছুই সঠিকভাবে পেয়ে থাকেন, কিন্তু নিজের আপনজনদের ছেড়ে একাকিত্বময় জীবন যে কত কষ্ট ও বিষাদের, তা বলাই বাহুল্য। অথচ ইসলামের বিধানে প্রবীণরা ভালোবাসা, সেবাযতœ ও শ্রদ্ধা পাওয়ার অত্যধিক যোগ্য ও অধিকারী।
পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আমি মানুষকে বাবা-মায়ের প্রতি সদাচারণের নির্দেশ দিয়েছি।’ (সুরা লোকমান, আয়াত : ১৪)
আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, সন্তানের ওপর বাবা-মায়ের দায়িত্ব কী? রাসুল (সা.) বললেন, ‘তারা উভয়েই তোমার জান্নাত অথবা জাহান্নাম।’ (ইবনে মাজাহ, পৃষ্ঠা : ২৬০)
হাদিসের সারমর্ম হচ্ছে, তাদের আনুগত্য ও সেবাযতœ জান্নাতে নিয়ে যায় এবং তাদের সঙ্গে অসৎ আচরণ ও তাদের অসন্তুষ্টি জাহান্নামে পৌঁছে দেয়।
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘বাবা-মায়ের সন্তুষ্টির মধ্যেই আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং বাবা-মায়ের অসন্তুষ্টির মধ্যেই আল্লাহর অসন্তুষ্টি নিহিত।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২/১২)
অন্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-কে প্রশ্ন করেন, আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয় কাজ কোনটি? রাসুল (সা.) বললেন, ‘সময়মতো নামাজ পড়া। তিনি আবার প্রশ্ন করলেন, এরপর কোন কাজটি সর্বাধিক প্রিয়? রাসুল (সা.) বললেন, বাবা-মায়ের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা।’ (বোখারি, হাদিস : ১/৭৬)
এ হাদিসের মাধ্যমে প্রতীয়মান হয়দীনের অন্যতম স্তম্ভ নামাজের পর আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয় কাজ হলো বাবা-মায়ের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা।
অনেকে ধারণা করে থাকে, বাবা-মায়ের আনুগত্য ও সদ্ব্যবহারের জন্য তাদের অত্যন্ত নেককার ও সৎ ব্যক্তি হতে হবে, এমন ধারণা আদৌ ঠিক নয়। এমনকি যদি কারও বাবা-মা অমুসলিম হয়, তাহলেও তাদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করতে ইসলাম জোর নির্দেশ দিয়েছে।
এ ব্যাপারে ইমাম বোখারি (রহ.) একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। আসমা বিনতে আবু বকর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমার মা অমুসলিম অবস্থায় আমার কাছে এলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, আল্লাহর রাসুল! আমার মা আমার কাছে দেখা করতে আসেন, আমি কি তার সঙ্গে সদাচরণ করতে পারব? রাসুল (সা.) বললেন, হ্যাঁ! তার সঙ্গে অবশ্যই সদ্ব্যবহার করো।’ (বোখারি, হাদিস : ২/৮৮৪)
ইসলামে বাবা-মায়ের খেদমত ও তাদের সঙ্গে সদ্ব্যবহারের গুরুত্ব এত বেশি যে, জিহাদ বা সংগ্রাম ফরজে কেফায়ার স্তরে থাকা পর্যন্ত বাবা-মায়ের অনুমতি ছাড়া সন্তানের জন্য জিহাদে অংশগ্রহণ করা জায়েজ নয়।
বোখারি শরিফে আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, একজন ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলেন, আমি জিহাদে অংশ নিতে চাই, রাসুল (সা.) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বাবা-মা কি জীবিত আছেন? সে বলল, হ্যাঁ! রাসুল (সা.) বললেন, তাহলে তুমি বাবা-মায়ের সেবাযতেœ আত্মনিয়োগ করো।’ (বোখারি, হাদিস : ৮৮৩)
পুরো জীবন-যৌবন ব্যয় করে যারা সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়েন, তাদের অনেকেই এককালে ভীষণ একা ও অপাঙ্ক্তেয় হয়ে পড়েন। সন্তানের অবহেলা, অবজ্ঞা ও অযতœ তাদের চরম কষ্টে ফেলে দেয়। বিষাদক্লিষ্টতা ও দুঃখভরা মনে দিন অতিবাহিত করতে হয়। অথচ ইসলামের শিক্ষা হলো, সন্তানের অসহায়ত্বের সময় যেভাবে বাবা-মা তাকে স্নেহভরে সযত্নে প্রতিপালন করেছেন, বাবা-মায়ের অসহায়ত্ব বা বৃদ্ধাবস্থায় তাদের সেভাবে লালন-পালন করা সন্তানের অবশ্য কর্তব্য।
এই মহৎ দায়িত্ব পালনে অবহেলা করা অমানবিক, ইসলামবহির্ভূত ও সভ্যতাবিবর্জিত কাজ। যারা এমন কাজ করে তাদের কোথাও ক্ষমা নেই। এমন কাজের কারণে পরকালে কঠিন শাস্তি পেতে হবে। দুনিয়াতেও নিজের বার্ধক্যকালে আরও চরম পরিণতি ভোগ করতে হবে।
ইসলাম বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন ও সর্বস্তরের প্রবীণদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও তাদের অসহায়ত্বের সময় সেবাযতœ করার তাগিদ দিয়েছে। একজন সুস্থ বিবেক ও মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন মানুষ তার বৃদ্ধ বাবা-মা এবং তার আত্মীয়-পরিজন ও অন্য প্রবীণদের কখনো অবহেলা বা উপেক্ষা করতে পারে না।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন