মানব চরিত্রের উৎকর্ষ সাধনই শান্তি ও মানবতার ধর্ম ইসলামের মূল লক্ষ্য। আর মানব চরিত্রের উত্তম গুণাবলির অন্যতম হলো ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা। পবিত্র কুরআনে একাধিক স্থানে মহান আলস্নাহ নিজেকে ধৈর্যশীল ও পরম সহিষ্ণু হিসেবে পরিচয় প্রদান করেছেন।
সহিষ্ণুতা সম্পর্কে মহাগ্রন্থ আল কুরআনুল কারিমে আলস্নাহ তাআলা বলেন, 'ওয়া ইন্নালস্নাহা লাআলিমুন হালিম' অর্থাৎ...এবং আলস্নাহই তো সম্যক প্রজ্ঞাময়, পরম সহনশীল। (পারা: ১৭, সুরা-২২ হজ, আয়াত: ৫৯)। ছবর, অর্থাৎ ধৈর্য সম্পর্কে কুরআন মজিদে আলস্নাহ তাআলা বলেন, 'ইন্না ওয়াজাদনাহু ছাবিরা; নিমাল আবদু, ইন্নাহু আউওয়াব'। অর্থ: আমি তো তাকে পেলাম ধৈর্যশীল। কত উত্তম বান্দা সে! সে ছিল আমার অভিমুখী। (পারা: ২৩, সুরা-৩৮ সাদ, আয়াত: ৪৪)। 'ইন্না ফি জালিকা লাআতিল লিকুলিস্ন ছব্বারিন শাকুর' অর্থ: নিশ্চয় এতে তো নিদর্শন রয়েছে প্রত্যেক পরম ধৈর্যশীল ও পরম কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য। (পারা: ১৩, সূরা-১৪ ইব্রাহিম, আয়াত: ৫)।
পবিত্র কুরআনে আর কিছু আয়াত রয়েছে যা আমাদের জীবনের সব দুঃখ, কষ্ট, ভয় হাসিমুখে পার করার শক্তি জোগায়। এ রকম একটি আয়াত হলো- 'অবশ্যই তোমাদের কিছু না কিছু দিয়ে পরীক্ষায় ফেলবই: মাঝেমধ্যে তোমাদের বিপদের আতঙ্ক, ক্ষুধার কষ্ট দিয়ে, সম্পদ, জীবন, পণ্য-ফল-ফসল হারানোর মধ্য দিয়ে। আর যারা কষ্টের মধ্যেও ধৈর্য-নিষ্ঠার সাথে চেষ্টা করে, তাদের সুখবর দাও। [আল-বাকারাহ ১৫৫]
আল-বাকারাহর এই আয়াতে আলস্নাহ আমাদের জীবনের সকল বিপদ-আপদ, দুঃখ, হতাশাকে হাসিমুখে পার করার জন্য এক বিরাট মন্ত্র শিখিয়ে দিয়েছেন। অপর এক আয়াতে বলা হয়েছে, 'ধৈর্য-নিষ্ঠার সাথে চেষ্টা করো এবং সালাতের মাধ্যমে সাহায্য চাও। যারা ধৈর্য-নিষ্ঠার সাথে চেষ্টা করে, আলস্নাহ অবশ্যই তাদের সাথে আছেন। [আল-বাকারাহ ১৫৩]
তবে সবর মানে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা নয়। সবর এর অর্থ হচ্ছে: প্রতিকূলতার মধ্যে ধৈর্য নিয়ে, লক্ষ্য ঠিক রেখে, অবস্থার পরিবর্তনের জন্য সুযোগের অপেক্ষা করা। [৫] সবরের তিনটি অংশ রয়েছে: ১. ধৈর্যের সাথে কষ্ট, দুর্ভোগ সহ্য করা, ২. অবস্থার পরিবর্তন করতে গিয়ে কোনো পাপ করে না ফেলা, ৩. আলস্নাহর আনুগত্য থেকে সরে না যাওয়া। তবে মানুষ সাধারণত 'সবর' বলতে প্রথমটিকেই বুঝে থাকে। কিন্তু একজন মুসলিমের জন্য এই তিনটিই বাধ্যতামূলক। এই তিনটির একটি যদি বাদ যায়, তাহলে তা কুরআন এবং হাদিসের ভাষায় সবর নয়।
ধৈর্যের গুরুত্ব সম্পর্কে মহান আলস্নাহ পবিত্র কুরআন মজিদে বলেছেন, 'মহাকালের শপথ, মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত; কিন্তু তারা নয়, যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয় ও ধৈর্যের উপদেশ দেয়। (পারা: ৩০, সূরা-১০৩ আসর, আয়াত: ১-৩)। এই সূরার শেষে আলস্নাহ ধৈর্যকে সাফল্যের নিয়ামকরূপে বর্ণনা করেছেন।
আলস্নাহ তাআলা বলেছেন, 'ইয়া আইয়ুহালস্নাজিনা আমানুছবিরু ওয়া ছাবিরু ওয়া রাবিতু; ওয়াত্তাকুলস্নাহা লাআলস্নাহুম তুফলিহুন' অর্থ: হে ইমানদারগণ! তোমরা ধৈর্য ধারণ করো, ধৈর্যের প্রতিযোগিতা করো এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকো। আলস্নাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো। (পারা: ৪, সূরা-৩ আলে ইমরান, আয়াত: ২০০)।
ধৈর্য ধারণকারীর সাফল্য সুনিশ্চিত, কারণ আলস্নাহ তাআলা ধৈর্য ধারণকারীর সঙ্গে থাকেন; আর আলস্নাহ রাব্বুল আলামিন যার সঙ্গে থাকবেন, তার সফলতা অবধারিত। কুরআনুল কারিমে আলস্নাহ তাআলা বলেন, 'ইয়া আইয়ুহালস্নাজিনা আমানুছতাঈনু বিছছবরি ওয়াছ ছলাতি; ইন্নালস্নাহা মাআছ ছাবিরিন।' অর্থ: হে মুমিনগণ! ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে তোমরা সাহায্য প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই আলস্নাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন। (পারা: ২, সূরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৫৩)।
ধৈর্য মানবজীবনে পরীক্ষাস্বরূপ। আলস্নাহ রাব্বুল ইজ্জাত কোরআনুল আজিমে বলেন, 'তাবারকালস্নাজি বিইয়াদিহিল মুলকু ওয়া হুওয়া আলা কুলিস্ন শাইয়িন কদির। আলস্নাজি খলাকাল মাওতা ওয়াল হায়াতা, লিইয়াবলুওয়াকুম আইয়ুকুম আহ্ছানু আমালা; ওয়া হুওয়াল আজিজুল গফুর।' অর্থ: মহামহিমান্বিত তিনি সর্বময় কর্তৃত্ব যার করায়ত্ত; তিনি সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান। যিনি সৃষ্টি করেছেন মৃতু্য ও জীবন, তোমাদিগকে পরীক্ষা করার জন্য। কে তোমাদের মধ্যে কর্মে উত্তম? তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল। (পারা: ২৯, সূরা-৬৭ মুলক, আয়াত: ১-২)।
হাদিস শরিফে আছে, যে ব্যক্তি বিপদে-মুসিবতে আলস্নাহর ওপর পূর্ণ আস্থা রাখবেন, আলস্নাহ তাআলা তার বিপদ দূর করবেন এবং তার যা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার চেয়ে উত্তম জিনিস তাকে দান করবেন। (বুখারি ও মুসলিম)। ধৈর্যের মূর্ত প্রতীক হজরত আইয়ুব (আ.) ১৮ বছর পর্যন্ত সহিষ্ণুতার চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে পরম সাফল্য লাভ করেছিলেন। নবী হজরত ইউনুস (আ.)কে সামান্য অধৈর্য হওয়ার কারণে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ রাতের আঁধারে উত্তাল সমুদ্রবক্ষে হিংস্র মাছের উদরে যেতে হয়েছিল। এ প্রসঙ্গ উলেস্নখ করে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)কে উদ্দেশ করে কুরআন কারিমে আলস্নাহ তাআলা বলেন, 'ফাছবির লিহুকমি রব্বিকা ওয়া লা তাকুন কাছাহিবিল হুত, ইজ নাদা ওয়া হুওয়া মাকজুম।' অর্থ: অতএব, তুমি ধৈর্য ধারণ করো তোমার প্রতিপালকের নির্দেশের অপেক্ষায়, তুমি মৎস্য-সহচরের (ইউনুস আলাইহিস সালাম) ন্যায় অধৈর্য হয়ো না, সে বিষাদ আচ্ছন্ন অবস্থায় কাতর প্রার্থনা করেছিল। (পারা: ২৯, সূরা-৬৮ কলম, আয়াত: ৪৮)।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন