জলবায়ুর অভিঘাত মোকাবিলায় ক্লাইমেট রেসিলিয়েন্ট পার্টিসিপেটরি অ্যাফরেস্টেশন অ্যান্ড রিফরেস্টেশন প্রজেক্ট (সিআরপিএআরপি) নিয়েছে সরকার। এতে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু সহিষ্ণু প্রজাতি গাছ দিয়ে বনায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু এর সুফল মেলেনি। এ সংক্রান্ত অনিয়ম নিয়ে বাংলা ট্রিবিউনের সিনিয়র রিপোর্টার শাহেদ শফিকের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে দ্বিতীয় পর্ব।
জলবায়ুর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে বনায়ন প্রকল্পে উপকারভোগী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে প্রভাবশালীদের নাম। সিআরপিএআরপি অংশগ্রহণমূলক বনায়নে এমনটা ঘটেছে।
প্রকল্প সূত্র জানিয়েছে, সিআরপিএআরপি প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল বিকল্প জীবিকায়নের মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বনের ওপর নির্ভরতা কমানো এবং বনের স্থায়ীত্ব বাড়ানো।
এক্ষেত্রে উপকারভোগী হওয়ার শর্ত ছিল পারিবারিক আয়ের ৬০ শতাংশের বেশি বন থেকে আসতে হবে এবং তার কর্মসময়ের ৬০ ভাগের বেশি বনেই থাকতে হবে।
বাংলা ট্রিবিউনের হাতে আসা নথিতে দেখা গেছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উপকারভোগী নির্বাচনে এসব শর্ত মানা হয়নি। নির্বাচিতদের হাতেগোনা কয়েকজন জ্বালানি কাঠ সংগ্রহের জন্য বনে যাচ্ছেন এবং প্রায় ৮৫ ভাগ পরিবার তাদের পারিবারিক আয়ের জন্য কখনও বনের উপর নির্ভরশীল ছিল না।
অনেক ক্ষেত্রেই স্থানীয় সরকারের সদস্য, তাদের স্বজন ও প্রভাবশালীদের সামাজিক বনায়নের উপকারভোগী নির্বাচন করা হয়েছে। এনিয়ে একটি অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদন তৈরি করে বন অধিদফতর।
ভোলার চর কুকরিমুকরি, পটুয়াখালীর গঙ্গামতি, চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের করেরহাট ও বালুখালি, চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের বরদুয়ারা ও ডলু এবং কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের অধীন মানিকপুর, নাপিতখালি ও কচ্চপিয়াসহ বন অধিদফতরের আরও কিছু বীট ও রেঞ্জ অফিস সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখা গেছে গেছে, উপকারভোগীদের একটি বড় অংশ আর্থিকভাবে সচ্ছল। এদের মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বারসহ কয়েক একর জমির মালিকও রয়েছেন।
জলবায়ুর কারণে স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগ, আরণ্যক ফাউন্ডেশন তাদের বাদ দিয়ে এলাকার প্রভাবশালী, রাজনৈতিক ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের দিয়েই উপকারভোগীর তালিকা করেছে।
অভিযোগের স্বীকারোক্তি পাওয়া গেছে আরণ্যকের লিখিত জবাবেও। তবে প্রতিষ্ঠানটির দাবি, বন বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করেই তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে।
আরণ্যক অডিট বিভাগকে জানিয়েছে, পরিস্থিতির বিবেচনায় এলাকার প্রভাবশালী লোকদের সামাজিক বনায়নের অংশীদার করা হয়েছে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সামাজিক বনায়ন বিধিমালা অনুসরণ করা হয়েছে বলেও দাবি তাদের।
ফাউন্ডেশনের এই জবাব গ্রহণ করেনি অডিট অধিদফতর। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, উপকারভোগী হিসেবে সমাজের প্রভাবশালীদের অন্তর্ভুক্ত করায় অংশগ্রহণমূলক বনায়নের মাধ্যমে স্থানীয় অস্বচ্ছল জনগণ, নারী ও ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর লোকদের সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্দেশ্য ফলপ্রসূ হয়নি।
ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক রকিবুল হাসান মুকুল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এ অভিযোগ যথাযথ হয়নি। আমরা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষের কাছে জবাব পাঠাচ্ছি।
জানতে চাইলে বন অধিদফতরের পরিকল্পনা উইং-এর উপপ্রধান বন সংরক্ষক মো. জগলুল হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এটি আমরা করিনি। আরণ্যক করেছে।
অংশগ্রহণ ১৫ শতাংশ
বনবিভাগের জরিপের ফলাফল অডিট বিভাগের পর্যালোচনায় দেখা যায়, উপকারভোগীদের ৮৫ ভাগ আয়ের জন্য কখনও বনের ওপর নির্ভরশীল ছিল না। প্রকল্প শুরুর আগে এরা অন্য পেশায় নিযুক্ত ছিল। প্রকল্প সমাপ্তিতে সংখ্যাটা ৯০ ভাগ হয়। অর্থাৎ বিকল্প জীবিকায়ন কর্মসূচি ভূমিকা রাখতে পারেনি বলে জানতে পেরেছে সরকারের অডিট বিভাগ।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, যারা সুবিধাবঞ্চিত তাদের উপকারের জন্য যে প্রকল্পগুলো নেওয়া হয় সবগুলোতেই কিন্তু এটা একটা স্বাভাবিক চিত্র।
প্রকল্প থেকে বহুদূর!
প্রকল্পের আওতায় বাফার জোন বা ‘নিরাপদ অঞ্চল’ ও কোর জোন বা ‘মূল অঞ্চল’ বনায়ন করা হয়। ‘বাফার জোন’ বনায়নের করতে হয় ক্ষতিগ্রস্তদের নাগালে। ‘কোর জোন’ হতে হয় নাগালের বাইরে। কিন্তু চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী ও পটুয়াখালীসহ উপকূলীয় অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় বাস্তবায়িত প্রকল্পে এই নির্দেশনা মানা হয়নি।
কোর জোন বনায়নে দীর্ঘ আবর্তনের বৃক্ষ রোপণ করা হয়। যেখানে সাধারণত স্থানীয় বননির্ভর জনগণের অংশগ্রহণ থাকে না।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের পাদুয়া রেঞ্জের বরদুয়ারা বীটের আওতায় ২০১৪-২০১৫ সালে এমন এক পাহাড়ি সাইটে ১০০ হেক্টর ‘বাফার জোন’ বনায়ন করা হয়েছে যা জনবসতি হতে বেশ দূরে।
একই বিট-এর আওতায় ২০১৫-২০১৬ সনে ন্যাড়াকৃত পাহাড়ি সাইটে ৫০ হেক্টর ‘বাফার জোন’ বনায়ন করা হয়েছে। সেটাও জনবসতি হতে দূরে।
বন বিভাগ জানিয়েছে, সৃজিত বাফার জোনের চারপাশ ঘিরে রয়েছে চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগ এবং বান্দরবান জেলার ‘সংরক্ষিত বনাঞ্চল’ এবং ২০১০-২০১১ সালে সৃজিত আগর বাগান। প্রকল্পের প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশন ম্যানুয়াল (পিআইএম) অনুসারে বর্ণিত দুটি সাইটেই ‘বাফার জোন’ এর পরিবর্তে দীর্ঘমেয়াদি প্রজাতির বৃক্ষ দিয়ে ‘কোর জোন’ বনায়ন সৃজন করা উচিত ছিল বলে বনবিভাগের এক নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
আবার, কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের ধোয়াপালং রেঞ্জের ধোয়াপালং সদর বিটের আওতায় ২০১৩-২০১৪ সালে ৪০ হেক্টর ‘বাফার জোন’ বনায়ন করা হয়েছে। এটি জনবসতি হতে প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরে। একইভাবে, দক্ষিণ বন বিভাগের টেকনাফ সদর বিটের আওতায় ২০১৩-২০১৪ সালে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় ৫০ হেক্টর ‘বাফার জোন’ বনায়ন করা হয়। সেখানেও জনমানুষের প্রবেশ কষ্টসাধ্য।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পটুয়াখালী উপকূলীয় বন বিভাগের চর মোন্তাজ রেঞ্জের অধীন সোনারচর জনবসতিহীন। এর বনাঞ্চলও সংরক্ষিত। এই বনাঞ্চল ঘেঁষে প্রকল্পের আওতায় ঝাউ, গোলপাতা এবং মাউন্ড বনায়ন করা হয়েছে।
পিআইএম’র নির্দেশনা মোতাবেক উপকূলীয় ঝাউ বনায়নে উপকারভোগী বা অংশীদারের সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ নেই।
প্রকল্পের আওতায় সৃজিত কোনও ঝাউ বনায়ন কর্তনযোগ্যও নয়। অথচ সোনারচরসহ পটুয়াখালী উপকূলীয় বন বিভাগের আওতায় সৃজিত প্রায় সকল ঝাউ বনায়নেই বিভিন্ন উপকারভোগীদের সাথে অংশীদারিত্বমূলক চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে।
সামাজিক বনায়নের আওতাধীন হওয়ায় স্বল্পমেয়াদে এই বন কর্তনযোগ্য। যা সংরক্ষিত বনায়ন নীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এর ফলে এই বনায়নের দ্বারা দীর্ঘমেয়াদি জলবায়ু অভিযোজন সুবিধা অর্জনের সম্ভাবনাও নেই।
বন অধিদফতরের পরিকল্পনা উইংয়ের উপপ্রধান বন সংরক্ষক মো. জগলুল হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বনবিভাগে এখন পর্যন্ত বাফার জোন ও কোর জোন নির্ধারণ করা হয়নি। ৪৯টি প্রোটেকটেড এরিয়া রয়েছে। বিষয়টি নির্ধারণ করেছে আরণ্যক ফাউন্ডেশন। বিস্তারিত তারাই বলতে পারবে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালযয়ের উপমন্ত্রী বেগম হাবিবুন নাহার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সমীক্ষা ছাড়া কোনও প্রকল্প গ্রহণ করা হবে না। আমাদের কিছু কর্মকর্তা চাকরি ছেড়ে দেবে, কিন্তু পোস্টিং ছাড়বে না। এখানে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বেশি প্রভাব ফেলে। এসব কারণেই দুর্নীতি হচ্ছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন