এত দীর্ঘস্থায়ী ঝড় এর আগে দেখেননি যশোরের মানুষ। আট ঘণ্টাব্যাপী বয়ে যাওয়া ঝড়ের কারণে কার্যত লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় গোটা যশোর। প্রলয়ঙ্করী ঝড়ের কবলে পড়ে জেলায় ৫ জনের প্রাণহানী হয়েছে। আহত হয়েছেন অন্তত ৫০ জন।
হতাহতের পাশাপাশি মানুষের ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, গাছপালা সব ধ্বংস করে দেয় আম্পান। মাছ-সবজি, আম, লিচু, পানের বরজসহ কৃষির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বৈদ্যুতিক তারের ওপর গাছ আছড়ে পড়ে পুরো জেলা বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
বুধবার সন্ধ্যা ৬টা ৪০ মিনিট থেকে শুরু হয় আম্পানের প্রভাবে ঝড় ও বৃষ্টি। রাত ১০টা থেকে এর তীব্রতা বাড়তে থাকে। যশোর বিমান বন্দর নিয়ন্ত্রিত আবহাওয়া অফিস থেকে জানা যায়, ১০টায় ঝড়ের গতিবেগ ছিল প্রতি ঘণ্টায় ১০৪ কিলোমিটার, রাত ১২টায় তীব্রতা বেড়ে হয় ১৩৫ কিলোমিটার। রাত পৌনে ২ টায় ঝড়ের গতিবেগ কিছুটা স্থিমিত হয়।
বৃহস্পতিবার সকালেও ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে চলে মৃদু বৃষ্টি। ঝড়ের এ তীব্রতায় গোটা জেলায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ভূক্তভোগীরা বলেন, সিডর, বুলবুলসহ বাংলাদেশে প্রলয়ঙ্কারী যে কয়টি ঝড় হয়েছে তার প্রভাবও যশোরে এমনটা পড়েনি। যেমনটা আম্পান দেখিয়েছে।
এদিকে সুপার সাইক্লোন আম্পানের প্রভাবে যশোরে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। ঝড়ের মধ্যে চৌগাছা উপজেলার চাঁদপুর গ্রামে ঘরের উপর গাছ ভেঙে পড়ে এক মা ও তার শিশু কন্যা নিহত হয়েছে। শার্শা ও বাঘারপাড়া উপজেলায় মুত্যু হয়েছে আনো তিনজনের।
চৌগাছার স্থানীয় ইউপি সদস্য শাহিনুর রহমান জানান, রাত ১০টার পর একটি জাম গাছ ভেঙে পড়ে তাদের ঘরের ওপর। এ সময় ঘটনাস্থলে মা খ্যান্ত বেগম (৪৫) ও মেয়ে রাবেয়া (১৩) নিহত হয়। এ সময় খ্যান্ত বেগমের ছেলে আল-আমিন (২২) আহত হয়।
একই রাতে ঝড়ে ঘরের ওপর গাছ ভেঙ্গে পড়ে বাঘারপাড়ার বুধোপুরে ডলি বেগম (৪৮) নামে এক নারী ও শার্শায় আলাদাভাবে দুইজন মারা গেছেন। তারা হচ্ছেন বাগআঁচড়া ইউনিয়নের টেংরা গ্রামের মুক্তার আলী ও গোগা পশ্চিমপাড়ার ময়না বেগম (৩৮)।
এ ছাড়া বিভিন্ন উপজেলায় অর্ধশত আহত হয়েছেন। এর মধ্যে বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার সদর হাসপাতাল পর্যন্ত তিন শিশুসহ চিকিৎসা নিয়েছে ১১ জন।
ঝড়ে হতাহতের পাশাপাশি ফসলেরও ব্যাপক ক্ষতি করেছে।
জেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, মাত্র কয়েকদিন আগেই জেলার বোরো আবাদ ঘরে তুলেছেন কৃষক। যে কারণে ঝড়ে বোরো ধানের কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। তবে সবজি, পাট, পান, আম, লিচুসহ বিভিন্ন ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হেেয়ছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোরের উপপরিচালক কৃষিবিদ ড. আকতারুজ্জামান বলেন, দীর্ঘস্থায়ী ঝড়ের কারণে যশোরের ফসলের ক্ষতি বেশি হয়েছে।
তিনি বলেন, এর আগে এ অঞ্চলে ঝড় বয়ে গেলেও এত সময় আর চলেনি। যে কারণে ক্ষতি হয়েছে বেশি।
তিনি বলেন, ইতিমধ্যে আমরা জেলার ক্ষতির বিষয়টি চিহ্নিত করে এর পুরো তথ্য কৃষি মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসনের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ফসলের মধ্যে রয়েছে ১১৭৮৩ হেক্টর পাট আবাদ, সবজি ১১৭৪৮ হেক্টর যা মোট আবাদের ৮০ শতাংশ, ৭৫০ হেক্টর পেঁপে ক্ষেত, ১৫০০ হেক্টর কলা ক্ষেত, ৬৭৫ হেক্টর মরিচ ক্ষেত, ১০৪৫ হেক্টর মুলা ক্ষেত, ৩ হাজার ৩৯৫ হেক্টর আম, ৬০০ হেক্টর লিচু ও ১০০০ হেক্টর পানের বরজ। এসব ফসলের মোট আবাদের ৭০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে তিনি জানান।
এ ছাড়া জেলার নিম্নাঞ্চল কেশবপুর-মনিরামপুরের ভবদহ এলাকায় পানিতে তলিয়ে গেছে শত শত হেক্টর জমির ফসল। ভেসে গেছে ঘেরের মাছ।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আনিসুর রহমান বলেন, ঝড়ের সঙ্গে ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে যশোরের কেশবপুর, মনিরামপুরের নিম্নাঞ্চলের কিছু ঘের ও পুকুর ভেসে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে অন্যান্য এলাকায় মাছের তেমন ক্ষতি হয়নি।
ঝড়ের কারণে গাছপালা ভেঙে জেলার অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। যশোর বেনাপোল সড়কের শতবর্ষী প্রাচীন গাছগুলো ভেঙে রাস্তার ওপর পড়ায় দুপুর পর্যন্ত ওই সড়কের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিলো।
যশোর-খুলনা মহাসড়, যশোর-মাগুরা সড়ক, ঝিনাইদহ সড়কসহ অধিকাংশ সড়কের ওপর গাছ ভেঙে পড়ে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ফায়ার ডিফেন্সের কর্মীরা এসব গাছ সরিয়ে নেয়ার জন্য কাজ করেন।
এ ছাড়া ঝড়ে বিদ্যুতের ব্যাপক ক্ষতি করে। বিদ্যুতের তারের ওপর গাছ ও ডাল ভেঙে পড়ায় গোটা জেলায় বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ১০ ঘন্টা বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন থাকার পর কিছু কিছু এলাকায় সংযোগ দেওয়া হলেও দুই তৃতীয়াংশ এলাকা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে বলে বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
জেলা প্রশাসক শফিউল আরিফ জানান, সমগ্র জেলার ক্ষতি এখনও নিরুপণ সম্ভব হয়নি। কাজ চলছে। তবে ঘর বাড়ি গাছ ভেঙে মানুষের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তিনি বলেন, ঝড়ের কারণে যেসব মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে তাদের তালিকা প্রস্তুতের কাজ করা হচ্ছে। তালিকা প্রস্তুত শেষে এসব মানুষকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেওয়া হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন