ঘরে গাছপালা লাগানো মন এবং ভালো থাকার ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে বলে মনে করা হয়। হয়তো সেগুলোর ছবি ইন্সটাগ্রামে অনেক লাইক এনে দেয়।
কিন্তু এগুলো পরিবেশের জন্য কতটা কতটা উপকারী? খবর বিবিসি বাংলার
চারাগাছ উৎপাদন থেকে শুরু করে, পুনরায় ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের পট তৈরিসহ ব্রিটেনের উদ্যানবিদ, উদ্ভিদবিদ এবং পরিবেশবিদরা আপনার এই উদ্যানের শখ টিকিয়ে রাখার জন্য নানা কাজ করে যাচ্ছেন।
বাসায় ছোট বাগান করা প্রবণতা বাড়ছে বলে জানিয়েছে রয়্যাল হর্টিকালচারাল সোসাইটি (আরএইচএস), যা ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালের শেষ ছয়মাসে প্রায় ৬০শতাংশ বেড়েছে।
এই প্রবণতাকে পরিবেশ বান্ধব এবং স্বাস্থ্য সচেতনতার সহস্রাব্দ বলে মনে করা হয়, যারা তাদের শহরের ছোট বাসায় সবুজ তৈরির চেষ্টা করছেন এবং ক্রমবর্ধমান ডিজিটাল যুগে কিছু 'বাস্তব' লালন-পালন করছেন।
যুক্তরাজ্যে প্রতি ১৬ থেকে ২৪ বছরের পাঁচজন ব্যক্তির মধ্যে অন্তত চারজনের বাসায় কোন একটি গাছ রয়েছে।
তাদের মধ্যে অন্তত এক পঞ্চমাংশ গাছ কিনেছেন তাদের স্বাস্থ্য ও ভালো থাকার কথা চিন্তা করে বলে আরএইচএসের জরিপে বেলিয়ে এসেছে।
প্ল্যান্ট মাইলস
গাছ নিয়ে মানুষের আগ্রহ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, বেশ কিছু অনলাইন খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান এখন একেবারে বাড়িতে গাছপালা পৌঁছে দিচ্ছে।
লন্ডনের সবচেয়ে বড় অনলাইন গাছ বিক্রেতা দাবি করা প্যাচ এদের মধ্যে অন্যতম।
তারা তাদের গাছগুলোকে ডাক নাম দেয় যেমন চ্যাজ অথবা বিগ কেন, যাদেরকে তাদের সম্ভাব্য গাছের পিতামাতার কাছে দিয়ে দেয়া হবে।
প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফ্রেডি ব্লাকেট বলছেন, গাছ মানুষের মধ্যে শান্তি, আনন্দ আর স্বাচ্ছন্দ্য এনে দিতে পারে।
প্যাচের গাছ এবং উদ্ভিদগুলো নেদারল্যান্ডসে জন্মানো হয়। এরপরে গাছ সরবরাহের আদেশ পাওয়ার পর সেগুলো যুক্তরাজ্যে নিয়ে আসা হয়। ফলে অতিরিক্ত গাছ আমদানি হয় না।
কিন্তু এর ফলে প্লান্ট মাইলস তৈরি হতে পারে বলে বলছেন ফে কেনওয়ার্থি, প্ল্যান্টসোয়াপ নামের একটি প্রতিষ্ঠানে সহ-প্রতিষ্ঠাতা, যারা স্থানীয়ভাবে গাছপালা হাতবদলের জন্য উৎসাহিত করে থাকে।
যেহেতু অনেক গাছ বিদেশ থেকে নিয়ে আসা হয়, তাদের পরিবহনের সময় অনেক ইকোলজিক্যাল ফুটপ্রিন্ট তৈরি হতে পারে।
যদিও বেশিরভাগ গাছপালা নেদারল্যান্ডস থেকে আসে, কিন্তু অর্কিড আসে ইন্দোনেশিয়া থেকে এবং হালকা রঙের কিছু গাছ আসে কেনিয়া এবং জিম্বাবুয়ে থেকে।
আমার অনেকেই পরিবেশ রক্ষা করার জন্য আন্তর্জাতিক ভ্রমণ কমিয়েছি, কিন্তু আপনারা গাছপালা এখনো বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে শিপিং করা হচ্ছে।
তবে উদ্যান বিজ্ঞানী এবং বিবিসির উপস্থাপক জেমস ওয়াঙের কাছে এভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে গাছ পাঠানোর বিষয়টি কোন উদ্বেগের বিষয় নয়। তার বাসায় পাঁচশো উদ্ভিদ বা গাছপালা রয়েছে।
তিনি বলেন, আপনি যখন কোন গাছের জন্য চাহিদা জানাবেন, তখন কোন উদ্যানে যাওয়ার চেয়ে আপনি অনেক কম কার্বন ফুটপ্রিন্ট রাখবেন, কারণ এসব গাছের আকার খুবই ছোট।
তিনি যুক্তি দিয়ে বলেন, গাড়িতে করে কোন উদ্যানে যাওয়ার চেয়ে একবার বাসায় গাছ সরবরাহে পরিবেশগত প্রভাব অনেক কম পড়ে।
আর বিশেষ করে যুক্তরাজ্যের অনেক ক্রেতা ব্রিটেনের সরবরাহকারীদের তুলনায় আমস্টারডামের কাছাকাছি বসবাস করেন।
তিনি বলেন, উষ্ণ জলবায়ুর মধ্যে গাছ উৎপন্ন করে যুক্তরাজ্যে পাঠানো হলে যুক্তরাজ্যের কাছাকাছি আর কোন গ্রিনহাউজ তৈরির প্রয়োজন পড়বে না।
সেই সঙ্গে তিনি বলছেন, যেসব গাছের চাহিদা নেই, অথবা কলম তৈরি করা অথবা বীজ থেকে গাছ উৎপন্ন করা সবসময়েই বাসাবাড়িতে যারা গাছের বাগান করেন, তাদের জন্য ভালো বিকল্প হতে পারে।
মিজ কেনওয়ার্থি বলছেন, পাশাপাশি এতে নতুন গাছের সঙ্গে আসা অতিরিক্ত প্যাকেজিং করার বিষয়টি এড়ানো যেতে পারে- কারণ প্যাকেট করার জন্য প্লাস্টিকের হাঁড়ি ব্যবহার করা হয়।
প্লাস্টিকের হাঁড়ি
প্লাস্টিক বিরোধী প্রচারণা কর্মী অ্যামি মার্ক বলছেন, পুনরায় ব্যবহার করার ক্ষেত্রে এসব প্লাস্টিকের পট বা হাঁড়ি দুঃস্বপ্ন হয়ে দেখা দিতে পারে।
ওয়েস্ট এন্ড রিসোর্স অ্যাকশন প্রোগ্রামের (ডব্লিউআরএপি) বিশ্লেষণ অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যের মাত্র ১০ শতাংশ স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এসব প্লাস্টিকের হাঁড়ি গ্রহণ করে থাকে।
অনেক সময় এগুলো সংগ্রহ করা হয় না, কারণ এগুলো বিষাক্ত বলে মনে করা হয়।
আবার অনেক ক্ষেত্রে এসব হাঁড়ি তৈরি হয় কালো প্লাস্টিক দিয়ে, যা পুনঃপ্রক্রিয়া করার কেন্দ্রে বাছাই মেশিনগুলো সনাক্ত করতে পারে না। ফলে সেগুলোর ঠাই হয় ভাগাড়ে।
এমনকি অনেক স্থানীয় কর্তৃপক্ষ কালো নয়, এমন গাছের হাঁড়িগুলোও নিতে চায় না। ফলে সহজে পুনঃ ব্যবহার করা যায় এমন হাঁড়ি বা পচন উপযোগী হাঁড়ি তৈরির প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছে।
ফলে এখন হর্টিকালচারাল ট্রেড অ্যাসোসিয়েশন এবং আরএইচএস গার্ডেন অনেক সময় গাছের পটগুলো পুনঃব্যবহার অথবা ফিরিয়ে নেয়ার প্রকল্প চালু করেছে।
কিডস অ্যাগেইনস্ট প্লাস্টিক নামের একটি দাতব্য সংস্থা পরিচালনা করেন মিক, তার ছোট বোন এলাকে নিয়ে।
তিনি পরামর্শ দিচ্ছেন যে, মানুষ যেন গাছ কেনার সময় সেটির হাঁড়ি নিয়ে প্রশ্ন করেন যে, এটা কি আবার ব্যবহার করা যাবে? অথবা এমন কোন জায়গা কি আছে যেখানে পরিবেশ উপযোগী হাঁড়ি পাওয়া যাবে?
পিট শৈবাল রক্ষা
ঘরে পরিবেশ সম্মত গাছ লাগানোর ক্ষেত্রে সেটি কীভাবে সরবরাহ করা হয়েছে, শুধু এটাই গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং সেখানে কী জন্মানো হচ্ছে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ।
উদ্ভিদবিদ ড.ট্রেভর ডাইনসের মধ্যে প্রধান সমস্যা হলো জীব সারের মধ্যে পিট শৈবাল ব্যবহার করা।
যুক্তরাজ্যের জলাবদ্ধ অঞ্চলে পাওয়া মাটির পদার্থটি পচনশীল উদ্ভিদের পদার্থ দ্বারা তৈরি এবং এটি হতে হাজার হাজার বছর সময় নিতে পারে।
সংরক্ষণ বিষয়ক ব্রিটিশ দাতব্য সংস্থা প্লান্টলাইফের কর্মকর্তা ড. ডাইনস বাণিজ্যিকভাবে এগুলো উত্তোলন শুরু হলে পাঁচশো বছর ধরে তৈরি হওয়া এসব পদার্থ এক বছরেই শেষ হয়ে যেতে পারে।
তার পরামর্শ, গাছ কেনার সময় মানুষের দেখা উচিত সেখানে মাটি বা সার হিসাবে কী ব্যবহৃত হচ্ছে। অথবা অর্কিড বা ক্যাটটাসের মতো এমন গাছ কেনা, যার জন্য এরকম পিট শৈবাল ব্যবহার করা হয়না।
ঘরের গাছ কি বাতাস পরিষ্কার করে?
গাছ কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে আর অক্সিজেন নির্গত করে, এর মানেই এই নয় যে, তারা পরিবেশের দূষণ বন্ধ করে বাতাস পরিষ্কার করে রাখছে।
পরিবেশ বিষয়ক পরামর্শক ও এ বিষয়ে পিএইচডি করা কার্টিস গুয়াব দেখতে পেয়েছেন যে, ঘরের একটি কক্ষ থেকে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কার্বনডাই অক্সাইড সরিয়ে ফেলতে পারে গাছ বা উদ্ভিদ।
কিন্তু সেটা নির্ভর করে কী ধরণের গাছ এবং সেগুলো কতগুলো রয়েছে, তার ওপরে। সেই সঙ্গে রুমটি কতোবড় এবং গাছের মাটির ভেতরে কতটা পানি রয়েছে।
উদ্ভিদে যে পরিমাণ জল সরবরাহ করা হয়, তার ওপর নির্ভর করে গাছটি কতটা কার্বন ডাই অক্সাইড সরাতে পারবে, ঠিক যেমনটা মানুষের ক্ষেত্রেও ঘটে।
তিনি বলেন, আপনার শরীরে যদি পানিশূনত্য থাকে অথবা আপনি অতিরিক্ত পানি খেয়ে ফেলে, তাহলে আপনিও পুরোপুরি সুস্থ বোধ করবেন না।
ঘরের গাছ কি তাহলে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর?
ওয়াঙ বলছেন, যা কিছুই আমরা করি না কেন, সেটার একটা কার্বন ফুটপ্রিন্ট তৈরি করে, কিন্তু সেটা পরিবেশের ওপর কতটা প্রভাব ফেলছে, তা নিয়ে আতংকিত হওয়া ঠিক নয়।
তবে তিনি পরামর্শ দিচ্ছেন, যদি ক্রেতারা যদি যতটা সম্ভব টেকসই পরিবেশ রক্ষা করতে চান, তাহলে তাদের উচিত সরবরাহকারীদের সঙ্গে পিট শৈবাল ব্যবহার নিয়ে কথা বলা, বিশেষ কিছু গাছপালা এড়িয়ে চলা এবং কলম বা বীজ থেকে তৈরি হয়, এমন গাছপালার প্রতি আগ্রহী হওয়া।
তিনি বলেন, এর কোনটাই কঠিন কোন কাজ নয়। তবে এর প্রতিটা পদক্ষেপই পরিবেশ রক্ষায় সাহায্য করতে পারে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন