উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে গিয়ে ছুটি শেষে আর দেশে ফেরেননি দেশের ৩৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭১ জন শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একের পর এক চিঠি দিয়েও সাড়া না মেলায় তাদের মধ্যে ১২০ জনকে ইতোমধ্যে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। বাকি শিক্ষকদের চাকরি থাকলেও তারা এখনো লাপাত্তা।
না-ফেরা শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ না রাখলেও নিয়মিত বেতন-ভাতা নিচ্ছেন। দেশের টাকা বিদেশে খরচ করে বিলাসী জীবন যাপন করার অভিযোগও রয়েছে এসব শিক্ষকের বিরুদ্ধে।
চার বছরের বেশি সময় ধরে অনুপস্থিতি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনবহির্ভূত। কঠোর শাস্তির বিধান রেখে এ সংক্রান্ত একটি নীতিমালা তৈরি করলে শিক্ষকদের বিদেশ গিয়ে লাপাত্তা হওয়ার প্রবণতা কমতে পারে বলে অভিমত শিক্ষাবিদদের।
সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) এক প্রতিবেদন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, উচ্চ শিক্ষার জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পছন্দের দেশ যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্র্রেলিয়া। শিক্ষাছুটির সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন-ভাতা পেয়ে থাকেন তারা। তবে শর্ত থাকে যে, নির্ধারিত শিক্ষাছুটি শেষে তাদের দেশে ফিরতে হবে। কিন্তু এসব শিক্ষকের কেউ কেউ বিদেশ গিয়ে উধাও হচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বারবার চিঠি দেওয়া হলেও এর উত্তর পর্যন্ত দিচ্ছেন না তারা।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের এই ধরনের বেপরোয়া আচরণ এবং বাড়তি ছুটির পেছনে রাজনৈতিক প্রভাব ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আনুকূল্যকেও দায়ী করেন শিক্ষাবিদরা।
ইউজিসির ওই প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, বর্তমানে দেশের ৩৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক হাজার ৬৮০ জন শিক্ষক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন।
আইন অনুযায়ী, বিদেশে যাওয়া শিক্ষকরা বৈতনিক, অবৈতনিকসহ বিভিন্নভাবে সর্বোচ্চ চার বছর ছুটি নিতে পারেন। এসময় কারও ডিগ্রি বা গবেষণা শেষ না হলে আরও দুই বছরের অবৈতনিক ছুটি দেওয়া হয়। তবে তার জন্য নিয়ম হলো- চার বছর ছুটি ভোগের পর দেশে ফিরে কাজে যোগদান করতে হবে। এরপর দুই বছরের ছুটির জন্য আবেদন করতে হয়।
চার বা ছয় বছর ছুটি ভোগের পর কেউ যদি পদত্যাগ করতে চান, তাহলে তাকে ছুটির সময় নেওয়া অর্থ ফেরত দিতে হয়। অথবা সমপরিমাণ সময় চাকরি করার পর নিতে হয় অব্যাহতি। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষকরা এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ছুটিতে থাকাকালীন দেশের বাইরে থেকে উপার্জন করেন।
যেসব শিক্ষক লাপাত্তা
ইউজিসি বলছে, স্কলারশিপ, পিএইচডি বা প্রেষণ, অবকাশযাপন, চিকিৎসা ও অন্যান্য কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৫৬ জন শিক্ষক বিদেশে অবস্থান করছেন। এর মধ্যে ২৯ জন শিক্ষক নির্ধারিত সময় পার হলেও আর কর্মস্থলে ফেরেননি। ফলে নিয়ম অনুযায়ী তাদের কাছে পাওনা টাকা আদায় শুরু হয়েছে। চাকরিচ্যুত করা হয়েছে ৩৭ জনকে। তাদের কাছ থেকেও পাওনা টাকা আদায়ের প্রক্রিয়া চলছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ১৭১ জন শিক্ষক বিদেশে আছেন। তাদের ৪১ জনের ছুটি শেষ হলেও ফেরেননি। এ পর্যন্ত ২১ জনকে চাকরিচ্যুত করেছে বুয়েট। বাকিদের বিষয়ে নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে।
এ ছাড়া উচ্চশিক্ষা নিতে বিদেশ গিয়ে ফিরে আসেননি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) ছয়জন শিক্ষক। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭৭ জন, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬৪, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (ডুয়েট) ৭৪, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৩, বাংলাদেশ টেক্সটাইলের ২৫, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৯, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪১ জন।
উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৪, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩১, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তির ৭৩, চট্টগ্রাম প্রকৌশলী ও প্রযুক্তির ১০০, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৮, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৩, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫১, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ৩৫, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ৫৪ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির আটজনসহ মোট এক হাজার ৬৮০ জন শিক্ষক বিদেশে অবস্থান করছেন।
এ বিষয়ে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক শেখ ইকরামুল কবিরের ভাষ্য, উচ্চশিক্ষার জন্য ৫০ শতাংশ শিক্ষকের বিভিন্ন শর্তে স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশ যাওয়ার নিয়ম। তাদের মধ্যে কেউ কেউ দুই বছরের জন্য ছুটি নিয়ে গেলেও ছুটি শেষের তিন মাস আগে নানা অজুহাতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরও ছয় মাস বা এক বছর ছুটি বাড়িয়ে নেন। যাদের রাজনৈতিক প্রভাব ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আনুকূল্য আছে, তারা বাড়তি ছুটি দ্রুত পেয়ে যান।
এভাবে ধাপে ধাপে ছুটি বাড়ালেও পরে আর ফিরে আসেন না তারা। একদিকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেতন-ভাতা দেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে বিদেশে সেই শিক্ষক কাজ করে টাকা উপার্জন করছেন। কঠোর শাস্তির বিধান রেখে ইউজিসি থেকে এ-সংক্রান্ত একটি নীতিমালা তৈরি করা প্রয়োজন বলে মনে করেন এই শিক্ষাবিদ।
শিক্ষকদের বিদেশ গিয়ে ফিরে না আসার পেছনে তাদের শিক্ষকতার আদর্শ ও নীতির স্থান থেকে বিচ্চুতি বলে মনে করেন ইউজিসির চেয়ারম্যান (চলতি দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. দিল আফরোজা বেগম। তিনি বলেন, এতে একদিকে রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি হচ্ছে শিক্ষক সংকট। এ ধরনের অনৈতিক প্রবণতা থেকে শিক্ষকদের বের হয়ে আসা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
ঢাকাটাইমস
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন