জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ উপলক্ষে সারা দেশের সব মাদ্রাসাশিক্ষকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ শ্রেণিশিক্ষক হয়েছেন বরিশাল সাগরদী ইসলামিয়া কামিল মাদ্রাসার প্রভাষক রিয়াজুল ইসলাম। ২১ জুন ঢাকায় এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁর হাতে এ পুরস্কার তুলে দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। পুরস্কার পাওয়ার পর তাঁর শিক্ষার্থী, স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। এমন অর্জনে তিনি নিজেও খুব খুশি। কারণ, এবার তিনি দ্বিতীয়বারের মতো দেশসেরার পুরস্কার পেলেন। মাদ্রাসা শিক্ষাসহ শিক্ষার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তিনি প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিবেদক মোশতাক আহমেদ।
প্রথম আলো: মাদ্রাসা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শ্রেণিশিক্ষকের পুরস্কার পাওয়ায় আপনাকে অভিনন্দন। পুরস্কার পাওয়ার পরের পরিস্থিতিটি যদি বলতেন?
রিয়াজুল ইসলাম: পুরস্কার পাওয়ার খবরটি প্রথম আলোয় প্রকাশের পর আত্মীয়স্বজন, শুভাকাঙ্ক্ষীরা খুবই খুশি। অনেকে মন্তব্য করেছেন ‘ফেসবুকে তো আপনার জয়জয়কার’। উত্তরে আমি কেবল বললাম, এটি আপনাদের দোয়া ও সহযোগিতায় পেয়েছি। আমার বাবাও বাড়ি থেকে উপজেলা সদরে গিয়ে পত্রিকা সংগ্রহ করেছেন। আম্মাও খুশি হয়েছেন।
প্রথম আলো: কোন কোন যোগ্যতায় আপনি মাদ্রাসায় শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের পুরস্কার পেলেন?
রিয়াজুল ইসলাম: শিক্ষাগত যোগ্যতা, দায়িত্ববোধসহ বেশ কিছু মানদণ্ডের ভিত্তিতে এই শ্রেষ্ঠ শ্রেণিশিক্ষক নির্বাচন করা হয়। আমি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবি ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছি। একই বিভাগ থেকে এমফিল শেষ করে পিএইচডি থিসিস জমা দিয়ে ডিগ্রির অপেক্ষায়। উম্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএড করেছি। জাতীয় জার্নালে ১০টির বেশি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। আমি আমার অধিকাংশ ক্লাস পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে নিই। ক্লাসে জোর দিই শিক্ষার্থীদের অ্যাম্বিশান, টার্গেট ও গোলের বিষয়ে। যেন যেখানেই যায় তারা তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী টিকে থাকতে পারে। আমি কখনো কখনো নিজের টাকায় ডেইলি স্টার পত্রিকা কিনে দিই, যেন শিক্ষার্থীরা পড়ে। কখনো কখনো টাকা দিয়ে কারেন্টস অ্যাফেয়ার্স কিনে দিই। শিক্ষার্থীদের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির বিষয়ে জোর দিই। শিক্ষার্থীরাও আমাকে পছন্দ করে। ইতিপূর্বে আমি ২০১৮ সালেও জাতীয় শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হওয়ার গৌরব অর্জন করি। তবে আমার একটি উপলব্ধি হলো, এই ধরনের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণে প্রতিষ্ঠান পর্যায় থেকে কিছু প্রতিবন্ধকতা কাজ করে।
প্রথম আলো: সাধারণ ধারার শিক্ষা ও মাদ্রাসা (আলিয়া) শিক্ষায় পড়াশোনায় বিষয়বস্তুতে পার্থক্যটি কেমন?
রিয়াজুল ইসলাম: মাদ্রাসাতেও বাংলা, ইংরেজি, গণতিসহ সাধারণ ধারার বিষয়গুলো পড়ানো হয়। পাশাপাশি আরবি শিক্ষাদান করানো হয়। সাধারণ বিষয়গুলো সাধারণ ধারার শিক্ষার মতোই।
প্রথম আলো: সাধারণ ধারায় দেখা যায় শিক্ষার্থীদের ভাষার দক্ষতা বিশেষ করে ইংরেজির দক্ষতা খুবই দুর্বল। মাদ্রাসার ক্ষেত্রে আরবি ভাষায় কতটা দক্ষ হতে পারছেন শিক্ষার্থীরা?
রিয়াজুল ইসলাম: যাঁরা স্নাতক (সম্মান), স্নাতকোত্তর বা কামিল পাস করেন,
তাঁরা অনর্গল কথা বলতে না পারলেও মোটামুটি ভালো বলা যায়। তবে আরও সুযোগ করে দিলে তাঁরা আরও ভালো করবেন।
প্রথম আলো: মাদ্রাসায় প্রাইভেট পড়ানোর প্রবণতাটি কেমন?
রিয়াজুল ইসলাম: চাকরির এক যুগ পর্যন্ত আমি কোনো কোচিং কিংবা প্রাইভেটের সঙ্গে জড়িত নই। আমার চিন্তা হলো প্রাইভেট পড়িয়ে দুই ঘণ্টা সময় অপচয় না করে বরং সেই সময়ে কটি প্রবন্ধ লিখলে তাঁর মূল্য অনেক। এতে কিছু সম্মানীও পাওয়া যায়। নিজ শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ানো শিক্ষকদের জন্য নিষিদ্ধও। তবে বর্তমানে কিছু শিক্ষার্থীকে তাদের ক্যারিয়ার ডেভেলপের জন্য সিলেবাসের বাইরের বেশ কিছু বিষয়ে বিনা মূল্যে পড়াচ্ছি, যাতে তারা ভালো রেজাল্ট করে বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পায় এবং ক্যারিয়ার ডেভেলপ হয়।
আবার বাস্তবতা হলো অনেক শিক্ষক অছেন, যাঁরা শুধু বেতননির্ভর হওয়ায় কষ্টে সংসার পরিচালনা করেন। ফলে বাধ্য হয়ে কেউ কেউ প্রাইভেট–কোচিংয়ের দিকে যান। তাই সরকারকে জনবল–সংক্রান্ত বৈষম্য, সরকারি ও বেসরকারি বৈষম্য দূর করতে হবে। আবার কিছু অসাধু ব্যক্তি রয়েছেন, যাঁদের পেশা এবং নেশা হলো ‘কঠিন বিষয়ে’ নামে ক্লাসে না পড়িয়ে বাসায় মোটা অঙ্কের টাকায় ১০–১২ দিনে এক মাস বলে পড়ান।
প্রশ্ন: প্রথম আলো: দেশের শিক্ষা ও শিক্ষার ব্যবস্থাপনা নিয়ে যদি কিছু বলতেন?
রিয়াজুল ইললাম: আমি মনে করি শিক্ষার ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ হওয়া উচিত সিলেবাসভিত্তিক। বাকিটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে থেকে দিতে হবে এবং নিতে হবে। যেমন সুন্দর হাতের লেখা, সুন্দর করে কথা বলা, ভাষায় ভালো দক্ষতা অর্জন করা, আইসিটিতে যোগ্য হওয়া ইত্যাদি। আর কোচিং ও প্রাইভেট বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। দেখা যায় যে শিক্ষক বাসায় গিয়ে কিংবা ব্যাচে প্রাইভেট পড়ান, তাঁদের অধিকাংশই
ক্লাসে পাঠদানে যত্নবান হন না। অনেকে শ্রেণিশিক্ষক হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীকে তাঁর কাছে পড়তে বাধ্য করেন। আবার প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার পরীক্ষা পরিচালনা এবং প্রশ্নপত্র প্রণয়নের কাজে নিয়োজিত কিছু শিক্ষকের কাছে অধিকাংশ শিক্ষার্থী প্রাইভেট পড়ে, এ জন্য যে পরীক্ষার আগে শুধু তাঁদের কাছ থেকে প্রশ্ন সম্পর্কে জানতে পারবে। এমন শিক্ষকের কাছে পড়ুয়ারা ক্লাসে অনিয়মিতও থাকে। একজন শিক্ষক যদি প্রতিটি শিক্ষার্থীকে তাঁর নিজের সন্তানের মতো বিবেচনা করে ক্লাসে পড়ান, তাহলে এ সমস্যা অনেকাংশেই কমবে। একেকটি শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩০-৪০ হওয়া জরুরি।
এ ছাড়া বাজারের নোট-গাইডনির্ভরতা পরিহার করে পাঠ্যবই থেকে শিখন-শিক্ষণের ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। সাধারণ শিক্ষার মতো মাদ্রাসা শিক্ষার ক্ষেত্রেও অবারিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকা জরুরি। যেমন সাধারণ ও বিজ্ঞান বিষয়ের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ থাকলেও আরবি বিষয়ের তেমন প্রশিক্ষণ নেই। আবার বর্তমান সরকার স্কুল ও কলেজ আলাদাভাবে অনেক প্রতিষ্ঠান সরকারি করছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় আজও পর্যন্ত মাদ্রাসা সরকারীকরণের কোনো ঘোষণা দেননি। সরকারের এমন একপেশে নীতি শিক্ষাব্যবস্থায় সুফল বয়ে আনতে পারবে না। সরকারের কাছে সাধারণ শিক্ষা এবং মাদ্রাসা শিক্ষা দুটোই দুটি সন্তানের মতো হতে হবে। যোগ্য মাদ্রাসাকেই সরকারি করা উচিত। আর শিক্ষকদের স্থানীয় প্রভাব এবং রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে হবে। প্রতিষ্ঠান প্রসাশনকে আরও ‘বড় মনের’ হতে হবে।
প্রথম আলো: দেশের অন্য শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে কী বলবেন?
রিয়াজুল ইসলাম: নৈতিকতার আলোকে আন্তরিক ও মনোযোগী হতে হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন