দুর্নীতি, অনিয়ম, শিক্ষক নিয়োগে পরিবার করণসহ ক্ষমতার অপব্যবহারের ঘৃণ্যতম উদাহরণ সৃষ্টি করলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) উপাচার্য প্রফেসর ড. এম আব্দুস সোবহান। তার দুর্নীতিতে সহায়তার অভিযোগ উঠেছে উপ-উপাচার্য অধ্যাপক চৌধুরী মো. জাকারিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক এম এ বারীসহ আরো কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের তদন্তেও দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যেখান থেকে পাড়াশোনা করে বের হওয়ার কথা মানুষ হয়ে, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিসহ উচ্চ পদস্তদের দুর্নীতি উচ্চ শিক্ষাকে বিরাট প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। দুর্নীতিবাজদের নিকট থেকে শিক্ষার্থীরা কি শিখবে সেটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাড়িয়েছে।
এদিকে দুর্নীতিতে অভিযুক্ত উপাচার্যসহ এসব কর্মকর্তাকে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অপসারণের দাবি জানিয়েছে বামপন্থী ছাত্র ফেডারেশন।
শুক্রবার (২৩ অক্টোবর) বিকেলে রাবি শাখা ছাত্র ফেডারেশনের দফতর সম্পাদক অন্তু বিশ্বাস গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠান ।
উল্লেখ্য, শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালার পরিবর্তন করে উপাচার্যের নিজ কন্যা ও জামাতাকে নিয়োগ, উপাচার্যের অবসরগ্রহণের পর ফের দায়িত্ব পালন এবং রাষ্ট্রপতিকে অসত্য তথ্য প্রদান, উপাচার্যের বাড়ি ভাড়া নিয়ে দুর্নীতি, অধ্যাপক চৌধুরী মো. জাকারিয়াকে উপ-উপাচার্য নিয়োগ ও তার নিয়োগ বাণিজ্য, বিভিন্ন নিয়োগে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতিসহ অনেক অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে।
এর মধ্যে বেশ কয়েকটি অভিযোগের সত্যতাও পেয়েছে তদন্ত কমিটি।
চলতি বছরের শুরুতে রাবি ভিসিসহ বর্তমান প্রশাসনের অনিয়ম ও দুর্নীতির ৩০০ পৃষ্ঠার একটি অভিযোগপত্র প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসিতে জমা দেন আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের একাংশ। এতে ৬২ জন শিক্ষক স্বাক্ষর করেন।
জানা গেছে, উপাচার্যের বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তদন্ত কমিটি। প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির কার্যালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এ সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন জমার দেয়ার খবরও পাওয়া গেছে। এতে দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রমাণ পাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে বেশ কয়েকটি সুপারিশ করা হয়।
এ ব্যাপারে রাবি শাখা ছাত্র ফেডারেশনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আশরাফুল আলম সম্রাট বলেন, প্রশাসনের সর্বোচ্চ কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ও অনিয়মের ঘটনা শুধু ক্যাম্পাসের ভাবমূর্তিই নষ্ট করে না। বরং পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। আমরা দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ও অনিয়মের তীব্র নিন্দা জানাই এবং তাদের অপসারণ চাই।
রাবি শাখা ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মহব্বত হোসেন মিলন বলেন, গত বছর বর্তমান প্রশাসনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমরা ধারাবাহিক আন্দোলন চালিয়েছি। ওই সময় ছাত্র নেতৃবৃন্দের ওপর নানা চাপ তৈরি হলেও আমরা আন্দোলন থেকে পিছপা হইনি। একপর্যায়ে প্রশাসনকে লাল কার্ড দেখিয়ে আচার্য বরাবর খোলা চিঠি প্রেরণ করি এবং প্রশাসনের সমস্ত কার্যক্রমকে অবৈধ ঘোষণা করি।
তখন ইউজিসি বা আচার্য কেউই আমাদের কথা শোনেননি। দেরিতে হলেও দুর্নীতি ও অনিয়মের ঘটনাটি প্রমাণিত হলো। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই দুর্নীতিবাজরা স্বপদে বহাল আছে, যা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। আমরা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে উপাচার্যসহ সকল দুর্নীতিবাজের অপসারণ দাবি করছি।
তিনি আরও বলেন, দুর্নীতিবাজের জায়গায় যাতে আর কোনো দুর্নীতিবাজ বসতে না পারে সেজন্য প্রশাসনের স্বৈরতান্ত্রিক কাঠামোকে ভেঙে ফেলতে হবে। রাকসু কার্যকর করে ছাত্র প্রতিনিধি দ্বারা সিনেট পূর্ণাঙ্গ করে সিনেট সদস্যদের মতামতের ভিক্তিতে উপাচার্য নির্বাচনসহ প্রশাসনিক কার্যক্রম চালাতে হবে। সর্বোপরি ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক কাঠামো বিনির্মাণ করতে হবে।
ভিসির বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ:
আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের একাংশের অভিযোগ থেকে জানা যায়, অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান দ্বিতীয় মেয়াদে উপাচার্য হওয়ার পর ৪৭৫তম সিন্ডিকেটে শিক্ষক নিয়োগ-নীতিমালা পরিবর্তন করেন। এতে শিক্ষক নিয়োগের যোগ্যতা কমানো হয়। আগের নীতিমালায় আবেদনের ন্যূনতম যোগ্যতা ছিল সনাতন পদ্ধতিতে এসএসসি থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত চারটি স্তরেই প্রথম শ্রেণি। আর গ্রেড পদ্ধতিতে এসএসসি ও এইচএসসিতে ন্যূনতম জিপিএ ৪.৫০, স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তরে ন্যূনতম সিজিপিএ ৩.৫০। একইসঙ্গে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তরে সংশ্লিষ্ট বিভাগের মেধাক্রম প্রথম থেকে সপ্তমের মধ্যে থাকতে হবে। কিন্তু সেই যোগ্যতা কমিয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে সিজিপিএ ৩.২৫ এ নামিয়ে আনা হয় এবং মেধাক্রমে থাকার শর্তও তুলে দেওয়া হয়।
অভিযোগে বলা হয়, নতুন নিয়োগ যোগ্যতায় উপাচার্যের মেয়ে, জামাতাসহ ৪৩ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে উপাচার্যের কন্যা, জামাতাসহ অন্তত ৩৪ জন শিক্ষকেরই আগের নীতিমালায় আবেদন করারই যোগ্যতা ছিল না। নিয়োগের যোগ্যতা শিথিলের পর উপাচার্যকন্যা সানজানা সোবহান ও জামাতা এ টি এম শাহেদ পারভেজ শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। এর মধ্যে মার্কেটিং বিভাগ থেকে পাস করা সানজানা নিয়োগ পান ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগে। আর শাহেদ নিয়োগ পান ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটে (আইবিএ)। মেয়ের মেধাক্রম ছিল ২১ এবং জামাতার ৬৭তম । আগের নীতিমালা থাকলে তারা শিক্ষক হওয়ার আবেদনই করতে পারতেন না।
এছাড়া আইন বিভাগের নিয়োগ পাওয়া তিন শিক্ষকের মধ্যে দুজনেরই পূর্বে নীতিমালায় আবেদন যোগ্যতা ছিল না। এদের মধ্যে নিয়োগ পাওয়া মো. সালাউদ্দিন সাইমুম পরে উপ-উপাচার্য চৌধুরী মো. জাকারিয়ার মেয়েকে বিয়ে করেন। অভিযোগ আছে ‘যোগসাজশ’ করেই এই নিয়োগ দেওয়া হয়। আরেকজনও বিভাগের এক শিক্ষকের স্ত্রী।
নিয়োগ নীতিমালা পরিবর্তনের পর ২০১৮ সালে চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান বিভাগে চার জন শিক্ষক নিয়োগ হয়। যাদের মধ্যে তিনজনের আগের নীতিমালা অনুযায়ী আবেদন করার যোগ্যতাই ছিল না। শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে নিয়োগ পাওয়া পাঁচ জনের মধ্যে চার জনেরই আগে নীতিমালায় আবেদন যোগ্যতা ছিল না। ইইই বিভাগের চার জনের মধ্যে একজনের, এছাড়া আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ট্যুরিজম, পদার্থবিজ্ঞান , ব্যাংকিং ও ইনস্যুরেন্স বিভাগ, ব্যবহারিক গণিত, বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ পেয়েছেন যাদের অনেকেরই আগের নীতিমালায় আবেদন যোগ্যতা ছিল না।
এছাড়া তার বিরুদ্ধে ‘বাড়ী দুর্নীতি’র অভিযোগও করা হয়।
অভিযোগে বলা হয়, উপাচার্য আবদুস সোবহান ২০১৭ সালের মে মাসে দায়িত্ব নিয়ে উপাচার্যের বাসভবনে ওঠেন। এ জন্য ২০১৩ সাল থেকে অধ্যাপক হিসেবে তার নামে বরাদ্দ করা ডুপ্লেক্স বাড়িটি কাগজপত্রে ছেড়ে দিলেও আসবাব রাখার জন্য প্রায় দেড় বছর দখলে রাখেন। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয় বাড়ি ভাড়ার আয় থেকে বঞ্চিত হয়।
অভিযোগে আরো বলা হয়, অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান ২০১৭ সালে ৭ মে দ্বিতীয় মেয়াদে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান। এরপর একই বছরের ২১ জুন রাষ্ট্রপতিকে না জানিয়ে উপাচার্যের পদে থেকে ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান ও ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। আবার ওই দিনই তিনি বিভাগ থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন। ফলে উপাচার্যের পদে সাময়িক শূন্যতা সৃষ্টি হয়।
এছাড়া স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে তিনি রাষ্ট্রপতিকেও অসত্য তথ্য দিয়েছেন বলে অভিযোগপত্রে জানান শিক্ষকরা।
অভিযোগে বলা হয়, উপাচার্যের অনুপস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক আখতার ফারুককে নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত উপাচার্যের রুটিন দায়িত্ব পালনের জন্য অনুমতি প্রার্থনা করে ২৪ জুন রাষ্ট্রপতি ও আচার্যের অনুমতির জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠান। চিঠিতে তিনি ২৯ জুন অবসরে যাওয়ার অনুমতি আবেদন করেন।
অভিযোগকারী শিক্ষকরা অভিযোগ পত্রে দাবি করেন, উপাচার্য পদে সাময়িক শূন্যতা পূরণে ‘রাষ্ট্রপতির অনুমতি ছাড়াই’ এক দিনের জন্য বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ড. আখতার ফারুককে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য নিয়োগ দেন। যা ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশের পরিপন্থী।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন