মনোমুগ্ধকর প্রশস্ত বাগান। পাশেই নান্দনিক স্থাপত্যশিল্প আর রাজপ্রাসাদের মতো দেখতে একটি ভবন। ভবনের প্রবেশ গেটেই চোখে পড়বে পাশাপাশি দুটি সুউচ্চ গম্বুজ, পুরো ভবনের নকশা আর কক্ষগুলো একই ধরনের। নান্দনিক এই স্থাপত্যটি মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো।
অন্য কেউ ছবিটি দেখে চিনতে না পারলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা ছবিটি প্রথমবার দেখলেই চিনতে পারবেন এটি তাদের প্রিয় শহীদুল্লাহ হল। ইন্টারনেটের কল্যাণে এই ভবনের ১৯৮০ সালে তোলা সাদাকালো এই ছবির দেখা মিললেও ছবিটি কে তুলেছিলেন তা অজানা।
জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক শরীফ উদ্দিন আহমেদ রচিত ঢাকা কলেজ ইতিহাস ও ঐতিহ্য ১৮৪১-১৯২১ বই থেকে ছবিটি নেয়া। সেখানে বলা হয়েছে, ১৯০৮ সালে ঢাকা কলেজের জন্য পরিকল্পিতভাবে নির্মিত প্রথম ছাত্রাবাস এটি। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের কোনো সরকারি কলেজের জন্য নির্মিত প্রথম ছাত্রাবাসও এটি।
বিভিন্ন মাধ্যমের তথ্যমতে, ১৮৪১ সালে ঢাকা কলেজ প্রতিষ্ঠার ফলে একদিকে যেমন নাগরিক জীবনে যোগ করেছিল অভিনব সামাজিক বৈশিষ্ট্য, তেমনি ছাত্রসমাজের জন্যও এক ভিন্নমুখী জীবনযাত্রার সূচনা করেছিল। ছাত্রদের বিচিত্র জীবনযাপনের ধারা থেকে ঢাকা শহরে সৃষ্টি হয় এক নতুন ধারার সংস্কৃতির, এক নতুন সামাজিক বাতাবরণের। তাছাড়া ঢাকার বাইরে থেকে পড়তে আসা ছাত্রদের জীবনে যোগ হয়েছিল নতুন এক চমক।
ঢাকার বাইরে থেকে ঢাকা কলেজে পড়তে আসা ছাত্রদের প্রথম যে তথ্য পাওয়া যায় তা হলো, ১৮৪৩ সালে কলেজ কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে ১৫ জন ছাত্র বিভিন্ন জেলা থেকে এসে ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়েছে। এদের মধ্যে সাতজন ফরিদপুর, দুজন বরিশাল, দুজন যশোর, দুজন ময়মনসিংহ এবং দুজন ভারতের উত্তর প্রদেশ থেকে এসেছে। তা সত্ত্বেও ঢাকা কলেজে ভর্তি হওয়া ঢাকার বাইরের ছাত্রদের জন্য কোনো ধরনের ছাত্রাবাস ১৮৮০ সাল পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি। এ দীর্ঘ সময়ে ছাত্ররা নানাবিধ কষ্টের মধ্যেই তাদের পড়ালেখা চালিয়ে যেতে থাকে। যদিও ১৮৭৪ সালে ঢাকায় একটি ছাত্রাবাস স্থাপিত হয়। কিন্তু তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।
এরপর বিভিন্ন সময়ে ঢাকা কলেজে ছাত্রাবাস নির্মাণে নানা সমস্যা দেখা দেয়। কখনো সরকারি বিধি-নিষেধের বলয়, আবার কখনো সামাজিক নানা সমস্যার কারণে ছাত্রাবাস গড়ে ওঠেনি আর। অবশেষে তৎকালীন সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত অনুদানে বাংলাবাজারের শ্রীদাস লেনে ‘রাজচন্দ্র হিন্দু ছাত্র হোস্টেল’ নামে প্রথম ছাত্রাবাস নির্মিত হয়। সে সময়ের অধ্যক্ষ এ হোস্টেল স্থাপনাকে সে বছরের সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা বলে উল্লেখ করেছিলেন। হোস্টেলে ছাত্রসংখ্যা দ্রুত বেড়ে ১৮৮৩-৮৪ সালে আবাসিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৯০ জনে দাঁড়ায়। হোস্টেলের এ ছাত্র বৃদ্ধি কর্তৃপক্ষের জন্য হয়ে ওঠে বড় এক বিড়ম্বনা। কারণ এত অধিক ছাত্রের জন্য ভবনটি যথেষ্ট ছিল না।
পরবর্তীতে ১৯০৪ সালের ২৭ মে এক সরকারি সভায় ঢাকা কলেজের জন্য একটি আধুনিক ছাত্রাবাস নির্মাণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সে সময়ের অন্যতম স্থাপত্যবিদ পি. ডব্লিউ. ডি. কর্তৃক একটি নকশা প্রস্তাব করেন। এ নকশাটিই ছিল বাংলাদেশে প্রথম আধুনিক ধারার ছাত্রাবাস নির্মাণের নকশা। তিনি কক্ষগুলোকে ২০×১৪ ফুুট আয়াতাকারভাবে তৈরির প্রস্তাব দেন। প্রতি কক্ষে চারজন করে থাকতে পারবেন।
এর চার বছর পর ১৯০৮ সালের মার্চ মাসে এর নির্মাণকাজ শেষ হয়। কার্জন হলের নকশার সঙ্গে এই নকশা অনেকটা সামঞ্জস্যপূর্ণ। ১৯১১-১২ সালে এখানে ১৯০ জন ছাত্র ছিলেন।
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে ‘ঢাকা হল’ নামে এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল হিসেবে যুক্ত হয়। এরপর ১৯৬৯ সালে এশিয়ার বিখ্যাত পন্ডিত ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর নাম অনুসারে এই হলের নামকরণ করা হয় ‘শহীদুল্লাহ হল’। পরে ২০১৭ সালের ১৭ জুন এই হলের নাম ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ হল করা হয়। এভাবেই ঢাকা কলেজের ছাত্রাবাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ হল হিসেবে পরিচিতি পায়।
উল্লেখ্য, ১৯৫৫ সালে ঢাকা কলেজ তার বর্তমান ক্যাম্পাসে (নিউমার্কেট) চলে আসে। তখন ঢাকা কলেজের জমির পরিমাণ ছিল ২৪ একর। এরশাদ সরকারের আমলে ৬ একর জমি ছেড়ে দিতে হয়। বর্তমানে ঢাকা কলেজ ১৮.৫৭ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত। বর্তমানে কলেজের আটটি আবাসিক হল রয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন