বাবা-মায়ের চোখের মণি। কলিজার টুকরা আফরোজা নীলা। একমাত্র সন্তান হিসেবে আফরোজাই তাদের পৃথিবী। আর তাই আফরোজাকে চোখের আড়াল করতেন না তারা। কিন্তু উচ্চ শিক্ষার জন্য পাঠাতে বাধ্য হন রাজধানীতে। ধানমন্ডি এলাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। নতুন পরিবেশ। বাবা-মাকে ছাড়া থাকা।
ইংরেজি বিভাগের এই শিক্ষার্থী নজরে পড়ে যান একাধিক শিক্ষার্থীর। সেইসঙ্গে এক শিক্ষকের। সেই শিক্ষক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রথমে যোগাযোগ শুরু করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে দেন অধিক নম্বর দেয়া থেকে শুরু করে নানা সুবিধা। সেই শিক্ষক এই যোগাযোগ বাড়িয়ে দেন কয়েকগুণ। শেষে তিনি নানা আপত্তিকর কথা বলতে শুরু করেন।
এই শিক্ষার্থী বলেন, সেই শিক্ষকের বয়স প্রায় ৭০। তিনি আমাকে একসঙ্গে রাত থাকার প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন, আমার বয়স হয়ে গেছে। যৌন ক্ষমতা নেই। এই বয়সে একটু জড়িয়ে ধরে থাকতে চাই। এরপর তার কথায় রাজি না হওয়ায় নেমে আসে নানা মানসিক নির্যাতন। নানা রকম হুমকি। শেষে ভয়ে সেই সেমিস্টার ড্রপ দেই। শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় পাল্টাতে বাধ্য হই।
এই শিক্ষার্থীর মতো অনেকেই শিক্ষকের যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। লালমাটিয়ায় অবস্থিত এক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থী বলেন, ২০১৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বসন্ত বরণ অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছিলো। এমন সময় রাতে এক সহপাঠী তাকে জোরপূর্বক ‘কিস’ করে।
তিনি বলেন, এই ঘটনার পর ভেঙ্গে পড়ি। ক্লাসে যাইনি বেশ কদিন। এরপর যখন ক্লাসে যাওয়া শুরু করি তখন নিজেকে অপরাধী মনে হতো। সবসময় ভয় লাগতো। এই বুঝি কিছু হতে চলেছে আমার সঙ্গে। এই ঘটনার আগে আমার সিজিপিএ ছিলো ৩.৬৫। সেবার আমি ২ বিষয়ে ফেল করি। রাতে ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখে চমকে উঠতাম। পুরো শরীর ঘেমে যেতে। এরপর মানসিক ডাক্তারের কাছে যাই। এই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে আমার সময় লাগে কয়েকমাস। যদিও আমার সেই সহপাঠী ক্ষমা চায়। কিন্তু আমার যে ক্ষতি হয়েছে তা বলে শেষ করার মতো নয়।
ফার্মাসি বিভাগের একজন সোমালিয়ান ছাত্রী তার অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে জানান, দেশের বাইরে পড়তে এসে প্রধান সমস্যা ভাষা। কিন্তু তারপরও কিছু কিছু বাংলা জানেন তিনি। অনেকেই অশালীন মন্তব্য করেন। ক্যাম্পাসেই বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে এক ছাত্রের সঙ্গে। জন্মদিনের উদযাপনে যাই। অনেককেই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে বললেও গিয়ে দেখেন তাকে একাই দাওয়াত দেয়া হয়েছে। সেখানে প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় শুরু হয় নির্যাতন। এরপর থেকে ক্যাম্পাসে নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হন তিনি। শরীরে হাত দেয়া, নানা রকম আজে বাজে কথা ছড়ানো ইত্যাদি।
একজন শিক্ষিকা বলেন, আমার বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে। আমি আমার একমাত্র সন্তান নিয়ে থাকি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষক আমাকে বিরক্ত করতেন। তাদের মধ্যে একজন শিক্ষক আমার গায়ে পড়ে থাকতো। আমার ছেলের জন্মদিনে রাতের বেলা কেক নিয়ে আসে। ১২টায় কেক কাটার পর একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া করে। তিনি বিবাহিত। আমি না চাইলেও তিনি গভীর রাত অব্দি বাড়িতে থাকেন। ম্যাসেঞ্জারে নানা অশ্লীল কথা ও ভিডিও পাঠাতেন। এভাবে অসহ্য হয়ে ওঠে ক্যাম্পাস যাওয়া।
যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধে বিশ্ববিদ্যালয়ে সেল গঠন করার জন্য বলা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অভিভাবক বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। ২০০৯ সালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনাও রয়েছে। কিন্তু ২০১৮ সালে এক প্রতিবেদনে বলা হয় ৮৭ শতাংশ শিক্ষার্থীই জানেন না বিষয়টি।
২০১০ সালে ১৬ ধরনের কর্মকাণ্ডকে যৌন হয়রানি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে- সরাসরি কিংবা ইঙ্গিতে অশালীন আচরণ, হয়রানি বা নিপীড়নমূলক উক্তি, মন্তব্য বা ভঙ্গি, প্রাতিষ্ঠানিক এবং পেশাগত ক্ষমতা ব্যবহার করে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা, চিঠি, মোবাইল, খুদে বার্তাসহ বিভিন্ন মাধ্যমে যৌন ইঙ্গিতমূলক অপমানজনক কথা লেখা, চরিত্র হননের জন্য স্থির বা ভিডিও চিত্র ধারণ করা, প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়ে হুমকি দেয়া ইত্যাদি।
ইউজিসি’র উপ পরিচালক মৌলি আজাদ বলেন, বর্তমানে একাডেমিক কার্যক্রম চলছে ৯৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরমধ্যে ৫৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে যৌন নিপিড়ন বিরোধী সেল। তিনি আরো বলেন, এই কমিটি কার্যকর থাকলেও অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই প্রচার।
মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটির যৌন নিপীড়ন বিরোধী কমিটির প্রধান ড. নারগিস সুলতানা বলেন, আমরা ইউজিসি’র নির্দেশনা অনুযায়ী গত দুই বছর যাবৎ এই কমিটি করেছি। একটি অভিযোগ বক্স করেছি। নোটিশের মাধ্যমে ছাত্রীদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত তেমন কোন গুরুতর অভিযোগ পাইনি। কিছু মৌখিক অভিযোগ পেয়েছি যেগুলো নিয়ে কোন শাস্তিমূলক পদক্ষেপের প্রয়োজন হয়নি। এছাড়াও তিনি বলেন, অভিযোগগুলো মূলত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন মন্তব্য কেন্দ্রীক পেয়েছি। অনেক সময় আমরা সচেতন করে থাকি ছাত্রীদেরও।
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি শুরু থেকেই যৌন নিপীড়ন বিরোধী সেল রয়েছে। এই কমিটির সদস্য ফাহমি হাসান বলেন, সাধারণত আমরা ক্লাসের বড় ভাই, সহপাঠীদের দ্বারা হয়রানির অভিযোগ পাই। এসব অভিযোগের বিরুদ্ধে প্রথমে লিখিত নেই। সেই লিখিত অভিযোগের বিরুদ্ধে প্রমাণ সাপেক্ষ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করি।
যৌন নির্যাতন বিরোধী কমিটি আছে এমন ১০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৩ জন ছাত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মাত্র ৮ জন ছাত্রী এই কমিটি সম্বন্ধে জানেন না। আর এই ৮ জন শিক্ষার্থী কখনও নিজে বা পরিচিত কাউকে অভিযোগ করতে শোনেননি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন