চট্টগ্রাম নগর পুলিশের এক বড় কর্তার মেয়ে এসএসসির পরীক্ষা হলে বিশেষ সুবিধা নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ণ চন্দ্র নাথ এমন একটি অভিযোগ পাওয়ার প্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নিয়েছেন বলে বৃহস্পতিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় জানান।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম নগরীর কাজেম আলী হাই স্কুলের যে কক্ষে ওই শিক্ষার্থীর পরীক্ষা চলে, সেখানে পর্যবেক্ষক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় একই বিষয়ের শিক্ষককে। এ ছাড়া পরীক্ষা কেন্দ্রের ওই কক্ষে ঢুকে কিছুক্ষণ পর পর ছাত্রীর খোঁজখবর নেন পুলিশের একজন উপপরিদর্শক (এসআই)।
গত ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মোট নয়টি বিষয়ের পরীক্ষা এভাবেই দিয়ে গেছে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের ওই কর্মকর্তার এসএসসি পরীক্ষার্থী কন্যা। সরাসরি অভিযোগ পেয়ে সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) ঘটনা তদন্তে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের একটি টিম ঝটিকা সফরে যায় কাজেম আলী হাই স্কুলে। তারা স্কুলের দোতলায় ৩১ নম্বর কক্ষে গিয়ে ঘটনার সত্যতা দেখতে পায় সরাসরি। যথারীতি ওইদিনও যে বিষয়ের পরীক্ষা, সেই বিষয়ের শিক্ষক ওই কক্ষে পরীক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। শুধু তাই নয়, তদন্ত টিম কাজেম আলী উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের ১০টি পরীক্ষাকক্ষে এমন ১০ জন পরীক্ষকের খোঁজ পায়, যারা যে বিষয়ে পরীক্ষা চলছে ঠিক ওই বিষয়েরই শিক্ষক। এমন ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করে কেন্দ্র সচিবকে ওই দিনই মৌখিকভাবে সতর্ক করে দেন শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ণ চন্দ্র নাথ। উপ পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকও এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন।
জানা গেছে, ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে এমন কাণ্ড ঘটতে থাকলে এর দুই একদিন পর বেশ কয়েকজন অভিভাবক টেলিফোনে নালিশ জানায় চট্টগ্রাম শিক্ষাবার্ডে। পরে অভিযোগের মাত্রা বাড়তে থাকলে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের নির্দেশে সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) সকাল ১০টা ৫ মিনিটে ঘটনা তদন্তে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ণ চন্দ্র নাথ এবং উপ পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ঝটিকা সফরে গিয়ে ঘটনার সত্যতা খুঁজে পান। ভেতরে ভেতরে ঘটনাটি নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হলে কেন্দ্র সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দীনকে বোর্ড থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয় ওই পরীক্ষার্থীর পরীক্ষা কক্ষ পরিবর্তন করে দেওয়ার জন্য। নির্দেশনা অনুসারে বৃহস্পতিবারের (২০ ফেব্রুয়ারি) পরীক্ষায় পরীক্ষা কক্ষ ৩১ থেকে পরিবর্তন করে ৪১ নম্বরে নেওয়া হয়।
জানা গেছে, পরীক্ষক ছাড়াও ওই ছাত্রীর সহায়তাকারী হিসেবে পরীক্ষা কেন্দ্রেই পুলিশের একজন উপ-পরিদর্শক (এসআই) সার্বক্ষণিক নিয়োজিত থাকেন এসএসসি পরীক্ষার শুরু থেকেই। পরীক্ষা চলাকালে ওই উপ-পরিদর্শক (এসআই) কিছুক্ষণ পর পর পরীক্ষার হলে ঢুকে ওই ছাত্রীর কাছে গিয়ে সব ঠিকমতো পারছে কিনা এবং কোনো প্রশ্নের উত্তর লাগবে কিনা দেখে আসেন।
ওই একই কক্ষে পরীক্ষা দেওয়া একাধিক পরীক্ষার্থীর অভিভাবক জানিয়েছেন, পরীক্ষা কেন্দ্রে ওই ছাত্রীর কক্ষে প্রতিদিন প্রতি বিষয়ের পরীক্ষা চলাকালে কর্তব্যরত শিক্ষক ওই পরীক্ষার্থীকে প্রশ্নের উত্তর বলে দিয়েছেন। কিছুক্ষণ পর পর একজন পুলিশ এসে পরীক্ষা কক্ষে ঢুকে ওই ছাত্রীর কাছে জানতে চান সব ঠিকমতো পারছে কিনা।
আরেক পরীক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট প্রতিটি পরীক্ষায় ওই পরীক্ষার্থীর বহু নির্বাচনী (এমসিকিউ) অংশের উত্তর শতভাগ ঠিক করে দেওয়ার দায়িত্ব ছিল ওই কক্ষের নির্দিষ্ট পর্যবেক্ষকদের ওপর।’
আরেক অভিভাবক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘ওই পরীক্ষার্থীর চারপাশে একটা বলয় তৈরি করে রাখা হয়। প্রতিদিনের এমন কাণ্ডে আমাদের সন্তানদের পরীক্ষাও ভালোভাবে হয়নি। ঠিকমতো তারা মনোযোগও দিতে পারেনি। এভাবে তো হয় না। ক্ষমতা দেখিয়ে কি এমন করা যায় নাকি?’
এদিকে বৃহস্পতিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) সকাল ১০টায় সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে কাজেম আলী স্কুলের সামনে ওই পরীক্ষার্থীর বাবা পুলিশ কর্মকর্তা ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বেশ কিছু সদস্যকে উপস্থিত থাকতে দেখা যায় অন্তত ১১টা পর্যন্ত। এরই মধ্যে ওই কেন্দ্রে উপস্থিত হন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) আবু হাসান সিদ্দিক।
কাজেম আলী হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দীন পুরো ঘটনাটি প্রথম দিকে অস্বীকার করলেও পরবর্তীতে অভিযোগের বিষয়টি স্বীকার করে নেন। তিনি বলেন, ‘যে ঝামেলাটা হয়েছে তা মিটমাট হয়ে গেছে। আর কোনো সমস্যা নেই। বোর্ডের নির্দেশনা অনুসারে ওই পরীক্ষার্থীর হল চেঞ্জ করে দেওয়া হয়েছে। এখন আর কোনো সমস্যা নেই।’
এ প্রসঙ্গে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) আবু হাসান সিদ্দিক বলেন, ‘আমি অফিসিয়ালি তেমন কিছুই জানি না। একটু করে শুনেছি। তবে কখন কেন হয়েছে তার কিছুই জানি না। এখন বিষয়টি খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ণ চন্দ্র নাথ এ বিষয়ে বলেন, ‘মৌখিক অভিযোগের পর চেয়ারম্যান স্যারের নির্দেশে পরীক্ষা কেন্দ্র পরিদর্শনে গিয়ে দেখি পরীক্ষা কক্ষে যে বিষয়ের পরীক্ষা সেই বিষয়ের শিক্ষক ওই কক্ষে পরীক্ষক হিসেবে ছিল। তখনই ব্যবস্থা নিয়ে তাদের চেঞ্জ করে দেওয়া হয়েছে।’
পুলিশ কর্মকর্তার মেয়ের বিশেষ সুবিধা পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নাম প্রকাশ না করার শর্তে বুধবার এক অভিভাবক অভিযোগ করেন, ওই পরীক্ষার্থীর জন্য তার সন্তানের পরীক্ষা দিতে সমস্যা হচ্ছে। তার কাছ থেকে শুনে চেয়ারম্যান স্যারের সঙ্গে যোগযোগ করে ওই ছাত্রীর কক্ষ পরিবর্তন করে দিই। এ বিষয়ে কেন্দ্র সচিবকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।’
এ ঘটনায় কেন্দ্র সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দীনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি।
চট্টগ্রাম বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ওই পুলিশ কর্মকর্তার পরিচয় এখনো জানতে পারেননি বলে জানান।
পূর্বপশ্চিমবিডি
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন