খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) অবকাঠামো উন্নয়নে নিম্নমানের কাজসহ ঘুষ, দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা ভাগাভাগি ও লোপাটের রেশ কাটতে না কাটতেই শুরু হয়েছে ভিসির নিয়োগ বাণিজ্য নিয়ে তোলপাড়। শিক্ষকসহ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়ম এবং নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ পাওয়া গেছে তার বিরুদ্ধে।
অভিযোগ উঠেছে অযোগ্যদের ডিন ও বিভাগীয় প্রধান পদেও নিয়োগ দিয়েছেন ভিসি। এমনকি নিজের আত্মীয়স্বজনকে বসিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পদে। তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, সব নিয়োগই স্বচ্ছতার ভিত্তিতে হয়েছে।
খুবির একাধিক সূত্রে জানা গেছে, আইন অনুষদের বর্তমান ডিন ও প্রধানের নিয়োগ হয়েছে আইন বহির্ভূভাবে। খুবিতে নিয়োগ বিধিতে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, অধ্যাপক হতে গেলে ‘সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে অন্তত ৪ (চার) বছরের শিক্ষকতার বাস্তব অভিজ্ঞতা’ থাকতে হবে। কিন্তু আইন বিভাগের প্রধান ওয়ালিউল হাসনাতের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে মোট অভিজ্ঞতা মাত্র ৩ বছর ৬ মাস ৭ দিন। এর সঙ্গে তার লিয়েন কার্যকালকে (১০ মাস ১৪ দিন) অভিজ্ঞতা হিসেবে গণনা করে মোট অভিজ্ঞতা দেখানো হয়েছে ৪ বছর ৪ মাস ২১ দিন। অথচ খুবিসহ বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই লিয়েনকে চাকরিকালীন বাস্তব অভিজ্ঞতা হিসেবে গণনার বিধান নেই।
এছাড়া, পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক নিয়োগের ক্ষেত্রেও ঘটেছে বড় ধরণের অনিয়ম। খুবির বিধি অনুযায়ী অধ্যাপক হতে গেলে মোট ২৫ বছরের শিক্ষকতা অভিজ্ঞতা থাকতে হবে বলে স্পষ্ট উল্লেখ থাকলেও বলা থাকলেও তা নামিয়ে আনা হয়েছে ২০ বছরে। সেই সঙ্গে অধ্যাপক হতে ন্যূনতম ১০টি প্রকাশনার কথা বলা থাকলেও এ বিশেষ ক্ষেত্রে চাওয়া হয়েছে মাত্র ৫টি প্রকাশনা। আর এমন শিথিলকৃত যোগ্যতাতেই নিয়োগ দেয়া হয়েছে পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক উত্তম মজুমদারকে। এতো কম যোগ্যতায় খুবির ইতিহাসে আর কেউ অধ্যাপক পদে কখনোই নিয়োগ পাননি।
অপরদিক তালিকার ৫৯ নম্বর থেকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে ইতিহাস ডিসিপ্লিনের প্রভাষক মো. হাফিজ আহমেদকে। অথচ তার আগে থাকা সব প্রার্থীরই শিক্ষাজীবনের সব পর্বে প্রথম শ্রেণি ছিল। অনেকেই ছিলেন পিএইচ.ডি. ডিগ্রিধারী। তাদের বাদ দিয়ে মান অবনমন করে এমন নিয়োগও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে বিরল।
শুধু তাই নয়, অনেক ডিসিপ্লনে শিক্ষক স্বল্পতা থাকলেও বিজ্ঞাপিত পদের চেয়ে নিয়োগ দেয়া হয়েছে কম শিক্ষক। আবার অনেক ডিসিপ্লিনে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বিজ্ঞাপিত পদের চেয়ে অনেক বেশি শিক্ষক। যেমন, পদার্থ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিন, কলা বা চারুকলা অনুষদের ডিসিপ্লিন সমূহে শিক্ষক সংকট থাকলেও হয় নিয়োগ দেয়া হয়নি, আর দিলেও তা বিজ্ঞাপিত পদের চেয়ে কম। অথচ ফার্মেসি ডিসিপ্লিনে শিক্ষক স্বল্পতা না থাকলেও তিন পদের বিপরীতে নেয়া হয়েছে ৭ জন, আইন ও বিভাগে সাংবাদিকতা এ দুই বিভাগে ৩ পদের বিপরীতে ৫ জন করে।
এছাড়া খুবির বাংলা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী পুজা মিত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুলে ৯ মাস খণ্ডকালীন হিসেবে শিক্ষকতা করার পর তাকে সরিয়ে দিয়ে নিয়োগ দেয়া হয়েছে ওই বিভাগেরই শিক্ষক মো. দুলাল হোসেনের স্ত্রীকে। অথচ তার স্ত্রীর একাডেমিক যোগ্যতা পুজা মিত্রের সঙ্গে মোটেও তুলনীয়ই নয়। পুজার অনার্স ও মাস্টার্সের ফলাফল প্রথম দিকে। তিনি মাস্টার্সে থিসিস গ্রুপের শিক্ষার্থী। মেধা তালিকায় তার অবস্থান ৩য়। ইতোমধ্যে তার দুটি গবেষণাগ্রন্থও বের হয়েছে। কিন্তু দুলাল হোসেনের স্ত্রীর ফলাফল পুজার চেয়ে অনেক কম। তিনি নন-থিসিস গ্রুপের শিক্ষার্থী। কোনো লেখাপত্র না থাকলেও কেবল স্বামীর সুবাদে পুজাকে সরিয়ে নিজে জায়গা করে নিয়েছেন।
এছাড়াও খুবিতে বিভিন্ন পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে দেখা গেছে উপাচার্যের উন্মুক্ত স্বজনপ্রীতি। বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত মো. ইউসুফ রায়হান (ভাগ্নে), মো. জামাল মিয়া (ফুপাতো ভাই), মো. আবু সাঈদ (ভাগ্নে), রুবেল হাসান (ভাগ্নে), সৈকত মাহমুদ (ভাইপো), আসাদুর রহমান (মামাতো ভাই), নাজমুল ইসলাম (ভাইপো), মো. সফিকুল ইসলাম (ফুপাতো ভাই), নজরুল ইসলাম (চাচাতো ভাই) উপাচার্যের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। তারা ছাড়াও মো. আনিছ, পলাশ, মো. রাজু কাজী, ইব্রাহীম মোল্লা, সুজন খানও তার আত্মীয় বলে জানা গেছে। তাদের মধ্যে ল্যাব সহকারী (উপাচার্যের ভাইপো) সৈকত মাহমুদ চুরি করে ধরাও পড়েছেন।
নিয়োগের ক্ষেত্রে লাগামহীন অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির এমনসব চিত্র প্রকাশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ স্থনীয় শিক্ষাবিদরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে খুবি কর্তৃপক্ষ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। রেজিস্ট্রার প্রফেসর ড. এটিএম গোলাম কুদ্দুস দাবি করেন, সবগুলো নিয়োগই যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হয়েছে। এখানে কোনো চাতুরির বিষয় নেই, নেই স্বজনপ্রীতিও।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন