বিশ্ববিদ্যালয়ে আত্মহত্যার মিছিল থামছেই না! সর্বশেষ, এ মিছিলে যুক্ত হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সবুজ চন্দ্র মিত্র। শুক্রবার সকালে তিনি গ্রামের নিজ বাসায় আত্মহত্যা করেছেন। যেসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ না পেয়ে প্রতিবছর হাজারো শিক্ষার্থীর স্বপ্নভঙ্গ হয়, সেইসব স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানে এসেও কেন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করবে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আত্মহত্যার প্রবণতা কমাতে প্রয়োজন পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি। বেকারত্ব, পারিবারিক সমস্যা, প্রেমঘটিত জটিলতা, আর্থিক চাপ, একাডেমিক লাইফে খারাপ ফলাফল প্রভৃতি আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে। এসবের কোন একটি কারণে কেউ যখন নিঃসঙ্গ হয়ে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়ে এবং এ হতাশার বিষয়টি কারও সঙ্গে শেয়ার করতে না পারে, তখন এ বিষয়টি আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে। এ সমস্যা সমাধানে পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবকে আরও সহানুভূতিশীল হতে হবে বলে মত দেন তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বলেন, বিভিন্ন কারণে তরুণ-তরুণীরা আত্মহত্যার পথ বেঁচে নিচ্ছেন। এ থেকে বুঝা যায় সমাজের মধ্যে শূন্যতা ও বিচ্ছিন্নতা রয়েছে। কারও একার পক্ষে এটা দূর করা সম্ভব না। সমাজের মানুষকে আরও সহানুভূতিশীল হতে হবে, তারপর বিষয়গুলো কমে আসবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ছাত্র নির্দেশনা ও পরামর্শদান দপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক মেহজাবীন হক বলেন, পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতার কারণে আত্মহত্যার ঘটনাগুলো বেশি ঘটছে। এর পেছনে কাজ করছে প্রযুক্তির অগ্রসরতা ও প্রতিযোগিতার মনোভাব। ফলে তরুণ-তরুণীরা তাদের সমস্যার সমাধান হিসেবে আত্মহত্যাকে বেঁচে নিচ্ছে। এ ধরনের একটি ঘটনা আরেকটি ঘটনাকে প্রভাবিত করছে বলেও তিনি মনে করেন।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দীন বলেন, যিনি আত্মহত্যা করে থাকেন তার কিছুদিন আগে থেকে মানসিক স্বাস্থ্যহানী ঘটে। এ সময় তার মানসিক সুস্থতা থাকে না। এ সময় তিনি নিসঙ্গতায় ভোগে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়ে এবং এ হতাশার বিষয়টি কারও সঙ্গে শেয়ার করতে পারে না তখন তাকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে। তীব্র বিষন্নতা, তীব্র মানসিক চাপ, হতাশা এসব বিষয়গুলো তাকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে। অনেক সময় দেখা যায়, যিনি আত্মহত্যা করে থাকেন, তিনি কারও থেকে যে যথাযথ সমর্থন দরকার, সেটা পান না। কোনো ধরনের সাহায্যে পান না।
জানা গেছে, ডিপার্টমেন্টের পরীক্ষায় কম নম্বর দেওয়া আত্মহত্যার কারণ হতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে ঢাবির ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সবুজ চন্দ্র মিত্রের সহপাঠীরা। শুক্রবার সকালে তার নিজ গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীর গলাচিপায় গাছের সঙ্গে ফাঁস দিয়ে তিনি আত্মহত্যা করেন।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, গলাচিপা উপজেলার কচুয়া ইউনিয়নের চিকনিকান্দি গ্রামের সৌমিক মিত্র সবুজ ঢাবির জগন্নাথ হলের শিক্ষার্থী ছিলেন। পিতা হারানো সবুজ ডিপার্টমেন্টে প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষায় দ্বিতীয় হয়েছিলেন। তিনি বর্তমানে বিভাগটির ছাত্র প্রতিনিধি (সি,আর)।
সবুজের বন্ধুরা বলছেন, গত তিন দিন আগে সবুজের ডিপার্টমেন্টের মিডটার্মের রেজাল্ট দেওয়া হয়েছে। ১৫ মার্কের একটি পরীক্ষায় তিনি পাঁচ পেয়েছেন। এতে তিনি কোর্সটির শিক্ষক এস এম রেজাউল করিমের কাছে গিয়ে পরীক্ষা ভালো হওয়া সত্ত্বেও কম মার্ক পাওয়ার কারণ জানতে চান। শিক্ষক উত্তরে তাকে বলেন, তোমার হাতের লেখা খারাপ তাই কম নম্বর পেয়েছ। এ ঘটনায় সবুজ হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং বিষয়টি সবাইকে জানাতে থাকেন। দুই দিন আগে সবুজ গ্রামের বাড়ি যান। শুক্রবার সকালে তার ফাঁস দেওয়া মরদেহ গাছে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পায় এলাকাবাসী। পরে পুলিশকে জানালে পুলিশ লাশ এসে মর্গে নিয়ে যায়।
চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি আত্মহত্যা করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ছাত্র রবিউল আলম। আর্থিক অনটনের কারণে পারিবারিক অশান্তিতে ছিলেন বলে জানিয়েছেন ঘনিষ্ঠজনরা। নববিবাহিত এ ছাত্র স্ত্রী এবং শাশুড়ির অপমান সহ্য করতে না পেরে তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলে ধারণা করছেন সহপাঠীরা। সাভারের নিজ বাসা থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তার গলায় ফাঁস ছিল। পরিবারের সঙ্গে সাভার পৌরসভার বাজার রোড এলাকায় বসবাস করতেন তিনি।
চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের তাইফুর রহমান প্রতীক নামের এক ছাত্র ‘আত্মহত্যা’ করেছেন। তিনি ২০১১-১২ সেশনের ছাত্র ছিলেন। নিহত পরিবারের দাবি, বিভাগের কয়েকজন শিক্ষক মাস্টার্সে বিভিন্ন ইস্যু বানিয়ে কোর্সে নম্বর কম দিয়েছে।যাতে প্রতীক শিক্ষক হতে না পারে। তাদের দাবি, গত ছয় মাস ধরে এই বিষয়গুলো তাকে কষ্ট দিচ্ছিল। এই কষ্ট সহ্য করতে না পেরে প্রতীক আত্মহত্যা করেছে।
গত বছরের ১২ নভেম্বর রাজধানীর ফার্মগেটের একটি হোস্টেল গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন ঢাবির বিশ্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ওই ছাত্রী ফাহমিদা রেজা সিলভি। প্রেমের সম্পর্কের টানাপোড়েনের কারণে তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলে জানা যায়।
এই ঘটনার দুইদিন পর ১৪ নভেম্বর গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন ঢাবি অধিভূক্ত রাজধানীর আজিমপুরের গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী লায়লা আঞ্জুমান ইভা। পুলিশের প্রাথমিক ধারণা অনুযায়ী এই শিক্ষার্থীও প্রেম ঘটিত কারণে আত্মহত্যা করেছেন।
দুদিন পর ১৬ নভেম্বর যশোরের গ্রামের বাড়ীতে আত্মহত্যা করেন ঢাবির ২০১০-১১ সেশনের প্রাক্তন ছাত্রী মেহের নিগার দানি।
হতাশাগ্রস্থ হয়ে গত বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারী রাজধানীর হাজারীবাগের একটি নির্মানাধীন ভবনের ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের শিক্ষার্থী তরুন হোসেন। শিক্ষার্থীদের দেয়া তথ্য মতে, ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে ঢাবিতে ভর্তি হওয়া তরুণ সাদাসিধে জীবন যাপনের জন্য বন্ধুদের কাছে নিগ্রহের শিকার হতেন। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ শিক্ষকদের রূঢ় আচরণ ও একটি কোর্সে পরপর দু’বার অকৃতকার্য হওয়াও তার হতাশার উল্লেখযোগ্য কারণ হতে পারে।
গত বছরের ৩১ মার্চ ঢাবির এমবিএ ভবনের ৯ তলা থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেন সান্ধ্যকালীন কোর্সের শিক্ষার্থী তানভীর রহমান। তার বন্ধুরা জানান, ত্রিশ বছর বয়সী তানভীর রহমান সরকারি চাকুরি না পাওয়ার দুঃখে এ পথ বেছে নিয়েছিলেন। চাকরির বয়স পার হয়ে যাওয়া স্বত্ত্বেও সরকারি চাকরির নাগাল না পাওয়াই তানভীরের আত্মহত্যার কারণ।
দেশের শিক্ষা ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে গত বছরের ১৫ আগস্ট রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় আত্মহত্যা করেন ঢাবির সংগীত বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মুশফিক মাহবুব। আত্মহননের আগে স্বাধীনচেতা মুশফিক তার ফেইসবুক ওয়ালে লিখে গেছেন ‘আই ওয়ান্ট ফ্রিডম অ্যাজ এ বাংলাদেশি ইভেন ইফ ইট কিলস মি ফর দ্যা রিজন’ তার বন্ধুদের ভাষ্য অনুযায়ী, কাউকে হতাশায় ভুগতে দেখলে মুশফিক নিজেই সান্ত্বনা দিতো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জীবনের কাছে হেরে গেলেন মুশফিক নিজেই।
গত বছরের ১৫ই অক্টোবর পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে সুইসাইড নোট লিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র জাকির হোসেন গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
গত বছরের ১৯ অক্টোবর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের নাজমুল হাসান নামের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের এক শিক্ষার্থী আবাসিক হলে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। নাজমুলের সহপাঠীরা জানান, নাজমুল হাই প্রেসারের রোগী। বেশ কিছুদিন ধরে তিনি অসুস্থতার মধ্যে ছিলেন। প্রতিদিন তিনি ১২টি করে ট্যাবলেট সেবন করতেন এবং সবসময় বিষণœতা ও হতাশার মধ্যে থাকতেন।
এর আগে ৯ আগস্ট মাত্র ২ ঘণ্টার ব্যবধানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী মুমতাহেনা আফরোজ গলায় ফাঁস দিয়ে এবং তার সহপাঠী রোকনুজ্জামান ট্রেনের নিচে লাফ দিয়ে কাটা পড়ে মারা যান। রোকনুজ্জামান ও মুমতাহেনার মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল বলে জানা যায়। জানা যায়, হেনার পরিবার তাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য চাপ দেয়। তাদের প্রেমের সম্পর্কের বিষয়টি পরিবারকে জানালে তারা মেনে নিতে রাজি হয়নি। ফলে ওই দিন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ঝিনাইদহ শহরের ঝিনুক টাওয়ারের পঞ্চম তলার একটি কক্ষে ফ্যানের সঙ্গে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন হেনা। এরপর মাত্র ২ ঘণ্টার ব্যবধানে রাত সাড়ে ৮টায় প্রেমিকার আত্মহত্যার খবর শুনে প্রেমিক রোকনুজ্জামান কুষ্টিয়া শহরের মতি মিয়া রেলগেটে ট্রেনের নিচে লাফ দিলে কাটা পড়ে মারা যান। রোকনুজ্জামান বিবিএ প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে স্নাতক (সম্মান) শেষ করেন। হেনাও প্রথম শ্রেণিতে স্নাতক (সম্মান) শেষ করেন।
১৭ এপ্রিল ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিকাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী সাইমুজ্জামান খান সাইম ক্যাম্পাসের পার্শ্ববর্তী এক মেসে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। জানা যায়, প্রেমিকার প্রতি অভিমান করে চিরকুট লিখে তিনি আত্মহত্যা করেন।
চাকরি না পাওয়ায় হতাশা থেকে গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র সৈকত রঞ্জন। তিনি ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষের ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন রিসোর্স টেকনোলজির ছাত্র ছিলেন। সহপাঠীরা জানান, সৈকত দুইবার বিসিএস পরীক্ষা দিয়েও ব্যর্থ হন। মৃতে্যুর পর তার টেবিলের ড্রয়ার থেকে পাওয়া প্রেসক্রিপশন থেকে জানা যায়, তিনি সম্প্রতি হতাশার কবল থেকে বাঁচতে ডাক্তারের শরণাপন্নও হয়েছিলেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন