কারচুপি, অনিয়মের অভিযোগে ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের ফল বাতিলের দাবিতে একাট্টা ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য সবাই। ছাত্রলীগের নেতৃত্বাধীন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদভুক্ত সংগঠনগুলোর অনেকেই চাইছেন নতুন করে নির্বাচন।
আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে ছাত্রদল এবং নির্বাচন বর্জন করা ৫টি প্যানেল। চলছে ৩ দিনের আলটিমেটাম। ভোট বাতিলে আলাদা স্থানে আমরণ অনশন করছেন ১২ শিক্ষার্থী ও প্রার্থী।
স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচিত তিন ছাত্রী হলের প্রতিনিধিরা সমর্থন জানিয়েছেন এ আন্দোলনে। আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে ফের নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন ডাকসুর নবনির্বাচিত ভিপি নূরুল হক নূর।
বৃহস্পতিবারও সারা দিন ক্যাম্পাসে ডাকসুর ভোট বাতিল ও পুনঃতফসিলের দাবিতে আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভ মিছিল করেছেন। এদিন ভোট বাতিল করে পুনঃনির্বাচনের দাবি জানায় বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রী ও জাসদ সমর্থিত বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। নির্বাচন ও আন্দোলন নিয়ে হল কর্তৃপক্ষের অবস্থান জানাতে সংবাদ সম্মেলন করেন প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা।
বুধবার রাতে রোকেয়া হলের অনশনকারীদের হেনস্তার অভিযোগ আনেন বিক্ষুব্ধ ছাত্রীরা। তাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে ডাকসুর নবনির্বাচিত ভিপি নূর এ ঘটনার নিন্দা জানান। পরে সেখানে সংহতি জানাতে আসেন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের হয়ে ডাকসুর ভিপি প্রার্থী মোস্তাফিজ রহমান। তিনি বলেন, ছাত্রীদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা আছে। ছাত্রদল তাদের সঙ্গে থাকবে সব সময়।
১১ মার্চ অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফল বাতিল এবং নতুন তফসিল ঘোষণার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে শনিবার পর্যন্ত ৩ দিনের সময় বেঁধে দিয়েছে ভোট বর্জন করা প্যানেলগুলো।
তবে সেই দাবি নাকচ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বলেছেন, নিয়ম মেনেই নির্বাচিতদের দায়িত্ব গ্রহণের আনুষ্ঠানিকতা সারা হবে।
এসব বিষয় নিয়ে বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন ডাকসু ভিপি। পরে তিনি রোকেয়া হলের ফটকে গিয়ে সেখানে অনশনরত পাঁচ শিক্ষার্থীর দাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। তখন ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের অন্য নেতাকর্মীরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
এ সময় নতুন ভিপি নূরুল হক নূর বলেছেন, আমার একটি সংগঠন রয়েছে। তারা আমার সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন, শ্রম দিয়েছেন, সময় দিয়েছেন। নির্বাচনে এত কারচুপির মধ্যেও সাধারণ শিক্ষার্থীরা আমার পক্ষে কাজ করেছেন। তাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছি, তাদের মোটিভ কী, তারা কী চাচ্ছেন সেটা বোঝার চেষ্টা করছি। তারা যদি চান যে আমি ভিপি হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে তাদের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করি, তাহলে আমি সেটা করব। যদি না চান তাহলে আমি দায়িত্ব গ্রহণ করব না।
অনশনরত শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে নূর বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪-৫ জন শিক্ষার্থীও যদি অনশন করেন তার একটা গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। গান্ধী একজন ছিলেন, বঙ্গবন্ধু একজন ছিলেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তারা কিন্তু প্রথমে একাই লড়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ করছেন আমি নৈতিকভাবে তার প্রতি সমর্থন দিয়েছি, এখনও দিচ্ছি।
রোকেয়া হলের প্রাধ্যক্ষ জিনাত হুদার পদত্যাগ দাবি করে ভিপি নূর বলেন, তিনি আমাকে এবং ছাত্রীদের দেখে নেয়ার যে হুমকি দিয়েছেন। কাজেই তিনি আর ওই পদে থাকতে পারেন না। তার অবশ্যই পদত্যাগ করা উচিত। আমি আমার বোনদের সঙ্গে একমত হয়ে ভিসি মহোদয়কে বলেছি যে রোকেয়া হলের প্রাধ্যক্ষ মেমের বিরুদ্ধে যেহেতু অনিয়মের অভিযোগ এসেছে, তাই উনাকে পদত্যাগ করতে হবে। যেমনি ভাবে কুয়েত-মৈত্রী হলের প্রাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ আসার পর তাকে সরে যেতে হয়েছিল।
নির্বাচনে কারচুপি হয়ে থাকলে তা ভিপি হিসেবে আপনার জয়কেও প্রশ্নবিদ্ধ করে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে নূর বলেন, প্রতিকূল পরিস্থিতি ও কারচুপি মোকাবেলা করেই ছাত্রদের প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছি। যেভাবে নির্বাচন শুরু হয়েছিল সেটা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ এবং অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া। সে কারণেই আজকে নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আমরা শুরু থেকেই এ নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলাম।
রোকেয়া হলের অনশনকারীদের হেনস্তার অভিযোগ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে : কারচুপির অভিযোগে রোকেয়া হল সংসদ নির্বাচন বাতিল করে পুনরায় ভোট, হল প্রাধ্যক্ষের পদত্যাগসহ চার দফা দাবিতে বুধবার রাত থেকে আমরণ অনশনে বসেছেন হলের পাঁচ শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে চারজন বিভিন্ন প্যানেল থেকে হল সংসদে প্রার্থী ছিলেন। অনশনে অংশ নেয়া ছাত্রীরা অভিযোগ করেন, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ ও ডাকসুর নবনির্বাচিত জিএস গোলাম রাব্বানী বুধবার রাতে নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে ঘটনাস্থলে এসে তাদের হেনস্তা করেন।
আন্দোলনকারী ছাত্রীরা জানান, দিবাগত রাত দেড়টার দিকে মোটরসাইকেলে ছাত্রলীগের শতাধিক নেতাকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে রোকেয়া হলের সামনে আসেন ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ও ডাকসুর নবনির্বাচিত জিএস গোলাম রাব্বানী। এসেই তিনি ছাত্রীদের হলের ফটকের বাইরে অনশন করা ও তাদের সমর্থকদের অবস্থান নিয়ে মুঠোফোনে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের সঙ্গে কথা বলেন এবং বিভিন্নভাবে হুমকি-ধমকি দেন। তাদের ‘শিবিরকর্মী’ বলেও আখ্যা দেন তিনি। পরে ছাত্রীদের প্রতিবাদের মুখে তিনি চলে যান। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন গোলাম রাব্বানী।
এদিকে অনিয়ম-কারচুপির অভিযোগ এনে ফের ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের দাবিতে আমরণ অনশনে বসা রোকেয়া হলের পাঁচ ছাত্রীকে হেনস্তার বিষয়ে হলটির প্রাধ্যক্ষ জিনাত হুদা বলেছেন, তারা হলের গেটের বাইরে গিয়ে অবস্থান করছেন। সেখানে হেনস্তার হওয়ার ঘটনাটি আমাদের কনসার্ন না। আমাদের কনসার্ন তাদের গেটের বাইরে থেকে হলের ভেতরে নিয়ে আসা। ছাত্রীদের হেনস্তার বিষয়ে আমি অবগত নই। কোনো হাউস টিউটরও আমাকে অবগত করেননি। রোকেয়া হল সংসদে পুনঃনির্বাচন দেয়ার এখতিয়ার তার নেই বলেও জানান এ অধ্যাপক।
বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় অধ্যাপক জিনাত বলেন, ১১ তারিখ নির্বাচনের আগের দিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৬টি ব্যালট বাক্স এবং ৩টি ট্রাঙ্কসহ কেন্দ্রীয় সংসদের জন্য ৪ হাজার ৬০৮টি এবং হল সংসদের জন্য ৪ হাজার ৬৩৮টি ব্যালট পেপার সরবরাহ করা হয়। ভোটের দিন ৬টি ব্যালট বাক্স ভোট কেন্দ্রে রাখা হয়। আর বাকি ৩টি ট্রাঙ্ক ২ হাজার ৬০৮টি ব্যালট পেপারসহ পাশের রুমে রাখা হয়। এ নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয়। পরে ওইগুলো সব প্রার্থীকে দেখানোও হয়। সেগুলোতে কোনো সিল মারা ছিল না।
অনশনরত শিক্ষার্থীদের বিষয়ে তিনি বলেন, ছাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য প্রক্টরিয়াল টিম রয়েছে। আমি নিজেও আবাসিক শিক্ষকদের পাঠিয়েছি, যেন ওদের নিরাপত্তায় কোনো ব্যাঘাত না ঘটে। আমি নিজেইতো ৩ রাত ঘুমাতে পারিনি ছাত্রীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন প্রসঙ্গে জিনাত হুদা বলেন, হল কর্তৃপক্ষ বা আমার দ্বারা কারও বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি। ছাত্রীদের আমার কাছে আসতে হবে। আমি ওদের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছি। ওদের কথা বলার জন্য ডেকেছিও। কিন্তু ওরা কথা বলতে আসেনি। শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে পদত্যাগ করবেন কিনা সে বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলেননি ড. জিনাত হুদা।
নির্বাচন বাতিলের দাবিতে চলছে তৃতীয় দিনের অনশন : এদিকে ডাকসু এবং হল সংসদ নির্বাচনের ফল বাতিল করে পুনঃতফসিলের দাবিতে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে শিক্ষার্থীদের আমরণ অনশন গড়িয়েছে তৃতীয় দিনে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কেউ তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। এ অবস্থায় দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তাদের অনশন চলবে। ৬ অনশনকারীর একজন বুধবার অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। তার জায়গায় আরও দু’জন পরে অনশনে যোগ দেন। ফলে এখন অনশনে রয়েছেন ৭ জন। অনশনরত রাফিয়া বলেন, শরীরে যতক্ষণ শক্তি আছে ততক্ষণ অনশন চলবে। পুনঃনির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পাশাপাশি ১১ মার্চের ভোটে দায়িত্ব পালনকারী সবাইকে সরিয়ে দেয়ারও দাবিও তাদের।
নির্বাচন বাতিলে ভিসিকে স্মারকলিপি জাসদ ছাত্রলীগের : বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় অনিয়ম ও কারচুপির নির্বাচন বাতিল করে নতুন তফসিল ঘোষণার দাবি জানিয়ে ভিসিকে স্মারকলিপি দিয়েছে জাসদ সমর্থিত বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
এতে তারা উল্লেখ করেন, ডাকসু নির্বাচন কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীসহ দেশের সব গণতান্ত্রিক মহলে আশাবাদ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ভোটগ্রহণে বিভিন্ন অনিয়ম, নির্বাচনে ভোটগ্রহণে দায়িত্বরত শিক্ষকদের ব্যর্থতা, অসহযোগিতা নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। যদিও কুয়েত মৈত্রী হলে প্রশাসনের ত্বরিত ব্যবস্থা প্রশংসনীয়। তবে একই সঙ্গে অপর ১৭টি হলে অনিয়মের বিষয়ে উদাসীনতা ছাত্র সমাজকে হতাশ করেছে। রোকেয়া হলের ঘটনায় প্রতিবাদকারী ছাত্রনেতা ও ছাত্রছাত্রীদের বিরুদ্ধে হল প্রশাসনের প্রত্যক্ষ ইন্ধনে যে মামলা হয়েছে তা উদ্বেগজনক।
স্মারকলিপি দেয়ার সময় উপস্থিত ছিলেন- বাংলাদেশ ছাত্রলীগের (জাসদ) কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি আহসান হাবিব শামীম ও সাধারণ সম্পাদক রাশিদুল হক ননী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির সভাপতি মাসুদ আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক চন্দ্রনাথ পাল, ভিপি পদপ্রার্থী রাকিবুল ইসলাম, জিএস পদপ্রার্থী শাফিকা রহমান শৈলী, এজিএস পদপ্রার্থী মো. জহুরুল ইসলামসহ কেন্দ্রীয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতারা।
নির্বাচন বাতিলের দাবি ছাত্র মৈত্রীর : এদিকে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়ে পুনঃনির্বাচন দাবি করেছে বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী। সংগঠনটির সভাপতি ফারুক আহমেদ রুবেল ও সাধারণ সম্পাদক কাজী আবদুল মোতালেব জুয়েল এক বিবৃতিতে এ দাবি জানান। এতে বলা হয়, নানা অনিয়মের খবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ২৮ প্রজন্মের স্বপ্নের ডাকসু নির্বাচনকে বিতর্কিত এবং প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তাই আমরা পুনঃনির্বাচন দাবি করছি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন