প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের মুখস্থ বিদ্যার প্রতিফলন ঘটে; মেধা ও দক্ষতার নয়। এতে করে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়; বিভিন্ন স্তর অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের কৃতিত্ব মূল্যায়ন করা সম্ভব হয় না।Ñ এমন অনুধাবন থেকে শিক্ষার্থীদের মুখস্থ নির্ভরতা কমিয়ে প্রকৃত মেধা যাচাইয়ের লক্ষ্যে ২০০৮ সাল থেকে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করে সরকার। কিন্তু এ প্রশ্ন-পদ্ধতি চালুর পর ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও সুফল মিলছে না। কেন? এমন প্রশ্নে সংশ্লিষ্টরা বলছেনÑ শিক্ষকদের যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তা প্রায়োগিক ক্ষেত্রের জন্য খুবই অপ্রতুল। উপরন্তু রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে নিয়মিত চর্চার অভাব। এসব কারণে ১০ বছর পেরিয়ে এসেও সৃজনশীলতায় দক্ষতা অর্জন করতে পারেননি অধিকাংশ শিক্ষক; বাইরে থেকে সংগৃহীত প্রশ্নে পরীক্ষা নিতে হচ্ছে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। সব মিলিয়ে যে উদ্দেশ্যে সৃজনশীলতার যাত্রা শুরু, এতদিন পরও সেই উদ্দেশ্য থেকে গেছে অধরা। এখনো সৃজনশীলতা নিয়ে ধুঁকছেন শিক্ষকরা। এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে যেসব তথ্য উঠে এসেছে, তা খুবই উদ্বেগজনক।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের সর্বশেষ একাডেমিক সুপারভিশন প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, বিদ্যালয়ের নিজস্ব শিক্ষকদের ৬৫.২০ শতাংশ সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়ন করতে পারেন।
অবশিষ্ট ৩৪.৮০ শতাংশ শিক্ষক সৃজনশীল বোঝেন না। অঞ্চলভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়Ñ সৃজনশীল প্রশ্নে সর্বাধিক দক্ষ চট্টগ্রাম। এ অঞ্চলের শিক্ষকদের মধ্যে ৮৫.৯২ শতাংশ সৃজনশীলে দক্ষ। আর সৃজনশীল প্রশ্ন সবচেয়ে কম প্রণয়ন করতে পারেন রংপুরের শিক্ষকরা। এ অঞ্চলের মাত্র ৪৭.৭৯ শতাংশ শিক্ষক সৃজনশীল বোঝেন। অর্থাৎ অর্ধেকেরও বেশি শিক্ষক এ পদ্ধতিতে অদক্ষ। এ ছাড়া ঢাকা অঞ্চলের ৩৪.৪৭ শতাংশ, ময়মনসিংহের ২৭.৬৬, সিলেটের ৪৮.৭২, রাজশাহীর ৫০.৪২, খুলনার ২২.২৮, বরিশালের ২৭.৬৬ এবং কুমিল্লার ২৯.০৬ শতাংশ শিক্ষক সৃজনশীল পদ্ধতি বোঝেন না। সব অঞ্চল মিলিয়ে দেশের ৭ হাজার ১৭৬ বিদ্যালয়ে চলে এই সুপারভিশন। এর মধ্যে ৪ হাজার ৬৭৯ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সৃজনশীল প্রদ্ধতিতে প্রশ্ন প্রণয়ন করতে পারেন। সৃজনশীল প্রশ্ন আংশিক প্রণয়ন করতে পারেন ১ হাজার ৭৮০ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা। নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের প্রশ্ন প্রণয়ন করতে না পারার কারণে বাইরে থেকে প্রশ্নপত্র কিনে পরীক্ষা নেয় ৭১৭ বিদ্যালয়।
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সৃজনশীল একটি যুগোপযোগী পদ্ধতি। এ শিক্ষাব্যবস্থা বিশ্বের অনেক দেশেই প্রচলিত। তবে কেন বাংলাদেশে এর যথার্থ প্রয়োগ সম্ভব হচ্ছে না? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, শিক্ষকদের যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, তা খুবই অপ্রতুল। নামকাওয়াস্তে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কারণে তারা দক্ষতা অর্জন করতে পারছেন না। তিনি বলেন, শিক্ষকদের মাত্র তিন দিন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। অথচ এর সুফল পেতে হলে তাদের ন্যূনতম তিন মাস প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত ছিল।
সৃজনশীল পদ্ধতি ও শিক্ষকদের করণীয়
উদ্দীপক ও দৃশ্যকল্প ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর জ্ঞান, অনুধাবন, প্রয়োগ, উচ্চতর চিন্তন-দক্ষতা মূল্যায়ন উপযোগী প্রশ্ন পদ্ধতিকে সাধারণভাবে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি বলা যায়। সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতিতে বহুনির্বাচনী ও কাঠামোবদ্ধÑ উভয় ধরনের প্রশ্নই থাকে। সৃজনশীলের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বিশ্লেষণ, সংশ্লেষণ, মূল্যায়ন ও সৃজনী ক্ষমতা বিকশিত হয়। এ প্রশ্ন পদ্ধতির মাধ্যমে দুর্বল, মধ্যম ও ভালো মানের শিক্ষার্থীদের পৃথক করা সম্ভব। সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি মুখস্থনির্ভর নয়। পাঠ্যবই পড়তে উৎসাহ জোগায়।
পাঠক্রম বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যÑ সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতিতে চিন্তন দক্ষতার বিভিন্ন স্তর যেমন- জ্ঞান, অনুধাবন, প্রয়োগ, তুলনা, বিশ্লেষণ, সংশ্লেষণ ও মূল্যায়ন ইত্যাদির ওপর জোর দেওয়া হয়। এ পদ্ধতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে সর্বাধিক কার্যকর ভূমিকা পালন করেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকসহ বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক শ্রেণিশিক্ষকগণ। একজন শিক্ষক যখন সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়ন করবেন, তখন তাকে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, প্রশ্নের মাধ্যমে যেন শিক্ষার্থীর মানসিক তথা সামগ্রিক ভারসাম্যপূর্ণ মেধার বিকাশ ঘটে। এ পরীক্ষা পদ্ধতির মূল লক্ষ্য হচ্ছেÑ শিক্ষার্থীদের মেধার পরিপূর্ণ বিকাশ ও তাদের অধিকতর বুদ্ধিদীপ্ত করে তোলা।
কেন শিক্ষকদের ব্যর্থতা
শিক্ষা-গবেষক খায়রুল আলম মনির বলেন, পাঠক্রম ও সৃজনশীল পদ্ধতির ওপর শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের সময়কাল যথেষ্ট নয়। সৃজনশীল পদ্ধতি সঠিকভাবে না বোঝার কারণে অনেক শিক্ষক নোট ও গাইডবই অনুসরণ করেন। কেউ কেউ সৃজনশীল পদ্ধতি না বুঝেই শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করেন; কেউ সরাসরি গাইডবই থেকেই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি করেন। ২০১৬ সালে এমন ঘটনাই ঘটেছিল। একটি শিক্ষা বোর্ডের জেএসসি পরীক্ষায় বাংলা প্রথমপত্রের প্রশ্ন হুবহু গাইডবই থেকে তুলে দেওয়া হয়েছিল।
প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম সময় প্রশিক্ষণের বিষয়টি স্বীকার করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক প্রফেসর ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক আমাদের সময়কে বলেন, মাত্র তিন দিনের প্রশিক্ষণে শিক্ষকরা বিষয়টি পুরোপুরি অনুধাবন করতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে আমরা ইনহাউস (শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিজস্ব উদ্যোগে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা) প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিচ্ছি। শিক্ষকদের অধিকতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে সবাই প্রশিক্ষণের আওতায় আসবেন।
সৃজনশীল পদ্ধতি নিশ্চিত করতে হলে
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের সর্বশেষ একাডেমিক সুপারভিশন প্রতিবেদনের শেষে কিছু সুপারিশ যোগ করা হয়েছে সৃজনশীল পদ্ধতি নিশ্চিত করার জন্য। এতে বলা হয়েছেÑ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাইরে থেকে প্রশ্নপত্র কেনা পুরোপুরি নিষিদ্ধ করতে হবে। একটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা নিজেরাই যেন প্রশ্নপত্র তৈরি করতে পারেন, সে বিষয়ে তদারকি করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের আঞ্চলিক কার্যালয়ের। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি শিক্ষক নিজেই যখন সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্ন প্রণয়ন করতে পারবেন, তখনই সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল যে লক্ষ্যে, তা অর্জন হবে। এ ক্ষেত্রে প্রতিবেদনে জোর দেওয়া হয়েছে শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদানের ওপর।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন