আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের দু-গ্রুপের রাজনীতির যাতাকলে পড়ে বেশ বিপাকেই আছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম! এমন অবস্থায় ভারপ্রাপ্ত দিয়েই চলছে জাবি প্রশাসন। রেজিস্ট্রার, প্রক্টরসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক বিভাগের প্রধানগণ এখন ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। অন্যদিকে ডিনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও ডিন নির্বাচন না দেয়ায় মেয়াদোত্তীর্ণ ডিন দিয়েই চলছে প্রশাসনের কার্যক্রম। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬টি হলের মধ্যে ৯টি হলের প্রভোস্ট ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। অপরদিকে নানা জটিলতায় অপূর্ণাঙ্গ রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটও।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ অফিস বা বিভাগের অধিকাংশের প্রধানগণই ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্বপালন করছেন। গুরুত্বপূর্ণ ভারপ্রাপ্ত পদের মধ্যে রয়েছে রেজিস্ট্রার, প্রধান প্রকৌশল, কম্পট্রোলার, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন, এস্টেট এবং জনসংযোগ অফিস। এছাড়া ভারপ্রাপ্ত ডিনের সংখ্যা ৯ জন।
এদিকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাওয়া সমাজবিজ্ঞান ও আইন অনুষদের ডিনের স্থালাভিষিক্ত দু’জন ডিন ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া কলা ও মানবিকী অনুষদ, গণিতিক ও পদার্থ বিষয়ক অনুষদ, জীববিজ্ঞান অনুষদ এবং বিজনেস স্টাডিজ অনুষদের ডিনের মেয়াদ শেষ হয়েছে এ বছরের জুনে।
সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৬ সালের ১০ মে। ’৭৩ অ্যাক্টের ২৫(৫) ধারা অনুযায়ী ডিনের মেয়াদ দুই বছর। কিন্তু বর্তমান ডিনের মেয়াদ শেষ হলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ডিন নির্বাচনের জন্য চোখে পড়ার মতো কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করেননি।
অপরদিকে নানা কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পরিচালনা পরিষদ ‘সিন্ডিকেট’ পদশূন্য হয়ে সংকুচিত হয়ে পড়েছে। ’৭৩ অ্যাক্ট অনুযায়ী জাবি সিন্ডিকেটে মোট ১৯টি সদস্য পদ রয়েছে। তবে বর্তমান সিন্ডিকেটের ৬টি পদ শূন্য রয়েছে এবং ৫টি পদ মেয়াদোত্তীর্ণ। আর সচল রয়েছে ৮টি পদ।
অর্থাৎ অ্যাক্টের ২২(১)(ডি) অনুযায়ী সরকারি কলেজের দু’জন অধ্যক্ষ এবং ২২(১)(ই) ধারা অনুযায়ী ডিন, প্রভোস্ট, সহকারী অধ্যাপক ও লেকচারার ক্যাটাগরির ৪টি সদস্য পদ এখন শূন্য রয়েছে।
এছাড়া অ্যাক্টের ২২(১)(এফ) ধারা অনুযায়ী রেজিস্ট্রার্ড গ্র্যাজুয়েট ক্যাটাগরিতে ২টি পদ ও ২২(১)(আই) অনুযায়ী একটি সহ মোট তিনটি পদ নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। সর্বশেষ রেজিস্ট্রার্ড গ্র্যাজুয়েট নির্বাচনের সিনেটর হিসেবে অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির ও মো. মোতাহার হোসেন মোল্লা নির্বাচিত সিন্ডেকেট সদস্য ছিলেন। তবে গত বছর ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হওয়া রেজিস্ট্রার্ড গ্র্যাজুয়েট নির্বাচনে আবারও তারা সিনেট সদস্য হন। কিন্তু ২০১৭ সালের ২৯ জুলাই সিন্ডিকেটে তাদের মেয়াদ শেষ হয়। নতুন সিনেট থেকে কারা সিন্ডিকেট সদস্য হবেন তার জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়ায় কারা এ পদে সদস্য হবেন এবং হবেন না, সদস্য পদ শূন্য থাকবে এ নিয়ে চলছে বির্তক।
প্রশাসনিক সূত্রে জানা যায়, এ ক্যাটাগরিতে সিন্ডিকেট সদস্য কারা এ বিতর্কের জন্য ২০১৮-১৯ সেশনের ক্যালেন্ডার প্রকাশ করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বলছেন, প্রশাসনের ভেতরে এভাবে ভারপ্রাপ্তদের রাজত্ব চলতে থাকলে অচিরেই নাজুক অবস্থা সৃষ্টি হবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মধ্যে। নানা সমস্যার মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।
এসব বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক উপাচার্য ব্রেকিংনিউজকে বলেন, ‘কোনও পদেই স্থায়ীভাবে ভারপ্রাপ্তদের দায়িত্ব দেয়া সমীচীন নয়। এতে দায়িত্বপ্রাপ্তদের মধ্যে ইতস্ততবোধ কাজ করে। আর কোনভাবেই সিন্ডিকেট অপূর্ণাঙ্গ রাখা ঠিক নয়।’ দ্রুততম সময়ে নির্বাচনের মাধ্যমে সিন্ডিকেট ও ডিনের পদগুলো পূর্ণ করা জরুরি বলেও মনে করেনি তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘ভারপ্রাপ্ত ও অনির্বাচিত বা মেয়াদোত্তীর্ণ অফিসিয়ালদের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করলে অদূর ভবিষ্যতে তার পরিনাম খারাপের দিকে যেতে পারে।’
তবে এসব বিষয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করেও উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের কোনও মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
প্রসঙ্গত, উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম দ্বিতীয় মেয়াদে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে জাবির আওয়ামীপন্থি শিক্ষকরা দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে যায়। যার একটি অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন উপাচার্য নিজে। অন্য অংশটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক শরিফ এনামুল কবির।
দ্বিতীয় মেয়াদে নিয়োগ পাওয়ার পূর্বে অধ্যাপক শরিফ এনামুল কবিরের আস্থাভাজন ব্যক্তি ছিলেন উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার্ড গ্র্যাজুয়েট নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের সাথে মতাপার্থক্য সৃষ্টি হয় অধ্যাপক শরিফ এনামুল কবিরের। তখন থেকে তিনি তাঁর অনুগত শিক্ষকদের নিয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের দ্বিতীয় মেয়াদে নিয়োগের বিরোধিতা করে আসছেন।
এমন অবস্থায় অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম দ্বিতীয় মেয়াদে নিয়োগ পাওয়ার পর সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক শরীফপন্থি শিক্ষকদের প্রশাসনের বিভিন্ন পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে নিজের অনুগত শিক্ষকদেরকে দায়িত্ব দেন। বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের অধিকাংশ সদস্য অধ্যাপক শরীফপন্থি হওয়ায় বর্তমান উপাচার্য ফারজানা সিন্ডিকেট সভা ডাকছেন না বলেও অভিযোগ রয়েছে। যার কারণে প্রশাসনের কোনও পদে কাউকে স্থায়ীভাবে নিয়োগ দেয়া যাচ্ছে না। তাই ভারপ্রাপ্তদের রাজত্বেই চলছে জাবি প্রশাসন।
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন