সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। আজ রোববার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে আয়োজিত সমাবেশের পর এ হামলার ঘটনা ঘটে।
সারা দেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা, মামলা, জেল ও বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ছাত্র-শিক্ষক নিপীড়নের প্রতিবাদে সর্বস্তরের ছাত্রসমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল রাজু ভাস্কর্যের সামনে। সেই সমাবেশ শেষ হওয়ার পর তাদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। এতে কয়েকজন আহত হয়েছেন বলে জানান আন্দোলনকারীরা।
এদিকে সমাবেশ থেকে কোটা সংস্কার, গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তি, আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা ও শিক্ষক লাঞ্ছনার বিচার এবং নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবিতে আগামী ২৫ জুলাই বুধবার সারা দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একযোগে বিক্ষোভ কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কোটা সংস্কার করা, আন্দোলনে হামলাকারীদের বিচার, আটককৃতদের মুক্তি ও বিভিন্ন স্থানে ছাত্র-শিক্ষকের ওপর হামলা ও লাঞ্ছনার প্রতিবাদে আজ বিকেল ৩টায় রাজু ভাস্কর্যের সামনে ছাত্র সমাবেশের ডাক দেয় আন্দোলনকারীরা। সমাবেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’র কেন্দ্রীয় নেতারা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী অংশ নেয়। সমাবেশে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন লেখা সম্বলিত প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেন। তাতে লিখা ছিল, ‘ভাইয়ে রক্তে ভেজা ক্যাম্পাসে কীভাবে বসি ক্লাসে?’, ‘ছাত্ররা জেলে নয়, ক্লাসে থাকবে’, ‘কেতাবি অধিকার নয়, রক্তে অর্জিত সংবিধান চাই’, ‘হামলাকারীরা হুঁশিয়ার-সাবধান’, ‘কোটা করো সংস্কার, হামলাকারীদের করো বহিস্কার’ ইত্যাদি।
আজ ছাত্রসমাবেশ শুরু হলে রাজু ভাস্কর্যের আশেপাশে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় ও বিভিন্ন হল ইউনিটের নেতাকর্মীরা অবস্থান নেন। তারা সমাবেশে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ছবি তুলেন। এ সময় ছাত্রলীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক দিদার মো. নিজামুল হক বলতে থাকেন, ‘এখান থেকে একটাও যেতে পারবে না, সবকটাকে দেখে নেব।’ প্রায় সাড়ে ৫টার দিকে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করে সমাবেশের সমাপ্তি ঘোষণা করেন আন্দোলনের যুগ্মআহ্বায়ক বিন ইয়ামিন মোল্লা।
কর্মসূচি শেষ করে আন্দোলনকারীরা যে-যার মতো ফিরে যাচ্ছিলেন। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আগে থেকেই বিচ্ছিন্নভাবে আশেপাশের এলাকায় অবস্থান করছিলেন। টিএসসি সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান দিয়ে যাওয়ার সময় আন্দোলনকারীদের ওপর অতর্কিত হামলা চালান ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক দিদার মো. নিজামুল হক, জিয়া হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল মাসুদ লিমন, জিয়া হল ছাত্রলীগের উপকর্মসূচি ও পরিকল্পনাবিষয়ক সম্পাদক আসিবুল হক শান্তসহ আরও বেশ কয়েকজন হামলা চালান। এতে বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারী আহত হন।
সমাবেশ শেষে আন্দোলনের যুগ্মআহ্বায়ক সোহরাব হোসেন, রাতুল সরকার ও নিয়াজী একটি সিএনজি চালিত অটোরিকশায় করে এবং আরেকটি ট্যাক্সি করে যুগ্মআহ্বায়ক আতাউল্লাহ ও বিন ইয়ামিন ফিরে যাচ্ছিলেন। এ সময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা মোটরসাইকেল নিয়ে তাদের পিছু নেন। এক পর্যায়ে রাজধানীর কাটাবন এলাকায় সিএনজি থামিয়ে সোহরাব, রাতুল ও নিয়াজী মারধর করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সদ্য বিলুপ্ত কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক সাউদুর রহমান উজ্জ্বল, জহুরুল হক হল ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আমির হামজাসহ ছাত্রলীগের অন্তত আট-দশজন নেতাকর্মী। তাদের তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হলেও পারেনি।
এ বিষয়ে সাইদুর রহমান উজ্জ্বল জানান, তারা তিনজন বাটা সিগনাল দিয়ে যাচ্ছিলেন। একটা সিএনজি তার বাইকের পেছনে ধাক্কা দেয়। তারা তখন সিএনজি থামিয়ে ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলেন। ড্রাইভারের সঙ্গে তর্কাতর্কি হয়। ভিতরে তিনজন ছেলে ছিল, ওদের তিনি চিনেন না। ওদের সঙ্গে কোন ঝামেলা হয়নি। ওরা যার যার মতো চলে গেছে।
এর আগে সমাবেশে বিন ইয়ামিন মোল্লা বলেন, ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। অথচ এই আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত করে একটি কুচক্রী মহল প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করলেও আমাদের ওপর হামলা চালানো হচ্ছে। হামলা চালিয়ে আবার আমাদেরকেই আটক করে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হচ্ছে। তবে যতদিন পর্যন্ত দাবি আদায় না হবে ততদিন এই আন্দোলন ও কর্মসূচি চলবে।’
সমাবেশে কান্নাজড়িত কন্ঠে প্রধানমন্ত্রীর কাছে রাশেদের মুক্তি দাবি করে তার মা সালেহা খাতুন। তিনি বলেন, ‘একটা সরকারি চাকরি ছাড়া আমার বাবার অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। আমার বাবা কোনো অপরাধ করেনি, কেন রিমান্ডে নিয়ে তার ওপর অত্যাচার করা হলো? সে কোনো দল করে না, কোনো রাজনীতির মধ্যে জড়িত নেই। তাকে আগের জীবনে ফিরিয়ে দিয়ে লেখাপড়া করার সুযোগ করে দিন। মা হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর নিকট আমার ছেলের মুক্তি দাবি করছি।’
গভীর রাতে নুরের কক্ষের বই বের করার অভিযোগ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে
এদিকে গতকাল শনিবার গভীর রাতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হক নুরের কক্ষে গিয়ে ছাত্রলীগ তাদের অনুসারী তুলে দিয়ে নুরের বইখাতা বের করে দিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে পরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর ও হল প্রাধক্ষ্যের হস্তক্ষেপে ছাত্রলীগ ওই কক্ষে তাদের অনুসারী তুলতে পারেনি।
জানা গেছে, শনিবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে হাজী মুহম্মদ মুহসীনহল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান সানীর অনুসারী ও হল শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি আরিফ হোসেন, যুগ্ম সম্পাদক আরাফাত হোসেন জৌতিসহ অন্তত ২০ জন ছাত্রলীগকর্মী নুরুর কক্ষে গিয়ে (নম্বর ১১৯) তার রুমমেট নাজিমকে কক্ষ থেকে বের হয়ে ১১১ নম্বর কক্ষে যেতে বলে। তারা নুরুর বইপত্র বের করে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার কথা বলে। উপস্থিত ছাত্রলীগের কর্মীরা নুরুর বইপত্রগুলো নিয়ে হলের সিঁড়ির কাছে রাখে। পরে রাত আড়াইটার দিকে মুহসীন হলের সহকারী আবাসিক শিক্ষক মোহাম্মদ আইনুল ইসলাম এসে বইপত্রগুলো কক্ষের ভিতরে নিয়ে আসেন।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক গোলাম রাব্বনী বলেন, হল প্রশাসনকে সমন্বয় করে প্রক্টরিয়াল টিম পাঠিয়ে বিষয়টি সমাধান করা হয়েছে।আস
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন