রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার নারায়ণজন গ্রামের বর্গাচাষি আনারুল ইসলাম চাষাবাদের পাশাপাশি প্রতিবছর কোরবানির ঈদে বিক্রির জন্য গরু মোটাতাজা করেন। গত কোরবানির ঈদে লাভের আশায় সাতটি গরু বাজারে তুলেছিলেন। চার হাট ঘুরে একটি গরুও বিক্রি করতে পারেননি তিনি। খরচ সামলাতে না পেরে ঈদের মাস দুয়েক পর মাংস ব্যবসায়ীর কাছে ৩০ হাজার টাকা লোকসানে চারটি গরু তিন লাখ টাকায় বিক্রি করে দেন। আনারুলের মতো গত ঈদে অনেক খামারি ধরা খেয়েছেন। লাখো প্রান্তিক খামারির ২১ লাখ ৫০ হাজার ২৩৭টি পশু অবিক্রীত থেকে যায়। ২০২১ সালেও বিক্রি হয়নি ২৮ লাখ পশু। গত এক যুগে প্রতিবছরই বেড়েছে মাংসের উৎপাদন। গরুর মাংসে উদ্বৃত্ত দেশ হওয়া সত্ত্বেও দেশে হিমায়িত গরু ও মহিষের মাংস বৈধ-অবৈধ পথে আসছে টনে টনে। মাংস আমদানির জন্য সরকারি দুই প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) এবং বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) সনদ নেওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু কখনও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম কার্যালয়, আবার কখনও চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় (সিভাসু) পরীক্ষাগারের সনদ দিয়েই আমদানি হচ্ছে মাংস। তবে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম কার্যালয়ের ল্যাব না থাকায় তাদের সনদ দেওয়ার কোনো এখতিয়ার নেই। গত বছরের জুন থেকে মাংস আমদানি করতে হলে আগে থেকেই প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অনুমতি নেওয়ার বিধান করা হয়েছে। সে অনুযায়ী আমদানির অনুমতি নিতে আবেদনও পড়ছে। এখন পর্যন্ত প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় কাউকে আমদানির অনুমতি না দিলেও অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম কার্যালয় থেকে অনুমতি নিয়ে মাংস আমদানি হচ্ছে।
খাবার অযোগ্য এসব মাংস মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বলে সরকারি প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষায়ও ধরা পড়েছে। মাংস দীর্ঘ সময় সতেজ রাখতে ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে ভোক্তাদের জনস্বাস্থ্য যেমন হুমকিতে পড়ছে, তেমনি খামারিদেরও উদ্বেগ বাড়ছে। সমকালের অনুসন্ধানে এমন আতঙ্কের তথ্য মিলেছে বিভিন্ন স্থানে।
এসব বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. নাহিদ রশীদ বলেন, নতুন করে কোনো মাংসের আমদানির অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। আগের এলসির মাংস আসছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম কার্যালয় থেকে কোনো আমদানির অনুমতি দিয়ে থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নীতিমালা অনুযায়ী কোনো পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করা যায় না। কিন্তু আমদানি নিরুৎসাহিত করতে যা যা দরকার, আমরা তা করছি।
যেভাবে অবৈধ পথে মাংস আসে: গত ১৮ জানুয়ারি ভোর সাড়ে ৪টা। তীব্র শীত উপেক্ষা করে ছুটছে ১০-১২টি বাইসাইকেল। প্রতিটি সাইকেলের পেছনে বস্তা। সেই বস্তায় মাংস। এমন দৃশ্য রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আলাইপুর-মীরগঞ্জ সীমান্তের। এ পয়েন্ট দিয়ে দেশে ঢোকানো হচ্ছে ভারতীয় মাংস। আর তা কয়েক হাত বদল হয়ে চলে যাচ্ছে দেশের হোটেল-রেস্তোরাঁয়। মাংস তাজা রাখতে রাসায়নিক মিশিয়ে ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে একটি চক্র। দাম রাখা হয় ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজশাহীর বাঘা উপজেলার এক প্রত্যক্ষদর্শী সমকালের কাছে এমন তথ্য তুলে ধরেন।
আলাইপুর সীমান্তের বিজিবির কোম্পানি কমান্ডার সুবেদার আব্দুর রব বলেন, অসাধু ব্যবসায়ীরা ভারতে গরু জবাই করে বাংলাদেশে মাংস নিয়ে আসছে। খবর পেয়ে গত ১৭ জানুয়ারি সীমান্ত থেকে ৩৫ কেজি ভারতীয় মাংস জব্দও করা হয়েছে। জড়িতদের তালিকা সংগ্রহ করা হচ্ছে। টহল জোরদার করা হয়েছে।
রাজশাহীর মতো এমন চিত্র পাওয়া গেছে সীমান্তবর্তী সাতক্ষীরা, লালমনিরহাট, যশোর ও কুড়িগ্রামের বিভিন্ন এলাকায়।
যেভাবে ছড়িয়ে যাচ্ছে সারাদেশে: অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা থেকে চোরাই পথে আসা মাংস আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে; আবার কোনো ক্ষেত্রে 'ম্যানেজ' করে ঢাকাসহ সারাদেশে চলে যাচ্ছে। রাজধানীর বেশ কয়েকটি পয়েন্ট থেকে এসব মাংস চলে যাচ্ছে হোটেল-রেস্তোরাঁ ও পাড়া-মহল্লার মাংসের দোকানে। তথ্য পেয়ে গত ১০ জানুয়ারি রাজধানীর জুরাইনের বিক্রমপুর প্লাজার পেছনে একটি মার্কেট গিয়ে দেখা যায়, পানির ড্রামে ভিজিয়ে রাখা হয়েছে মাংস। এখানে একজন ভ্যানচালক মাংস নিতে এসেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি জানান, ফুটপাতের ভাতের হোটেল থেকে শুরু করে বড় বড় রেস্টুরেন্টেও তারা পৌঁছে দেন ভারতীয় মাংস।
জুরাইনের জুতার মার্কেটের পেছনে দেখা মিলল আরেকটি প্যাকেটজাত মাংসের দোকান। এখানেও ড্রামের ভেতরে মাংস ভিজিয়ে রাখা হয়েছে। পশ্চিম জুরাইনের তুলা বাগিচায় 'আল্লাহর দান গোস্ত বিতান'; এখানে ভারতীয় মহিষের মাংস বিক্রি হচ্ছে। দোকানের কর্মচারীরা প্যাকেটে থাকা বড় মাংস ড্রাম থেকে তুলে পিস পিস করে কাটছে। এ কাটা মাংস প্যাকেট হয়ে চলে যাচ্ছে বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরাঁয়।
জুরাইন বালুরমাঠ বাজারে রয়েছে 'মায়ের দোয়া গোস্ত বিতান'। এখানে গিয়ে দেখা যায়, ঝুড়িতে রাখা হয়েছে মাংস। সেখান থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। রাজধানীর নিউমার্কেট মাংসের বাজারের বেশ কয়েকটি দোকানেও এসব মাংস বিক্রি হতে দেখা যায়। এখানকার এক ব্যবসায়ী বলেন, আগে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা কেজি ছিল। এখন তা ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ মাংসের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দামও বেড়েছে।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে গত ১৫ জানুয়ারি ভোর সাড়ে ৪টায় সরেজমিন দেখা গেছে, মাংসের দোকানগুলোতে সদ্য জবাই করা গরুর বিভিন্ন অংশ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এক পাশে জবাই করা গরুর মাংস ছোট ছোট করে কাটা হচ্ছে, অন্য পাশেই কার্টন ও পলিথিনের প্যাকেট থেকে প্রক্রিয়াজাতকৃত মাংস বের করে ছোট সাইজ করা হচ্ছে। এ সময় প্যাকেটজাত মাংসগুলো জবাইকৃত গরুর মাংসের সঙ্গে মেশাচ্ছিল দোকানের এক কর্মচারী। এ ছাড়া আরেক দোকানে কার্টন থেকে বড় বড় মাংসের টুকরো নতুন জবাই করা গরুর রক্ত ও পানি মিশিয়ে ঝোলানো হচ্ছে।
একাধিক মাংস দোকানের কর্মচারী জানান, আগে থেকেই চাহিদা দেওয়া তারকা হোটেল, সুপারশপ, অভিজাত রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে চায়নিজ হোটেলে সরবরাহ করা হচ্ছে এসব মাংস। শুধু কারওয়ান বাজারেই প্রতিদিন অন্তত ৪০ থেকে ৫০ মণ প্যাকেটজাত হিমায়িত মাংস গরুর মাংসের সঙ্গে মিশিয়ে বিক্রি হচ্ছে। হোটেল-রেস্টুরেন্টে হিমায়িত মাংসের চাহিদা বেশি। কারণ এসব মাংসে কোনো হাড় বা চর্বি থাকে না। কাবাব ও কালাভুনায় এ মাংস বেশি ব্যবহার হয়।
প্যাকেটজাত মাংসের বিক্রেতারা জানিয়েছেন, আমদানিকারকদের কয়েকটি কোল্ডস্টোরেজ আছে তেজগাঁও শিল্প এলাকায়। গত ১৮ জানুয়ারি সাতরাস্তা এলাকায় বাবলি মসজিদের বিপরীতে কোল্ডস্টোরেজ থেকে একটি ফ্রিজার পিকআপ বের হতে দেখা যায়। কোল্ডস্টোরেজের বিপরীতে একটি হোটেলের কর্মচারী জানান, ভারতীয় মাংস এখান থেকে চলে যায় ঢাকার বিভিন্ন হোটেলে।
২০১৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি তেজগাঁওয়ের তিনটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের হিমাগারে অভিযান চালিয়ে র্যাব-২ দুম্বা ও মহিষের মেয়াদোত্তীর্ণ ৮০০ মণ মাংস জব্দ করে। এগুলো নতুন মোড়কে প্যাক করে রাজধানীর পাঁচতারকা হোটেলসহ ২৬৮টি রেস্টুরেন্টে সরবরাহ করা হতো বলে তখন জানিয়েছিল র্যাব। সে সময় তিনটি প্রতিষ্ঠানের ১৮ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড এবং ৪৩ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এর পর আর কোনো বড় অভিযান পরিচালিত হয়নি।
হোটেলের খাবার প্লেটে হিমায়িত মাংস: রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে বেশ কিছু ভাতের হোটেল আছে। প্রতিটি হোটেলের কড়াইতে কালাভুনা গরম হচ্ছে। একটি হোটেলের কর্মচারীর সঙ্গে কথা হয় সমকালের। তিনি জানান, মতিঝিল, গুলিস্তান, সায়েদাবাদসহ আশপাশের সব রেস্টুরেন্টে গরুর মাংস দিয়ে যায় শনির আখড়া ও জুরাইনের কয়েকজন মাংস বিক্রেতা। বেশি মসলা দিয়ে রান্না অথবা কালাভুনা করায় বোঝার উপায় থাকে মাংসে সমস্যা আছে।
রাজধানীর ব্যাংকপাড়া হিসেবে খ্যাত মতিঝিলে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত মানুষ গিজগিজ করে। মধ্যবিত্তরা ভিড় করেন রেস্টুরেন্টে আর অল্প আয়ের মানুষ যান ফুটপাতের ভাতের হোটেলে। এখানকার কয়েকটি হোটেলের কর্মচারীরা জানান, জুরাইন থেকে ভোরে ভ্যানে করে হোটেলগুলোতে প্যাকেটজাত মাংস দিয়ে যায়। দাম ৪০০-৫০০ টাকা। এ ছাড়া ঢাকার অন্তত ২০টি হোটেলে অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে, সেখানে ভারত থেকে আসা হিমায়িত মাংসই বেশি বিক্রি হচ্ছে।
বৈধ পথেও আসছে মাংস: গত ২৪ এপ্রিল নতুন বাণিজ্যনীতি কার্যকর হওয়ার পর ভারত থেকে মাংস আমদানিতে কিছু কঠোরতা আরোপ করা হয়। আমদানি করতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অনুমোদন প্রয়োজন। এ ছাড়া ২০২১-২২ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে মাংস আমদানিতে ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক্ক আরোপ করা হয়। এ অবস্থায় ভিন্ন কৌশল নিয়েছেন অনেকে। আমদানিকারকরা অফাল (গরু-মহিষের মাংস ছাড়া পায়া, নাড়িভুঁড়ি, জিহ্বাসহ অন্যান্য) ঘোষণা দিয়ে মাংস আমদানি করছেন। অফালের ওপর শুল্ক্ক ৫ শতাংশ। অফাল ঘোষণা দিয়ে মাংস আমদানির অভিযোগে চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানাও করেছে। পাশাপাশি পুরোনো এলসির মাংসও দেশে আসছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, এখানে বড় সিন্ডিকেট জড়িত। কাস্টমস কর্মকর্তাদের সহায়তায় অসাধু ব্যবসায়ীরা অবৈধভাবে মহিষের মাংস দেশে আনছেন। এ ছাড়া প্রতি কনটেইনারে ঘোষণা দিয়ে যে পরিমাণ মাংস আনার কথা, তার চেয়ে বেশি আনা হচ্ছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে ৭৫ দশমিক ২ লাখ টন মাংসের চাহিদার বিপরীতে প্রায় ৯২ দশমিক ৬৫ লাখ টন মাংস উৎপাদন হয়। অর্থাৎ চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি। বাংলাদেশ মিট ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমআইটিএ) জানিয়েছে, বাংলাদেশ সাধারণত বছরে ১০ থেকে ১২ হাজার টন হিমায়িত মাংস আমদানি করে।
২০২২ সালের ছয় মাসের আমদানি চিত্র: গত বছরে যে মাংস আমদানি হয়েছে, তার মধ্যে ছয় মাসের তথ্য চট্টগ্রাম কাস্টমসের একটি সূত্র থেকে পাওয়া গেছে। তাতে দেখা যায়, জুনে ১৫ লাখ ৪৭ হাজার ৪০০ কেজি, জুলাইয়ে ১ লাখ ১৮ হাজার ৫০০ কেজি, আগস্টে ২ লাখ সাড়ে ১২ হাজার কেজি, সেপ্টেম্বরে ১ লাখ ৪০ হাজার, নভেম্বরে ১১ হাজার এবং ডিসেম্বরে ৬৩ হাজার ৪০০ কেজি মাংস আমদানি হয়েছে। তবে এর বাইরে অঘোষিত অনেক বেশি মাংস এসেছে ভিন্ন উপায়ে।
খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) সভাপতি মোহাম্মদ ইমরান হোসেন বলেন, বিভিন্ন পাঁচতারকা হোটেল ও দূতাবাসের জন্য ভারত থেকে মাংস আমদানির কথা বললেও বাস্তবে এসব মাংস রাজধানীর বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে বিক্রি হচ্ছে। আমদানি করা এ মাংস দেশের জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি বয়ে আনবে এবং দেশীয় মাংস শিল্পের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করবে।
স্বাস্থ্যঝুঁকি: গত বছরের অক্টোবরে সাভারে অবস্থিত প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের আওতাধীন প্রাণিসম্পদ উৎপাদন উপকরণ ও প্রাণিজাত খাদ্যের মান নিয়ন্ত্রণ গবেষণাগার (কিউসি ল্যাব) রাজধানীর জুরাইনের দুটি দোকান থেকে মাংস নিয়ে পরীক্ষা করে। দুই নমুনার প্রতিটির তিনটি বিষয়ে (প্যারামিটার) পরীক্ষা করে দেখা হয়। এগুলো হলো- সালমোনেলা, অ্যারোবিক প্লেট গণনা ও অ্যান্টেরোব্যাকটেরিয়াসি পরীক্ষা। এতে সালমোনেলা শনাক্ত না হলেও অ্যারোবিক প্লেট সংখ্যা ও অ্যান্টেরোব্যাকটেরিয়াসি অনেক বেশি, যা গাইডলাইন অনুযায়ী ক্ষতিকর ও খাওয়ার অনুপযোগী।
গবেষণাগারের জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (মাইক্রোবিয়াল ফুড সেফটি শাখা) ড. মো. আল-আমীন বলেন, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ইউরোপীয় কমিশনের গাইডলাইন অনুযায়ী পরীক্ষা করা হয়েছে। মোট অ্যারোবিক প্লেট যদি কোনো মাংসের প্রতি গ্রামে ১০ লাখের বেশি পাওয়া যায়, তা খাওয়ার অনুপযোগী। মাংসগুলোর প্রথম নমুনায় প্রতি গ্রামে ৫৫ লাখ পেয়েছি, যা সহনীয় মাত্রার চেয়ে সাড়ে চার গুণ বেশি। এ ছাড়া দ্বিতীয় নমুনায় পেয়েছি ৬০ লাখ, যা সহনীয় মাত্রার চেয়ে ৫ গুণ বেশি। কোনো মাংসের প্রতি গ্রামে অ্যান্টেরোব্যাকটেরিয়াসি ১ হাজার পাওয়া যায়, তাহলে তা খাওয়ার অনুপযোগী। প্রথম নমুনায় আমরা প্রতি গ্রামে পেয়েছি ১ হাজার ৬০০ এবং দ্বিতীয় নমুনায় পেয়েছি সাড়ে ৭ হাজার অ্যান্টেরোব্যাকটেরিয়াসি।
বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদের মহাপরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবীর সমকালকে বলেন, সঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাত না করার কারণে অনেক ক্ষেত্রে গরুর মাংসের পুষ্টিগুণ নষ্ট হচ্ছে। এ বিষয়ে সংশ্নিষ্টদের সতর্ক থাকতে হবে।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মো. আব্দুল কাইউম বলেন, নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য নিশ্চিত করতে চারজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কাজ করছেন। হোটেল-রেস্তোরাঁয় মানহীন মহিষের মাংসের বিষয়েও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. এমদাদুল হক তালুকদার বলেন, আমদানি-রপ্তানির বাণিজ্য নীতি অনুমোদন হওয়ার পর থেকে অনেক আবেদন এলেও অনুমতি দেয়নি। কিন্তু গত ২৭ ডিসেম্বরও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম কার্যালয় থেকে মাংস আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে বলে তথ্য-প্রমাণ সমকাল তাঁকে সরবরাহ করে। ওই দিন নারায়ণগঞ্জের এমবি ট্রেডিং নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে ২৮ হাজার ২ কেজি মহিষের মাংস আমদানির অনুমতি দেয় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম কার্যালয়। এ বিষয়ে এমদাদুল হক তালুকদার বলেন, বিষয়টি তিনি জানেন না। চট্টগ্রাম থেকে অনুমতি দেওয়ার সুযোগ নেই। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান তিনি।
মহাপরিচালক বলেন, মহিষের মাংসের অবৈধ আমদানির বিষয়ে আমরা খোঁজখবর নিচ্ছি। শিগগিরই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, মাংসের মান নিশ্চিত করতে আমরা চলতি বছর থেকে লাইসেন্স চালু করেছি। মাংস থেকে রোগবালাই যেন মানবদেহে প্রবেশ করতে না পারে, সে জন্য যত্রতত্র পশু জবাই করতে পারবেন না মাংস বিক্রেতারা। কসাইখানায় পশু নিয়ে জবাই দিতে হবে। সেখানে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা আছে, নিরাপদ জবাইয়ের মাধ্যমে মাংস সরবরাহ করতে হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন