বাজারে বিক্রি হওয়া নানান ধরনের কোমল পানীয়, ফাস্টফুড এবং চিপসের মতো প্যাকেটজাতকরণ খাবারে দেওয়া উপাদানের মাত্রায় অনিয়ম পাওয়া গেছে। এছাড়াও যেসব উপাদান দিয়ে এসব খাবার তৈরি হয় তার অনেকগুলো স্বাস্থ্য সম্মতও নয়। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকরা বলছেন, এসব খাবার অসংক্রামক রোগের পাশাপাশি স্থূলতা বৃদ্ধিসহ মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। ডায়াবেটিস, বিষণ্নতা, স্ট্রোক ও ক্যানসারের মতো মারণ ব্যধিতে আক্রান্তের সম্ভাবনাও আছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) খাদ্যে ক্ষতিকারক উপাদানের উপস্থিতি (ফুড হ্যাজার্ড) নিয়ে তিনটি গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে। সোমবার বিএসএমএমইউর শহীদ ডা. মিল্টন হলে প্রকাশিত ওই গবেষণায় স্বাস্থ্যঝুঁকির এসব তথ্য উঠে এসেছে।
এতে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য ও সমাজ কল্যাণ বিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা ও বিএমআরসির সভাপতি অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী। পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের উদ্যোগে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে তত্ত্বাবধায়ক গবেষক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. খালেকুজ্জামান।
অনুষ্ঠানে অন্য বক্তারা বলেন, আমরা আমাদের প্রিয় সন্তানদের জন্য কষ্টের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ খরচ করে কী কিনে আনছি কী খাচ্ছি তা নিয়ে ভাববার সময় এসেছে। খাদ্য সামগ্রী উৎপাদক ও ব্যবসায়ীবৃন্দের জাতির প্রতি কমিটমেন্ট থাকতে হবে। প্রতারণা, ছাল চাতুরী বন্ধ করতে হবে। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে এবং সম্মিলিত পর্যায়ে কাজ করতে হবে।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, ঢাকার বাজারে বিক্রি হওয়া ঠান্ডা-পানীয় স্বাস্থ্যে জন্য ক্ষতিকারক উপাদান বিষয়ে গবেষণাটি করেন ডা. এএইচএম গোলাম কিবরিয়া। তিনি বলেন, বাংলাদেশে মোট মৃত্যুর ৬৭ শতাংশের এর জন্য অসংক্রামক রোগ দায়ী। চিনি, ক্যাফেইন, ভারী ধাতু ইত্যাদিযুক্ত কোমল পানীয় অসংক্রামক রোগের পাশাপাশি শিশুদের স্থূলতার পরিমাণ বৃদ্ধি করতে ভূমিকা পালন করে। ঢাকা শহরের বাজারে পাওয়া সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া পেট-বোতলজাত ব্র্যান্ডের দশটি কোমল পানীয় এবং পাঁচটি এনার্জি ড্রিংকের নমুনা কিনে হয়েছিল। প্রায় তিন-চতুর্থাংশ পানীয়ের পিএইচ মাত্রা ৩ এর নিচে ছিল। অ্যাসিডিক মাত্রা ৩ এর নিচে থাকায় তা দাঁতের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হতে পারে। একটি পরিবেশনে (২৫০ মিলি) মোট চিনির পরিমাণ কোমল পানীয়ের জন্য ২০.৮ ২৮.৮ গ্রাম এবং এনার্জি ড্রিংকের জন্য ২২.৬-৩৭.০ গ্রাম পাওয়া গেছে। (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী একজন প্রাপ্তবয়স্কের জন্য একদিনে সর্বোচ্চ চিনি গ্রহণ মাত্রা ২৫ গ্রাম। অধিকাংশ পানীয়ের বেলায়ই একটি পরিবেশন দৈনিক সর্বোচ্চ মাত্রা পূরণ করে ফেলতে পারে। কোমল পানীয়ের তুলনায় এনার্জি ড্রিংকে ক্যাফেইনের মাত্রা বেশি ছিল। ক্যাফেইনের জন্য বিএসটিআই অনুমোদিত সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্য মাত্রা ১৪৫ পিপিএম হলেও একটি এনার্জি ড্রিংকে এর মাত্রা পাওয়া গেছে ৩২১.৭ পিপিএম। এক পরিবেশন (২৫০ মিলি) কোমল পানীয় এবং এনার্জি ড্রিংকে সীসার মাত্রা ছিল যথাক্রমে ০.০৫৩ মি.গ্রাম এবং ০.০৪৮ মি.গ্রাম।
ঢাকার বাজারে পাওয়া যায় এমন ফ্রেঞ্চ ফ্রাই এবং ফ্রায়েড চিকেনে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক উপাদান বিষয়ে গবেষণাটি করেন ডা. সাজিয়া ইসলাম। তিনি বলেন, বিশ্ব জুড়ে জনপ্রিয় ফাস্টফুড তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই এবং ফ্রায়েড চিকেন, যা নিম্ন খাদ্যমান ও স্থূলতার সাথে সম্পর্কযুক্ত। প্রায়ই এইসব খাবারে উচ্চমাত্রার সোডিয়াম, ট্রান্স ফ্যাট, ভারী ধাতু (হেবি মেটাল) থাকার কথা শোনা যায় যেগুলো উচ্চক্তচাপ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, বিষণ্নতা, স্টোক, ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। বাংলাদেশের মানুষ, বিশেষ করে শিশু কিশোরদের পছন্দের খাদ্যতালিকায় ফাস্ট ফুড বড় আসন দখল করে আছে যে কারণে তাদের মধ্যে স্থূলতার পরিমাণ বাড়ার পাশাপাশি পরবর্তীতে অসংক্রামক রোগ হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। পাঁচটি সর্বোচ্চ বিক্রিত (দৈনিক বিক্রির পরিমাণ অনুযায়ী) ফ্রেঞ্চ ফ্রাই এবং ফ্রায়েড চিকেনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল। ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের একটি পরিবেশনে (১০০ গ্রাম) গড়ে পাওয়া গেছে। সোডিয়াম-০.৪৫ গ্রাম (এক পরিবেশন ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খেলে দৈনিক অনুমোদিত মাত্রার (২ গ্রাম) চার ভাগের এক ভাগ পরিমাণ খাওয়া হয়ে যাবে)। আর্সেনিক-০.০৯৩ মি. গ্রাম (এক পরিবেশন ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খেলে দৈনিক সর্বোচ্চ অনুমোদিত মাত্রার (০.২২ মি. গ্রাম) ৪২.২৭% পরিমাণ খাওয়া হয়ে যাবে)। ট্রান্স ফ্যাটি এসিড-০.১১ গ্রাম। সিসা-০.০০৩ মি.গ্রাম । ফ্রায়েড চিকেন এর একটি পরিবেশনে (১০০ গ্রাম) গড়ে পাওয়া গেছে। সোডিয়াম-০.৪৬ গ্রাম (এক পরিবেশন ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খেলে দৈনিক অনুমোদিত মাত্রার (২ গ্রাম) চার ভাগের এক ভাগ পরিমাণ খাওয়া হয়ে যাবে)। আর্সেনিক-০.০৫৩ মি. গ্রাম এবং সিসা ০.০০৬ মি. গ্রাম (এক পরিবেশন ফ্রায়েড চিকেন খেলে দৈনিক সর্বোচ্চ অনুমোদিত মাত্রার ৩% গ্রহণ করা হয়ে যাবে, যেখানে দৈনিক অনুমোদিত মাত্রা আর্সেনিকের জন্য ০.২২ মি. গ্রাম এবং সিসার জন্য ০.২৫ মি.গ্রাম)। ট্রান্স ফ্যাটি এসিড-০.১৩ গ্রাম।
বাংলাদেশে সর্বাধিক প্রচলিত প্রক্রিয়াকৃত প্যাকেটজাত খাবারে লবণ, চিনি এবং চর্বির পরিমাণ মূল্যায়ন করা এবং খাদ্যের লেবেলে প্রদত্ত তথ্যের সাথে সামঞ্জস্যতা যাচাই করা বিষয়ে গবেষণা করেন প্রফেসর ড. সোহেল রেজা চৌধুরী। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে রেডি টু-ইট পক্রিয়াকৃত প্যাকেটজাত খাবার বিশ্বব্যাপী অনেক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। উচ্চ পরিমাণে লবণ, চিনি এবং ক্যালরি থাকার কারণে এই খাবার গুলো স্থূলতা এবং খাদ্য-সম্পর্কিত অসংক্রামক রোগের প্রধান অবদানকারী হিসেবে পরিচিত। অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও প্রক্রিয়াজাত খাবারের উৎপাদন বার্ষিক গড়ে ৮% বৃদ্ধি পেয়েছে। দ্রুত নগরায়ণ, ক্রমবর্ধমান আয় এবং খাদ্য শিল্পের সম্প্রসারণকে প্রক্রিয়াকৃত খাবারের চাহিদা বৃদ্ধির চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
তিনি বলেন, খাদ্য নির্বাচনের সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে এবং ক্যালরি সমৃদ্ধ ও পুষ্টিহীন খাবারের ব্যবহার এড়ানোর ক্ষেত্রে ভোক্তারদের সহায়তা করার জন্য যথাযথ পুষ্টি লেবেলিং একান্ত প্রয়োজন। বাংলাদেশের সর্বাধিক প্রচলিত প্রক্রিয়াকৃত প্যাকেটজাত খাবারে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, চর্বি, ক্যালরি, ডায়েটারি ফাইবার, সোডিয়াম, চিনি, এসএফএ এবং টিএফএ এর পরিমাণ মূল্যায়ন করা প্রয়োজন।
গবেষণায় জানানো হয়, বাংলাদেশের আটটি প্রশাসনিক বিভাগে পরিচালিত পারিবারিক জরিপ এবং বাজার সমীক্ষার মাধ্যমে মোট নয়টি সর্বাধিক প্রচলিত প্রক্রিয়াকৃত প্যাকেটজাত খাবার চিহ্নিত করা হয়েছিল। কোন ব্র্যান্ডের পণ্যই টিএলএল সিস্টেম অনুযায়ী ক্ষতিকর উপাদানগুলোতে সবুজ (কম পরিমাণে) এবং এইচএসআর স্কিম অনুযায়ী ৪ বা তার বেশি স্টার পায়নি। একমাত্র মটর ভাজা এইচএসআর সিস্টেমে সর্বোচ্চ গড়ে ২.৫ রেটিং পেয়েছিল। প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ক্যালরি, লবণ, চিনি, এসএফএ এবং টিএফএ এর সঠিক প্রতিবেদন কোনো পণ্যতেই পাওয়া যায়নি। ১০০ গ্রাম লজেন্স/ললিপপ, ভাজা ডাল/মটর এবং দুধের চকোলেট দৈনিক গ্রহণযোগ্য চিনি, লবণ এবং এর স্বাস্থ্যসম্মত মাত্রা অতিক্রম করেছিল। ৭০.৮ শতাংশ নমুনায় কার্বোহাইড্রেট পরিমাণ অতিরিক্ত এবং ৬৬.৭ শতাংশ নমুনায় লবণের পরিমাণ কম রিপোর্ট করা হয়েছিল। ৪৫.৮ শতাংশ নমুনায় এসএফএ, ৩৭.৫ শতাংশ নমুনায় টিএফএ ও ফাইবার এবং ২০.৮ শতাংশ নমুনায় লবণ ও চিনির রিপোর্ট অনুপস্থিত ছিল।
ঢাকাটাইমস
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন