বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা মোকাবেলার জন্য সারাদেশের তাবৎ বিশেষজ্ঞদের জড়ো করছেন। বিশেষ করে জনস্বাস্থ্য নিয়ে যারা নানান সময়ে কাজ করেছেন তাঁদের মতামত এবং পরামর্শকে সবথেকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। শুধু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নয়, যে দেশগুলো করোনা আক্রান্ত হয়েছে সে দেশগুলো করোনা মোকাবেলায় তাঁদের বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসক যে পর্যায়েই যে আছেন না কেন, তাঁদের দ্বারস্থ হচ্ছেন, পরামর্শ নিচ্ছেন এবং নিয়মিত তাঁদের সাথে যোগাযোগ রাখছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আমলাতন্ত্রের মধ্যেই বিষয়টিকে সীমাবদ্ধ করে রেখেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত এই করোনা মোকাবেলার জন্য জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিচ্ছে না এবং তাঁদেরকে সামনেও নিয়ে আসছে না। এর ফলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যে করোনা মোকাবেলা পদ্ধতি, তাঁর পুরোটাই হচ্ছে আমলাতান্ত্রিক, গতানুগতিক এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যহীন। আমাদের বাংলাদেশে বেশ কয়েকজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আছেন, যাদের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। এক্ষেত্রে তাঁদের মতামত নেয়াটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং তাঁদের সাথে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিয়মিত আলাপ আলোচনা করলে এই পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হতো বলে অনেকে মনে করেন। যাদের পরামর্শ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিতে পারে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে-
অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী
অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় চাকরি করেছেন। তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ছিলেন এবং তিনি প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে ২০০৯-২০১৪ সাল পর্যন্ত কাজ করেছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিকল্প প্রতিনিধি হিসেবে বর্তমানে তিনি দায়িত্ব পালন করছেন। অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী কমিউনিটি ক্লিনিক ট্রাস্টের চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের (বিএমআরসি) চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এই কমিউনিটি ক্লিনিক ট্রাস্ট এবং বিএমআরসি- দুটোই করোনা মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। কারণ কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে তৃণমূল পর্যন্ত সচেতনতা তৈরি গেলে সেটি সরকারের জন্য অনেক ইতিবাচক হতে পারতো। কারণ বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সবথেকে বড় এডভান্টেজ হলো যে বাংলাদেশের একদম প্রান্তিক পর্যায়ে স্বাস্থ্য স্থাপনা রয়েছে। ফলে কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে জনগণকে ঘরে থাকার আহ্বান জানালে সেই উপকারটি জনগণ পেত। কিন্তু এখন পর্যন্ত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কমিউনিটি ক্লিনিক ট্রাস্টকে তাঁদের কর্মসূচীর আওতায় অন্তর্ভুক্ত করেননি। এছাড়া গবেষণাগুলোর ক্ষেত্রে বিএমআরসি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারতো। সেই বিএমআরসি-কেও আমলে নেয়া হয়নি।
অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হক
অধ্যাপক আ ফ ম রুহুল হক ২০০৯-১৪ সাল পর্যন্ত স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একাধিক অধিবেশনে তিনি যোগদান করেছেন এবং করোনা শুরু হবার পর তিনি নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন টেলিভিশন টক শোতে কথাবার্তা বলেছেন। সাবেক স্বাস্থ্য মন্ত্রী এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাথে কাজের অভিজ্ঞতা থাকার কারণে অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হক-ও করোনা মোকাবেলার ক্ষেত্রে সরকারকে বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিতে পারতেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই চিকিৎসককেও অজ্ঞাত কারণে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে।
ডা. এবিএম আবদুল্লাহ
ডা. এবিএম আবদুল্লাহ প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ। করোনার ক্ষেত্রে তিনি প্রচার-প্রচারণায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সবগুলো টিভি চ্যানেলে তিনি স্ব-উদ্যোগে, স্বপ্রনোদিতভাবে কথা বলছেন। প্রধানমন্ত্রীকেও তিনি করোনা মোকাবেলার ক্ষেত্রে নানারকম প্রস্তাবনা, সুপারিশ করছেন। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বৈঠকগুলোতে তাঁকে দেখা যাচ্ছে না এবং তাঁর পরামর্শ এখন পর্যন্ত কোথাও নেয়া হয়েছে বলে এমন কোন তথ্য আমাদের কাছে নেই।
ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত
ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই মেয়াদে উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেছেন এবং তাঁর-ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অনেক পরিচিতি এবং বিচরণ রয়েছে। করোনা মোকাবেলার ক্ষেত্রে তিনিও সরকারকে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিতে পারতেন এবং তাঁর মেধাকেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কাজে লাগাতে পারতেন। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে ডা. প্রাণ গোপাল দত্তকেও দূরে সরিয়ে রাখা হচ্ছে।
ডা. দ্বীন মোহাম্মদ নুরুল হক
ডা. দ্বীন মোহাম্মদ নুরুল হক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাথে তিনি একাধিক অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন। জনস্বাস্থ্য বিষয়ে তাঁর প্রভূত অভিজ্ঞতা রয়েছে। অথচ তাঁর অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে করোনার মতো জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি মোকাবেলার ক্ষেত্রে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
আর এমন সব বিশেষজ্ঞদের উপেক্ষা করে শুধুমাত্র মুষ্টিমেয় কিছু আমলা এবং নিজস্ব লোকজন দিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় করোনা মোকাবেলায় যে পরিকল্পনা নিচ্ছে তাতে যেমন নেই সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি, তেমনি নেই করোনা মোকাবেলার ক্ষেত্রে সঠিক এবং বাস্তবায়িত পরিকল্পনা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন