বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের ওষুধশিল্পের সুনাম ও আস্থা ব্যাপক। দেশের বাজার চাহিদার ৯৭ শতাংশ পূরণ করে বিশে^র ১৪৫টির বেশি দেশে রপ্তানি হচ্ছে বাংলাদেশের ওষুধ। গত পাঁচ বছরে ওষুধ রপ্তানি বেড়ে প্রায় দ্বিগুণের কাছাকাছি। এ সাফল্যের বিপরীতে দেশজুড়ে ভেজাল, মেয়াদোত্তীর্ণ ও নিম্নমানের ওষুধের বিপণনে এ খাতের সব সম্ভাবনা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। কার্যকর তদারকির অভাবে দেশের হাজার হাজার ফার্মেসিতে মেয়াদোত্তীর্ণ ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ অবাধে বিক্রি হচ্ছে। বিশেষ করে মফস্বলের ওষুধ ফার্মেসিগুলোকে টার্গেট করে সংঘবদ্ধ চক্র মেয়াদোত্তীর্ণ, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ ছড়িয়ে দিচ্ছে। বেশি মুনাফার আশায় একশ্রেণির বিক্রেতা সচেতনভাবেই এ চক্রে জড়িয়ে পড়ছে। ফলে ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ব্যবহার করে সুস্থতার বদলে ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে লাখ লাখ মানুষ। উল্লেখ্য, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ উৎপাদক কোম্পানিগুলোর তত্ত্বাবধানে ধ্বংস করে ফেলার নিয়ম থাকলেও সেই ওষুধ সংঘবদ্ধ চক্রের মাধ্যমে লেভেল পাল্টে আবার ক্রেতার হাতে চলে যায়। জানা যায়, সম্প্রতি মাত্র দুই মাসে ৩৪ কোটি ৭ লাখ ৬৯ হাজার টাকার মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ধ্বংস করেছে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর। একই সময়ে মেয়াদোত্তীর্ণ, নকল, ভেজাল ওষুধ সংরক্ষণের দায়ে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ১ কোটি ৭৪ লাখ ৯৪ হাজার টাকা জরিমানাও আদায় করা হয়েছে। এ নিয়ে বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত একটি হাই কোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ পরবর্তী আদেশের জন্য ১২ ডিসেম্বর দিন ঠিক করেছে। এর আগে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরকে বাজারে থাকা ভেজাল ওষুধের বিষয়ে অভিযান চালানোর নির্দেশ দেয় হাই কোর্ট। গত ১ আগস্ট থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত মেয়াদোত্তীর্ণ, নকল, ভেজাল ওষুধ বিক্রয়ে গৃহীত কার্যক্রম শীর্ষক ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের একটি প্রতিবেদন ১৯ নভেম্বর আদালতে উপস্থাপন করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, এই সময়ে ১৩ হাজার ৫৯৩টি ফার্মেসি পরিদর্শন করে মোবাইল কোর্টে ৫৭২টি মামলা করা হয়। এতে ১ কোটি ৭৪ লাখ ৯৪ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। একই সঙ্গে মেয়াদোত্তীর্ণ, নকল, ভেজাল ওষুধ সংরক্ষণের দায়ে দুটি ফার্মেসি সিলগালা করা হয়েছে। এ ছাড়া একই সময়ে ৩৪ কোটি ৭ লাখ ৬৯ হাজার টাকার টাকার মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ধ্বংস করা হয়েছে।

অসুখে, অসুস্থতায় ওষুধের ওপর নির্ভর করে মানুষ। অসুখ থেকে নিরাময় পাওয়ার প্রধান উপায় হচ্ছে কার্যকর ওষুধের ব্যবহার। কিন্তু অসাধু মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের কারণে জীবন রক্ষাকারী ওষুধও মানুষের জন্য বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ওষুধ যদি মেয়াদোত্তীর্ণ, নকল বা ভেজাল হয় তবে ভালো হওয়ার পরিবর্তে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যায়। দেশের ফার্মেসিগুলোয় ব্যাপকহারে নকল, ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের ছড়াছড়িতে মানুষ ওষুধ সেবনের ব্যাপারেও এখন আতঙ্কিত। ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর সারা দেশে পাঁচ শতাধিক মডেল ফার্মেসি ও মডেল মেডিসিন শপ নির্ধারণ করেছে। যেগুলোয় মানসম্পন্ন ওষুধ বিক্রির কথা। তবে এসব মডেল ফার্মেসি ও মডেল মেডিসিন শপের বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে। ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর-সূত্র জানান, সাধারণত ফার্মেসিগুলোয় মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ফার্মেসির সেলফ, ড্রয়ার কিংবা রেফ্রিজারেটর অথবা ফার্মেসির অন্য কোথাও পাওয়া গেলে সেগুলো জব্দ করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ আলাদা কনটেইনারে লাল কালি দিয়ে ‘মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ, বিক্রির জন্য নয়’ লিখে সংরক্ষণ করার নিয়ম রয়েছে। পাশাপাশি দ্রুতই সেগুলো উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তর করতে হয়। এ বিষয়ে যথাযথ রেকর্ডও রাখতে হয়। ফার্মেসিতে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ পাওয়া গেলে ফার্মেসিটি সিলগালা করে বন্ধ করাসহ মালিকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা পর্যন্ত নেওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু উল্টো মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের লেভেল টেম্পারিং করে সেগুলো বিক্রি করার ঘটনা ঘটছে। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে মফস্বলের ফার্মেসি পর্যন্ত সর্বত্রই এসব মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি হচ্ছে।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, খোদ রাজধানীর ৯৩ শতাংশ ফার্মেসিতে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি হয়। শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর এই শহরের ফার্মেসিগুলোর এমন অবস্থায় এটা নিশ্চিত যে, দেশের প্রায় সব ফার্মেসিতেই মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ কিনে প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতারা। কোনো কোনো ওষুধের মোড়কসহ যেসব জায়গায় মেয়াদের উল্লেখ রয়েছে, অনেক ক্ষেত্রেই তা থাকে অস্পষ্ট। আবার এমনও অভিযোগ রয়েছে, মেয়াদ আছে এমন প্যাকেটে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ রেখে বিক্রি করা হয়। ক্রেতারা সরল বিশ্বাসে ওষুধ কিনে প্রতারিত হন। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী অশিক্ষিত দরিদ্র মানুষ।

অভিযোগ রয়েছে, নকল, ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ প্রতিরোধে যাদের দায়িত্ব পালনের কথা, তাদের কার্যকর ভূমিকায় পাওয়া যায় না। মূলত নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির গাফিলতির কারণে ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে বাজার। অন্যদিকে নকল, ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের চক্রটিও অত্যন্ত বেপরোয়া। এর আগে অভিযান চালিয়ে নকল-ভেজাল ওষুধের কারখানা বন্ধ করা হলেও ভিন্ন নামে তারা আবারও অবৈধ ব্যবসায় ফিরে আসে। গত ২৬ নভেম্বর মেয়াদোত্তীর্ণ, নকল ও নিষিদ্ধ ওষুধ বিক্রি করায় রাজধানীর মিটফোর্ডের আলী মেডিসিন মার্কেটে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর ও র‌্যাব। এ সময় ১৩টি ওষুধের দোকানকে ২৯ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। দোকান থেকে বিপুল পরিমাণ মেয়াদোত্তীর্ণ, নকল ওষুধ জব্দ করা হয়। ১৮ নভেম্বর মিটফোর্ডে ছয়টি ফার্মেসি থেকে ১ কোটি টাকা মূল্যের নকল সার্জিক্যাল সুতা, ডায়াবেটিস টেস্ট কিট ও ওষুধ জব্দ করে ভ্রাম্যমাণ আদালত। নকল সামগ্রী বিক্রি করায় এসব প্রতিষ্ঠানকে ২৮ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। ৭ নভেম্বর নকল কন্ট্যাক্ট লেন্স বিক্রি করায় রাজধানীর বিজয়নগরে একটি প্রতিষ্ঠানকে ২ লাখ টাকা জরিমানা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত। জব্দ করা হয় ৬৪৮টি নকল কন্ট্যাক্ট লেন্স। এসব ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকারী র‌্যাব সদর দফতরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ফার্মেসিগুলোয় মেয়াদোত্তীর্ণ, নকল ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে। অনেক ফার্মেসিতে বিপুল পরিমাণ সরকারি ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে। লেভেল পাল্টে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ আবার দেওয়া হচ্ছে ভোক্তার হাতে। ফার্মেসি মালিকদের অসততায় জীবন রক্ষাকারী ওষুধ মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে।’ ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল ডা. মাহবুবুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ জব্দ করা চলমান প্রক্রিয়া। এজন্য আমরা মডেল ফার্মেসি তৈরি করছি। ফার্মেসিগুলোয় সচেতনতা তৈরির জন্য ফ্রি কনটেইনার দেওয়া হচ্ছে। নকল, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি বন্ধ করতে “ফার্মেসি ম্যানেজমেন্ট” নামে আমরা একটি সফটওয়্যার চালু করেছি। তামান্না ফার্মেসিতে এর পরীক্ষামূলক কাজ চলছে। এর খুঁটিনাটি সমস্যা সমাধান করে আগামী মাস থেকে সব ফার্মেসিতে আমরা এই অ্যাপস সংযুক্ত করব। তাহলে কোন ওষুধের মেয়াদ কখন শেষ হবে তা জানা যাবে।’